আতঙ্কের মুখ। অভিনয়ে বিপিন শর্মা, সৌরসেনী মৈত্র ও সুদীপ্তা চক্রবর্তী।
দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলা সিনেমায় সে ভাবে বোঝাই যায় না যে অনেক ভাষা ও ধর্ম সম্প্রদায়ের বাসভূমি কলকাতা। তাই সিনেমায় কার্যত ব্রাত্য থেকে যান মহানগরের বিরাট অংশের মানুষ। সেই অভাব পূরণ করেছে অরিন্দম শীলের প্রথম ওয়েব ফিল্ম ‘সত্যমেব জয়তে’।
সমসাময়িক কড়া বিষয় নিয়ে ফিল্ম করার বিস্তর ঝামেলা। এক দিকে সেন্সর বোর্ডের কাঁচি, অন্য দিকে ক্ষমতাবানের রোষ। এ সবের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন পরিচালক।
আর প্রশ্নটা যদি হয় স্বাধীনতার তিয়াত্তরটি সৌরবৃত্ত পার করে আসলে আমরা সত্যিই কি স্বাধীন? সারা ফিল্ম জুড়ে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন পরিচালক। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, না, ইয়াসমিন (সৌরসেনী মৈত্র) নামের মেয়েটির অধিকার নেই দিনের আলোতেও নিজের বৃত্তে ঘোরাফেরার। চিরাচরিত ক্ষমতা ও পুরুষতন্ত্র যেখানে হামলা চালায় আর নাম দেয় ‘মেয়েদের ইজ্জত’, ইয়াসমিনেরও অস্তিত্ব নির্ধারিত হয় তার ‘ইজ্জত’-এ। এগিয়ে আসেন বীরচক্র পাওয়া বৃদ্ধ কর্নেল। কিন্তু দুষ্কৃতীচক্রের কাছে বীর, বীরচক্র, বৃদ্ধ— কোনও কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে নেই। ইয়াসমিনের বাবা মনসুর (বিপিন শর্মা) ক্রমাগত দুষ্কৃতীদের কবলে পড়ে জেরবার হতে থাকে। ইয়াসমিনের মা (সুদীপ্তা চক্রবর্তী) তাই ভীত, দুষ্কৃতীচক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় দেখতে পান না কোনও মঙ্গল। কলকাতা প্রবাসী উত্তরপ্রদেশের মুসলিম পরিবারের পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায়, একমাত্র ভরসা তখন এক সৎ পুলিশ অফিসার (অর্জুন চক্রবর্তী), যে বহন করে মা-বাবা বাহিত সত্তর দশকের আদর্শের উত্তরাধিকার। তার সহকর্মী ইনস্পেক্টর পারিদা প্রমাণ করে ‘পুলিশ তুমি যতই মারো...’-র বাস্তব আজও সে ভাবে পাল্টায়নি । এই চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী দুর্দান্ত।
আরও পড়ুন: ‘তোমাকে যৌনকর্মীর মতো দেখতে লাগে’, উত্তরে স্বস্তিকা বললেন...
আরও পড়ুন: ‘জয়া একটি পর্বও মিস করে না’, কেবিসি নিয়ে ফের আসছেন অমিতাভ
স্পেশাল স্ক্রিনিং-এর প্রাক্কালে পরিচালক বললেন, “দিস ফিল্ম ইজ মাই ইন্টারপ্রিটেশন টু আ ওয়েব ফিল্ম। এটা আমার প্রথম ওয়েব ফিল্ম। সে জন্য খারাপ লাগতে পারে, বলা যায় না (হাসি)। সে জন্য একটু টেনশনেও আছি। ১৫ অগস্টকে মাথায় রেখেই এমন একটা গল্প... যে গল্প এবং স্ক্রিপ্ট অরিজিত বিশ্বাসের। অরিজিত ‘বদলাপুর’, ‘অন্ধাধুন’ লিখেছে।”
নিরাপদ আশ্রয় বলে সত্যিই কি কিছু হয়?
ফিল্মটি করতে রাজি হলেন কেন? জে ডি প্রোডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে প্রযোজক রূপা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ছবিটার কনটেন্ট খুবই কনটেম্পোরারি। অরিন্দম ইজ দ্য রাইট পার্সন টু জাস্টিফাই দিস কনটেন্ট। এই কোলাবরেশনটা আমার মতে খুব ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।”
ফিল্মের সমস্ত অভিনেতাই পরস্পরের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন। বিপিন শর্মা বাবার ভূমিকায় অনবদ্য। বললেন, “শুটিংয়ের প্রথম দিন থেকেই ইমোশনালি ইনভলভড ছিলাম। গণপিটুনি বা নানা রকম অপরাধের খবর পেপারে পড়ি। সে সব আমাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করে। সে রকমই একটা দৃশ্য দিয়ে এই ফিল্মে আমার শুট শুরু হয়। আমাদের চারপাশে এ রকম অনেক কিছু ঘটে, সব সময় আমরা জানতেও পারি না। অন্য দিকে অরিন্দম নিজে এক জন অভিনেতা হওয়ায় অভিনেতাদের খুব ভাল বোঝে। ওর সঙ্গে অভিনেতা হিসেবে একটা অন্তরের সম্পর্ক যেটা ঠিক টিপিক্যাল পরিচালকের মতো নয়। উই আর মোর লাইক সাইলেন্ট কোলাবরেটর।”
পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অর্জুন চক্রবর্তী।
এই ধরনের গল্প কি ফিল্মে আরও বেশি করে আসা উচিত? তিনি যোগ করলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। কারণ আমাদের দেশ যে সব ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে এ ধরনের গল্প ফিল্মে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভায়োলেন্স কোনও কিছুরই উত্তর হতে পারে না। সামথিং মেজরলি রং উইথ দিজ ভায়োলেন্স।”
ইয়াসমিন চরিত্রটির ভেতর দিয়ে আমাদের দেশে মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরার বিষয়টাও কি প্রশ্নের মুখে? তাঁর কথায়: “অবশ্যই। শুধু মেয়েরাই নয়, সংখ্যালঘু মানুষেরা এবং যাঁরা অন্য রকম চিন্তাভাবনা করেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রশ্নের মুখে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই ধরনের হ্যারাসমেন্ট এবং নৃশংসতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।”
জয়ন্ত কৃপালনীর পর্দা-উপস্থিতি, ইংরেজি বলার ধরন, স্বরক্ষেপণ... মুগ্ধ হয়ে দেখতে ও শুনতে হয়। পরিচালক সম্পর্কে জয়ন্ত বললেন, “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে অরিন্দমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তখনই আমার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ভেবেছিলাম ভদ্রতার খাতিরে বলছেন এবং এ বিষয়ে আর কথাও এগোয়নি। পরে এক দিন ওঁর ফোন পাই। আমাকে বলেন তিনি সত্যিই এ বিষয়ে সিরিয়াসলি ভাবছেন। এবং বাকিটা তো ইতিহাস।”
আলোকিত শহরের কালো মুখ।
সুদীপ্তা চক্রবর্তীর স্ক্রিন প্রেজেন্স স্বল্প সময় জুড়ে হলেও তাঁর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়। যদিও চরিত্রটি ভীষণ একমাত্রিক। সুদীপ্তা বললেন, “আই হ্যাড নাথিং মাচ টু ডু। ভেরি স্মল ক্যারেক্টার। অরিন্দমদার রিকোয়েস্ট রাখতে চরিত্রটা করেছি।” অরিন্দম-সুদীপ্তা জুটির সুরভি পারেখ-কে দর্শক কিন্তু ভুলবেন না (‘ধনঞ্জয়’)।
আপনার চরিত্রটি কি ‘বিশেষ’? কেন? অর্জুন চক্রবর্তীর উত্তর: “চরিত্রটি আমার কাছে ‘বিশেষ’। কারণ এর আগে আমি পুলিশ করেছি, তবে এই পুলিশ অফিসারের সততা আছে, তার ওপর একটু গম্ভীর টাইপের ক্যারেক্টার, কথা কম বলে। পুরোপুরি না হলেও ব্যক্তিগত ভাবে কিছুটা আমি এ রকম। সে জন্য রিলেট করতে পেরেছি।”
‘ব্যোমকেশ গোত্র’-তে এক দুষ্টু চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সে কথা মনে করিয়ে দিতেই অর্জুন বললেন, “এই ফিল্মে একেবারে পোলার অপোজিট চরিত্রে উনি (পরিচালক) সুন্দর ভাবে গাইড করেছেন। ‘ব্যোমকেশ গোত্র’-র থেকে ‘সত্যমেব জয়তে’ অনেকটাই আলাদা। মাত্র ন’দিনে এ রকম একটা ছবি, অথচ এই কোয়ালিটি লেভেল মেনটেন করে- এটা হয়তো উনিই পারেন।”
ইয়াসমিনের মতো চরিত্র আগে করেননি সৌরসেনী মৈত্র। তিনি স্পষ্টতই উত্তেজিত, “আমার যে ক’জন মুসলিম বন্ধু-বান্ধবী রয়েছে তাদের সঙ্গে বসেছিলাম জাস্ট টু গেট দ্য ফিকশন অ্যান্ড এভরিথিং রাইট। ইয়াসমিন এমন এক চরিত্র যে শুধু নিজের জন্য নয়, সবার কথা ভেবেই গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখায়।”
জুনিয়র ল’ইয়ারের চরিত্রে রোশনি ভট্টাচার্য। শেয়ার করলেন, “অরিন্দমদা নোজ হোয়াট হি ওয়ান্টস ফ্রম হিজ অ্যাক্টরস। ইটস আ ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট এক্সপিরিয়েন্স।”
খোকা নামের এক দুষ্কৃতীর চরিত্রে প্রসূন গায়েনের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। মূল ধারার ছবিতেই দর্শক তাঁকে দেখে থাকেন। কিন্তু এই ফিল্মে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি। বললেন, “এই চরিত্রটা আমার কাছে খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। তার কারণ, মূল যে ক্রাইমটা হচ্ছে সেটা আমার হাত ধরেই হচ্ছে। কিন্তু সেই চরিত্রের মধ্যে সফটার শেডসও আছে, কথাগুলো গোল গোল করে বলে, প্রনানশিয়েশন একটু অন্য রকম, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অন্য রকম। নিজের কোনও পাওয়ার নেই, কিন্তু অন্যের পাওয়ারে নিজেকে অনেক বেশি বড় বলে মনে করে। ক্যারেক্টার আর্টিস্ট হিসেবেই আমি আরও কাজ করতে আগ্রহী।”
প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে?
এই ফিল্মে অভিনয় করেছেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রুমকি চট্টোপাধ্যায়, সৌম্য সেনগুপ্ত প্রমুখ। বিক্রম ঘোষের মিউজিক ফিল্মের মুহূর্তগুলিতে আলাদা মাত্রা যোগ করে। ডার্ক, রিয়েলিস্টিক গল্পের আলো-অন্ধকার অসাধারণ মুন্সিয়ানায় এগিয়ে নিয়ে চলে। পরিচালকের সিনেমা-ভাষার সঙ্গে তাঁর শ্রবণ-শিল্পের যোগ্য সংযোগ বিষয়ে দর্শক ইতিমধ্যেই পরিচিত।
ন্যাচারাল লাইটে শুট করা আলোছায়া, রঙের বিন্যাস অসাধারণ। সিনেমাটোগ্রাফার অয়ন শীল (পরিচালক মজা করে বললেন, ‘অয়ন আমার ভাইপো নয়।’) এত কম সময়সীমার মধ্যে এত উঁচু মাত্রার কাজ উপহার দিতে পারেন না দেখলে বিশ্বাস হওয়া শক্ত। এর পর সময়ের অজুহাত দেখিয়ে কেউ নিম্নমানের সিনেমাটোগ্রাফি জাস্টিফাই করতে চাইলে মানা যাবে না। এর আগে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র না করলেও ডিওপি হিসেবে অয়ন করে ফেলেছেন বেশ কিছু কাজ। এই ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফি সম্পর্কে অয়ন বললেন, “লাইট র্যান্ডম আর্টিফিশিয়াল লাগছে। ও রকম ভাবেই লাইট করেছি। কলকাতার বসতি এরিয়া... লাল স্ট্রিট লাইট, অন্ধকার... এ রকম একটা দেখাতে চেষ্টা করেছি।”
ফ্রেমের ফোরগ্রাউন্ডে চোখে পড়ার মতো দীর্ঘ সময় ধরে কিছু অবজেক্ট। এটা এমন এক ধরনের স্টাইলাইজেশন যাতে সাবজেক্ট গৌণ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এমনকি কখনও কখনও দর্শকের দেখার সাইকোলজি থেকে মনে হতেই পারে ফোরগ্রাউন্ডের অবজেক্ট সরিয়ে সাবজেক্টকে দেখি। এ বিষয়ে কী বলছেন ডিওপি? সামান্য হেসে অয়ন বললেন, “ফ্রেমিং-এ মোস্ট জায়গাতে আই অলওয়েজ ট্রায়েড টু কর্নার দ্য সাবজেক্ট। ইটস লাইক ক্লসটোফোবিক। ওদের মেন্টাল স্পেস অনেকটা পলিউটেড, ঘাঁটা... ওরা কী করবে বুঝতে পারছে না। সো দ্য অডিয়েন্স অলসো ফিল... ওই একটা মেসি ব্যাপার। এই জিনিসটা করার চেষ্টা করেছি।”
‘পলিউটেড ও ঘাঁটা’ আমরাও জি ফাইভ ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ফিল্মটি দেখতে দেখতে নিজেদের দেখে নিতে পারি আয়নায়!
(ছবি: সংগৃহীত)