বেশ কিছু দিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পরে অবশেষে এক দিন টাইটেল কার্ডে নাম যাওয়ার পালা। ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করা হল, কী নাম দিতে চান তিনি? উত্তর এসেছিল, ‘সঞ্জয় লীলা ভন্সালী।’ অথচ প্রচলিত সামাজিক রীতি মেনে তাঁর নাম হওয়া উচিত ছিল সঞ্জয় নবীন ভন্সালী।
কিন্তু মুম্বইয়ের ঘিঞ্জি চাওলের শৈশব তাঁকে বাবার নাম নিজের পরিচয়ে রাখতে বিরত করল। প্রযোজক হিসেবে নবীনের ক্রমাগত ব্যর্থতা তাঁর পরিবারকে নিয়ে তুলেছিল মুম্বইয়ের চাওলে। সেখানেই দিনভর নেশা করে পড়ে থাকতেন তিনি।
ছবিতে টাকা বিনিয়োগ করে দেনায় ডুবে গিয়েছিলেন নবীন। জামাকাপড় করে সেলাই করে সংসার চালাতেন তাঁর স্ত্রী লীলা। কোনওমতে চলত চার জনের সংসার। ব্যর্থ নবীন প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। যাতে তাঁর ছেলে ফিল্মের জগতে না আসেন।
কিন্তু ছোট থেকেই রোখ চেপে গিয়েছিল সঞ্জয়ের। তাঁকে ইঁদুরের উৎপাতে ভরা ঘিঞ্জি চাওলের ঘর থেকে বার হতেই হবে। এবং সেটা তিনি করবেন হিন্দি ছবির হাত ধরেই। যখন সেটা করতে তিনি সফল হলেন, নামের পাশে নিলেন মায়ের পরিচয়।
আশৈশব গুরু দত্ত এবং রাজ কপূরের ভক্ত সঞ্জয় ভর্তি হন পুণের এফটিআইআই-তে। উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বিধুবিনোদ চোপড়ার সঙ্গে কাজ করেন সহকারী পরিচলক হিসেবে। ‘পরিন্দা’ এবং ‘১৯৪২ এ লভ স্টোরি’, দু’টি ছবিতেই তিনি ছিলেন সহকারী পরিচালনার দায়িত্বে।
‘করীব’ ছবির সময় থেকে বিধুবিনোদের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে। তিনি এই ছবিতে বিধুবিনোদের সঙ্গে কাজ করতে চাননি। তার আগেই অবশ্য একক পরিচালক হিসেবে মুক্তি পেয়েছে ভন্সালীর ছবি ‘খামোশি: দ্য মিউজিক্যাল’। নানা পটেকর-মনীষা কৈরালা-হেলেন অভিনীত এ ছবির গান জনপ্রিয় হলেও বক্স অফিসে লক্ষ্মীলাভ হয়নি।
১৯৯৯ সালে ‘হম দিল দে চুকে সনম’ এবং ২০০২-এ ‘দেবদাস’ এক লহমায় ভন্সালীকে নিয়ে চলে আসে জনপ্রিয়তার প্রথম সারিতে। ঐশ্বর্য-শাহরুখ-মাধুরী ম্যাজিকের তিন বছর পরে মুক্তি পেল ‘ব্ল্যাক’। হেলেন কেলারের জীবনকে উপজীব্য করে তৈরি এই ছবি এখনও বলিউডের অন্যতম মাইলফলক।
পরিচালক ভন্সালী ছাড়া স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনকেও এই সিনেমার মাধ্যমে নতুন রূপে পায় বলিউড। ‘ব্ল্যাক’-এর অভূতপূর্ব সাফল্য পরিচালকের পুরস্কারের ভান্ডারকে করে তোলে বর্ণময়।
‘সাওয়ারিয়া’ এবং ‘গুজারিশ’ সে রকম সাফল্য পায়নি ঠিকই। কিন্তু ভন্সালী জাদু আবার বলিউডকে মোহময় করে ২০১৩ সালে। সে বছরই মুক্তি পায় ‘গলিয়োঁ কা রাসলীলা রামলীলা’। রোমিয়ো জুলিয়েটের আখ্যান ঘিরে তৈরি এ ছবি ছিল সে বছরের বক্সঅফিস সফলদের মধ্যে অন্যতম।
রোমান্টিক ড্রামা প্লটের থেকে বেরিয়ে ভন্সালী তাঁর ছবির দর্শকদের স্বাদবদল করান ২০১৪-এ। পরিচালনা করেন মুষ্টিযোদ্ধার বায়োপিক ‘মেরি কম’। সে বছর মুক্তি পায় তাঁর আর একটি ছবি ‘গব্বর ইজ ব্যাক’। পরের বছর ভারতীয় মূল ধারার বিনোদন ছবির জগতে ঝড় তোলে তাঁর ‘বাজীরাও মস্তানি’।
ঐতিহাসিক প্লটকে ছাড়লেন না ভন্সালী। ২০১৫-য় মুক্তি পেল ‘পদ্মাবৎ’। দেশজুড়ে বিক্ষোভ, হুমকির পাশাপাশি এই ছবি এনে দেয় জাতীয় পুরস্কার। তার আগে ‘ব্ল্যাক’, ‘দেবদাস’ এবং ‘বাজীরাও মস্তানি’র জন্যেও সঞ্জয় লীলা ভন্সালী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৫-এ পান পদ্মশ্রী সম্মান।
মুম্বইয়ের গণিকালয় তথা অন্ধকার জগতে সুপরিচিত নাম গাঙ্গুবাঈয়ের বায়োপিক ভন্সালীর পরবর্তী ছবি। গাঙ্গুবাঈয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আলিয়া ভট্ট। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা চলতি বছরেই।
ইদানীং জনমানসে ভন্সালীর ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খেয়েছে। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের রহস্যমৃত্যুতে তিনি এখন স্বজনপোষণকাণ্ডে অভিযুক্ত। তদন্তকারীরা দীর্ঘ ক্ষণ কথাও বলেছেন তাঁর সঙ্গে।
মুম্বই পুলিশ সূত্রে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, জিজ্ঞাসাবাদে ভন্সালী জানিয়েছেন, কেন তিনি সুশান্তকে বাদ দিয়েছেন তাঁর চারটি সিনেমা থেকে। ভন্সালীর দাবি, তিনি যে সময় চেয়েছিলেন, সুশান্ত সেটা তাঁকে দিতে পারেননি। ফলে দু’তরফের সময়সূচি একসঙ্গে না মেলায় সুশান্তের পরিবর্তে অন্য অভিনেতাকে সুযোগ দিতে হয়েছিল।
সঞ্জয় লীলা ভন্সালী এখনও অকৃতদার। এক সময়ে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল কোরিয়োগ্রাফার বৈভবী মার্চেন্টের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের প্রেম ভেঙে যায়। কারণ নিয়ে কেউ মুখ খোলেননি। বলেছেন, জীবনের ওই একটা পর্ব নিয়ে তিনি নীরব থাকবেন।
‘সাওয়ারিয়া’ ছবির শুটিংয়ে সঞ্জয়-বৈভবী ঘনিষ্ঠ হন। পরে ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেম। তাঁদের এনগেজমেন্টও হয়ে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু শেষ অবধি সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়ান তাঁরা।
বৈভবীর মতে, তাঁদের মনে হয়েছিল জীবনসঙ্গী হওয়ার থেকে বন্ধু হয়েই তাঁরা ভাল থাকবেন। সেই সিদ্ধান্তই তাঁরা নিয়েছেন। দু’জনেই একে অন্যের কাজের উপর শ্রদ্ধাশীল এবং ভাল বন্ধু। তবে আশ্চর্যের বিষয়, দু’জনের কেউই এখনও বিয়ে করেননি।