Satyajit Ray

এই কঠিন সময়েও মানিকদা আশা হারাতেন বলে মনে হয় না

সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীর সূচনায় আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য কলম ধরলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীর সূচনায় আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য কলম ধরলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২০ ০১:২৪
Share:

স্মৃতি: সৌমিত্রের চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন সত্যজিৎ।

মানিকদাকে নিয়ে অতীতে যত চর্চাই হোক সেই চর্চা কোনওদিনও থামবে না। তাঁর জন্মশতবর্ষ নিঃসন্দেহে আমরা উদযাপন করব। শুধু আমরা কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছবির দর্শক মাত্রেই তা করবেন।

Advertisement

তবে এই মুহূর্তে যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, তাতে সেই উদযাপনে সাময়িক অসুবিধা হলেও সেটা কেটে যাবে। এতো আর চিরকাল চলতে পারে না। এখন অনেকেই ভাবছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সিনেমা তৈরি হবে কী ভাবে? আমার মতে এ নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার কিছু নেই। বিশ্বযুদ্ধের সময়েও দেখেছি লোকের মনে হয়েছে সব ধ্বংস হতে বসেছে। তবু তার মধ্যে সিনেমা, নাটক কিন্তু বন্ধ হয়নি। লন্ডনে যখন বোমা পড়ছে তখনও কিন্তু সিনেমা হল বন্ধ হয়নি। তাই আগামী এক বছরে অনেক সময় পাওয়া যাবে মানিকদার কাজ ফিরে দেখার বা তাঁকে নতুন করে চেনার।

শতবর্ষ পেরিয়ে আগামী প্রজন্ম মানিকদার ছবির উত্তরাধিকার বহন করবে কি না তা আমি বলতে পারব না। সত্যি বলতে কি, এখনই সেই উত্তরাধিকার কতটা বহন করা হচ্ছে তা-ও আমি জানি না।ওঁর ছবি থেকে আগামী প্রজন্ম কতটা নেবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না।আমি তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। তবে আমি মনে করি ওঁর ছবি থেকে অনেক কিছু নেওয়ার আছে, শেখার আছে।যা আমার বা আমাদের প্রজন্মের ক্ষেত্রে হয়েছে।আমরা অনেক কিছু পেয়েছি ওঁর ছবি থেকে।

Advertisement

লেন্সে চোখ

সিনেমার ভাষা আগামী দিনে যতই বদলে যাক, তাতে সত্যজিতের ছবির গুরুত্ব কখনওই কমবে না।শিল্পের বদল তো ঘটেই। সেটা তো ভাল কথা। চলচ্চিত্র, শিল্পকলা, নাটক, সাহিত্য, কবিতা— সবক্ষেত্রেই নতুন ভাবনা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এসে সেই শিল্প মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছে। তাতে ক্ষতির কিছু নেই।

খুব কাছ থেকে দেখেছি বলে আমি জানি,সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন আশাবাদী শিল্পী। তাঁকে কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি, আশাহত হতে দেখিনি। নানা বাধা পেরিয়েই তিনি তাঁর ছবি করে গিয়েছেন। সে সবের ছাপ কিন্তু ওঁর ছবিতে পড়তে দেননি। ছবিগুলি দেখে আজ সে সব বোঝাও সম্ভব নয়।

তাঁর সমস্ত ছবি নিয়ে যদি কেউ মূল্যায়ন করতে বসে, তবে সে ওঁর এই আশাবাদী দিকটি বুঝতে পারবে। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে যার শুরু।‘অশনি সংকেত’ ছবিতে আসন্ন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি থাকলেও সেই ছবি শেষ অবধি নিরাশার কথা বলে না। ‘মহানগর’-এও সেই আশা, নতুন করে বাঁচবার আশা। ‘হীরক রাজার দেশে’ শেষে ‘দড়ি ধরে মারো টান’ দর্শককে উজ্জীবিত করে। ‘গণশত্রু’র শেষেও তাই। একটা মিছিলের শব্দ, যা এগিয়ে আসছে চিকিৎসক অশোক গুপ্তর সমর্থনে। আবার ‘আগন্তুক’-এ যেখানে মানুষ ভয়ঙ্কর এক সভ্যতাকে গড়েছে, মাদকদ্রব্য,পরমাণু বোমা ইত্যাদিতা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেখানেও সত্যজিৎ রায় একেবারে আশা হারিয়ে বসে আছেন তা কিন্তু নয়। একটা শব্দ, ‘ফ্লক্সিনসিনিহিলিফিলিপিকেশন’ যা দিয়েসভ্যতার অসারত্ব তিনি কত সহজে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু মানুষে-মানুষে আত্মিকযোগই যে তার সবথেকে বড় পরিচয় তার চিহ্ন রেখে দেন মনমোহনের সম্পত্তি দানের চিঠির মধ্যে দিয়ে।

এটাই ওঁর থেকে শেখার। এই যে মারণ রোগ আমাদের ঘরে বন্দি করে রেখেছে, আমরা দেখছি অর্থনৈতিক একটা বিপর্যয় নামতে শুরু করেছে চারদিকে, হয়তো ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, তবু বলবআশা হারালে চলবে না। আমি জানি না এই অবস্থায় মানিকদা ঠিক কী করতেন, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভবও নয়। তবে আশা হারাতেন বলে আমার মনে হয় না। আমিও যদি বেঁচে থাকি তবে এই পর্বটা কেটে গেলে আবারও অভিনয় করব, নাটক করব। সেটাই আমি ওঁর থেকে শিখেছি। আশা না হারাতে। আর পৃথিবীর যাবতীয় শ্রেষ্ঠ সিনেমা বা নাটক তো শেষ অবধি তাই বলে। মানুষ শেষ অবধি জেতে, জিতবেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement