মৃণাল সেন। ইনসেটে লেখক।
মৃণাল সেনের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ যুগের অবসান হল। আমাদের চলচ্চিত্রে যাঁরা আভিজাত্যের মাত্রা যুক্ত করেছিলেন সত্যজিত্ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তার অন্যতম স্থপতি তিনি। কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে সত্যজিত্ যখন ঊনিশ শতকীয় মানবিকতাবাদকে চলচ্চিত্রীয় বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় রত এবং যখন তিনি চিত্রকল্পকে নৈঃশব্দ্যের মাত্রা দিচ্ছেন বা ঋত্বিক যখন ইতিহাসের উপাদানগুলিকে পৌরাণিক লোককথার সঙ্গে জুড়ে এক ধরনের বিস্ফোরক বাস্তবতা তৈরি করছেন, মৃণাল তখন বেছে নিয়েছিলেন মধ্যবিত্তের ও নাগরিকতার পৃথিবী। যার ফলে আমাদের ছায়াছবির ইতিহাসে তৈরি হয়েছে ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘ভুবন সোম’ বা ‘আকালের সন্ধানে’। এত স্ববিরোধ কোনও চলচ্চিত্রকারের নেই। কিন্তু এক নিঃশ্বাসে নিজেকে পাল্টে নেওয়ার অত অনিঃশেষ আবেগ কি অন্য কোনও চলচ্চিত্রকারের ছিল? মৃণাল কতটা প্রতিভা, এ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা খেয়াল করেন না যে গতানুগতিক ধারার চলচ্চিত্রকার হয়ে যাওয়া যাঁর স্বাভাবিক ছিল, তিনি কোন প্রণালীর সাধনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠলেন?
আমরা ‘বাইশে শ্রাবণ’ নামে ছবিটির কথাই ধরতে পারি। কোনও মতেই মাধবী-জ্ঞানেশের প্রণয়োপাখ্যানটিকে স্মরণচিহ্ন মনে হত না, যদি না মৃণাল সেন ইতিহাসের অমঙ্গলকে পারিবারিক বিস্তারের মধ্যে উত্কীর্ণ করে না দিতে পারতেন। স্পেকটাকেলের বিরুদ্ধে দৈনন্দিনকতা— আধুনিক চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। একটি তুচ্ছ দম্পতির তুচ্ছতর মিলনরজনী কী ভাবে পরিবার, প্রেম বা দাম্পত্য জাতীয় ধারণাগুলিকেই আপেক্ষিক প্রমাণ করল, তার অন্যতম নিদর্শন এই ছবি।
বস্তুত ১৯৬০-এ সত্যজিত্ রায়ের ‘দেবী’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরে এই ‘বাইশে শ্রাবণ’ আমাদের নারীকে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যুক্ত করার এক গোপন সংকেত চিহ্ন। ‘সাম্যবাদী ইস্তেহার’ থেকে মৃণাল যদি পরিবারতন্ত্র বা আমাদের মানবিক অনুভূতি সমূহের দোলাচলই আয়ত্ত করতেন তাঁকে নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা থাকত না। মৃণালের চলচ্চিত্রে যেন ‘ভুবন সোম’-এ জড়িয়ে থাকে অঘোষিত গরিমা বুর্জোয়াতন্ত্রের প্রতি একটা ঠাট্টা। সমগ্র ‘ভুবন সোম’ গুর্জরতটকে নগরীর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখেছে। সুহাসিনী মূলের দেহলতা হয়ে উঠেছে আটপৌরে শরীর। তখন একে আমাদের প্রাচ্য ভূখণ্ডে আধুনিকতার একটুকরো হিরে বলে অকারণে মনে হয়নি।
আরও পড়ুন, আদর্শ থেকে কখনও সরেননি মৃণালবাবু, বললেন মাধবী
মৃণাল সেন।
৭০-এর দশকের বিখ্যাত রাজনৈতিক ছবিগুলির দিকে তাকালে বোঝা যায় ‘ইন্টারভিউ’ থেকে ‘কোরাস’ পর্যন্ত মৃণাল সেন ভারতীয় বামপন্থার সঙ্গে এক অন্তহীন তর্কে লিপ্ত হয়েছেন। ‘আকালের সন্ধানে’ একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক চলচ্চিত্র। আর মৃণালের উদ্দেশ্য ঠিক তাই। তিনি একটি নিটোল আখ্যান গড়ে তুলেতে চাননি, বরং আখ্যানটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বারে বারে। মূলত মধ্যবিত্ত এবং শহর তার অবলম্বন এবং এই তুচ্ছ দৈনন্দিনকে যতিচিহ্নের অনিয়মে তিনি সর্বজনীন করে তুলতে পারেন। শহরকে আর কেউই এত তীব্র চুম্বন করেননি। না সত্যজিত্, না ঋত্বিক। যুবক যুবতীর হাতে সরাসরি নাশকতার হাতিয়ার তুলে দেওয়ার সাহস মৃণাল সেন দেখিয়েছিল ৭০-এর দশকে। তাই তাঁকে আমাদের মনে হয়েছিল একদা পথ চলার সঙ্গী। আজ তিনি চলে যাওয়ার পরে মনে হচ্ছে এই শহর তাঁর স্থায়ী প্রণয়ীকে হারাল। এখন আমাদের রাজপথগুলি অনেক মলিন। সেখান দিয়ে কেউ গেরিলার মতো দৌড়ে যাবে না।
আরও পড়ুন, আমাকে হনুমান বলে ডাকার লোকটা চলে গেল…
(হলিউড, বলিউড বা টলিউড - টিনসেল টাউনের টাটকা বাংলা খবর পড়তে চোখ রাখুন আমাদের বিনোদনের সব খবর বিভাগে।)