Rudranil Ghosh

দাদা, আমি কেন সাতে পাঁচে থাকি না...

বহু মানুষ মনে করেন, ‘‘শুধু এরাই ভাল আছে!’’ ভিতরে ভিতরে যে এই ইন্ডাস্ট্রির ৯০ শতাংশ মানুষ পকেটে ‘ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি’ হয়ে আছেন, তা বোঝা মুশকিল।

Advertisement

রুদ্রনীল ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২০ ১৪:৫১
Share:

রুদ্রনীল ঘোষ।

না, লকডাউনে আমি কর্মহীন হইনি। দিব্যি চলেছে আমার কাজ, চলছেও! যদিও বা মার্চ থেকে শুটিং বন্ধ রয়েছে, পুরোদমে বন্দোবস্ত করে কবে থেকে সিনেমার কাজ শুরু হবে তা আজও জানি না! তাই আমার আজ অবধি রোজগার বন্ধ তা অবশ্য বলাই যায়! তবে অনেক নতুন কর্ম জুটে গিয়েছে বিনা ইনকামের। মানুষের পাশে দাঁড়াবার কাজ। আমার কাছে এটা উপকার নয়, দায়িত্ব।

Advertisement

আমরা গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করলেও রোজগারে মুম্বইয়ের থেকে দেড় হাজার গুণ পিছিয়ে। কিন্তু ওই যে, ‘গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রি’, তাই পরিপাটি দাঁতকপাটি হয়ে থাকাটা বাধ্যতামূলক! যা দেখে বহু মানুষ মনে করেন, ‘‘শুধু এরাই ভাল আছে!’’ ভিতরে ভিতরে যে এই ইন্ডাস্ট্রির ৯০ শতাংশ মানুষ পকেটে ‘ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি’ হয়ে আছেন, তা বোঝা মুশকিল। জীবনটাই ইএমআই হয়ে গিয়েছে! ওই ‘এভরিটাইম মানি-ক্রাইসিস ইনভলভমেন্ট’ গোছের।

গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাত্র জনা পঞ্চাশেক নাম করা লোক ছাড়া বাকিরা চরম অর্থনৈতিক বিপদে! যেহেতু, এই জনা পঞ্চাশেকের কথাই মিডিয়ায় পৌঁছয়, তাই ‘আমরা করব জয়, ঝড় থামবেই, সূর্য উঠবেই’, দাঁত চিপে এই সব আশাব্যঞ্জক স্লোগান দিয়ে চলেছি হাসিমুখে! মন থেকেই দিচ্ছি, তবে আমরাও যে একটু বড় মাপের, ‘দিন আনি দিন খাই, মাস মাইনে কিছু নাই’ তা ভুলি কী করে! ব্যাঙ্কের টাকা ক্রমশ কমছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: কোভিডের জন্য কি বাধ্য হয়ে বদলে ফেলতে হবে সিনেমার প্লট? সংশয়ে টলিপাড়া

আর ব্যাঙ্কের টাকার সঙ্গেও যেটা বেশি করে কমেছে তা হল মন! সব সময়, যদি রোজগার না হয়, খাব কী? পরব কী? লোন শুধবো কী করে— এ সব দুশ্চিন্তা তো লেগেই আছে। তাই, সঞ্চয়ী বাঙালি হয়ে অধিকাংশই আঁকড়ে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করছে পড়ন্ত ব্যাঙ্ক ব্যালান্সকে!

আমিও প্রথম দিকে এ সব চেষ্টা করিনি তা নয়, কিন্তু সে ইচ্ছা সামলাতে পারিনি।

করোনায় দিন আনি দিন খাই গরিব মানুষদের একের পর এক জীবিকা গুটিয়ে যখন ভাইরাসের থেকে পেটের যুদ্ধ বড় হল, তখন আর চুপ করে থাকতে পারিনি। সবার আগে ফস করে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বেশ কিছু দান করে দিলাম। নাহ্, কেউ কানে কানে এসে বলেনি, ‘‘ওরে দান কর, মাধ্যমিকে তোর জীবনী পড়ানো হবে! ওরে পাড়ার মোড়ে মূর্তি হবে, মানুষের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়, নাম হবে, মহান হবি রে!’’ আমার ইচ্ছা হল, ভবিষ্যতের গপ্পো না ভেবে দিয়ে দিলাম। যে লোকগুলোর ভালবাসা-দোয়া-প্রশংসাতে আজ আমার গাড়ি-বাড়ি, খেতে না পাওয়া স্ট্রাগল থেকে আজ আমার পরিচিতি, আমি গিলব আর তাদের পেট খালি থাকবে? তাই দিয়েছি। কিন্তু, আমরা থেকেও যাঁরা অনেক বেশি রোজগার করেন তাঁরা কেন আমার পরে দিলেন সে আজও বুঝিনি! অনেকে আবার দেব দেব করে কেন যে আর দিলেন না, তা-ও বুঝিনি! হয়তো আমি ব্যাচেলর, আর তাঁরা বাবাই বাবলির বাবা-মা হয়ে পড়েছেন বলেই হয়তো দানধ্যানে দানে কুঁই কুঁই করেছেন, এটা ধরে নিয়েছি।

লকডাউনের ডায়েরিতে নিজের হাতে রান্না, ঘর পরিষ্কার, জামাকাপড় কাচা— এ সব একপ্রকার সিলেবাস বানিয়ে ফেলেছিলাম। সবার মতোই সমাজজীবন কর্মজীবন যৌনজীবনে ছিটকিনি এঁটে মাঝে মাঝেই রাত ৮টায় টিভিতে তিনি এসে কি না কি বলবেন, সে টেনশনে নখ খেতে গিয়ে অনেক বার আঙুলও খেয়ে ফেলেছি। দাদা-দিদির ভাইরাস দমনে পদ্ধতিগত চু-কিতকিত খেলাও মুখস্থ করে ফেলেছি! হাত ধুয়ে ধুয়ে নিজেকে হাজা রোগী ভেবেছি, মুখে মাস্ক পরে বার বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাটম্যান ঘোষ বা অরণ্যদেব সামন্ত ভেবেছি। অনেক কিছু অকাজের মাঝেও খালি একটা তথ্য জানাবার জন্য হাঁকপাঁক করেছি। যা আজ অবধি কোনও মিডিয়া বা মন্ত্রী তুলে ধরল না! তা হল, ‘করোনা আতঙ্ক আয়োজিত’ এই কর্মহীনতার সময়ে দেশ জুড়ে কত মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেল সেই সংখ্যাটা কত? নাহ্, উত্তর পাইনি আজও।

অবসরে সোশ্যাল মিডিয়ায় কবিতা ছবি পোস্ট করেছি। আমার কিছু লেখা নিয়ে মানুষজন আবেগে ভেসেছেন দেখে আপ্লুত হয়েছি। যত বার ভেবেছি অমুক তারিখ লকডাউন উঠলে কাজে যাব, তত বার রাত ৮টায় তমুক এসে ভাষণ দিয়ে সব বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলেন। যদিও সে ভাষণ আমাদের আত্মনির্ভর হওয়ার জন্যই ছিল! আজ আমি নিজের পিঠ নিজেই চুলকোই দাদা!

সবে লকডাউন উঠবে উঠবে ভাব, সবার রোজগার শুরু হবার ইঙ্গিত, এমন সময় সে এল! মানুষের যতটুকু শেষ সম্বল পড়েছিল তা-ও উড়িয়ে নিয়ে গেল! শহর গ্রাম শেষ প্রায়। লন্ডভন্ড সবার ঘুরে দাঁড়াবার আশা।

বেরোজগেরে নিঃস্বরা এ বার পেটের ভাতের সঙ্গে মাথার চালটুকুও হারাল। তাই আর বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। বন্ধু পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, আমি আর কয়েক জন বন্ধু লেগে পড়লাম কাজে! হিসাব করে দেখলাম, গ্রামের ক্ষতি চোখের সামনে, কিন্তু শহরের বস্তির গরিব মানুষের ক্ষয়ক্ষতি উঁচু উঁচু মাল্টিস্টোরিডের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। তাই, এই বস্তিগুলোতে খাবার আর জিনিসপত্র দেওয়া শুরু করে দিলাম। খবর পেয়েই এগিয়ে এল যিশু সেনগুপ্ত ও প্রযোজক মহেন্দ্র সোনি। অর্থ আর জিনিসপত্র দিয়ে ক্রমাগত সাহায্য করে গেলেন অপরাজিতা আঢ্য, অভিজিৎ সিংহ থেকে শুরু করে নানান জীবিকার নানা বন্ধু মানুষ! সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আমার অর্থসাহায্যের আবেদনে সাড়া দিলেন স্বল্প আয়ের যুবক-যুবতীরাও। এই মন্দার বাজারে তাঁদের ১০০, ২০০ করে দেওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ তুল্য।

বাড়তি টাকা পেয়ে ছুটলাম সুন্দরবন অঞ্চলে। সাহায্য তুলে দিতে পারলাম কয়েক হাজার সব হারানো মানুষের কাছে। আমাদের পণ্যবোঝাই গাড়ি বিধ্বস্ত গ্রামগুলোতে ঢোকা মাত্রই খালি পেটের ক্লান্ত মুখগুলোতে মলিন হাসি ফুটে উঠল! আজও যেন মানুষের উপর মানুষ আস্থা হারায়নি! আমার দেশের, আমার রাজ্যের মানুষের পাশে দাঁড়াবার সুযোগ পেলাম। কান্না পেয়ে গিয়েছিল চারদিকে তাকিয়ে! কোনটা ধানক্ষেত, কোনটা নদী, বুঝে উঠিনি, প্রবল ঝড়ে ছোট ছোট বাড়ি গুলোকে উড়িয়ে খড়কুটো করে ফেলেছে। দয়ার ত্রিপলে কোনও মতে টিকে আছে ওদের সংসার।

আরও পড়ুন: বহু দিন গোপন ছিল দাম্পত্য, বিয়ের পরেও একসঙ্গে একাধিক পুরুষের প্রেমে পড়তে ভালবাসেন রাধিকা

বুঝলাম, আমপান সব ওড়ালেও বাংলা থেকে ওড়াতে পারেনি ‘সহানুভূতি’ শব্দটা। দলমত রাজনীতি ধর্মের উর্ধ্বে উঠে হাজার হাজার হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর্তের সেবায়। বেশ করেছে তারা ত্রাণের সেল্ফি দিচ্ছে। এরা হাগুমুতু করলেও সেল্ফি দেয়। এদের ভোটে দাঁড়াবার ধান্দা নেই, নাম কামাবারও তাল নেই। অন্যের পিছনে কাঠি না করে নিজের ভাল কাজের ছবি পোস্ট করে এরা! বেশ করে। এই গরমে শহর থেকে চোখে একটা সানগ্লাস এঁটে রকস্যাক কাঁধে নিয়ে ম্যাটাডরে খাবার আর ত্রাণসামগ্রী চাপিয়ে যাঁরা রোজ ছুটছেন গ্রামের দিকে, স্যালুট তাঁদের! এঁরা বিজ্ঞ না হলেও স্পষ্ট বুঝেছেন, এত বড় বিপর্যয়ে মানুষের পাশে মানুষ না এগিয়ে এলে কোনও সরকারের একা ক্ষমতা নেই এ ধাক্কা সামলাবার।

আমরাও যাচ্ছি, ছবি আমিও দিচ্ছি। বেশ করছি। যদি সরকারি সেন্সর বোর্ডের মতে আমাদের অন স্ক্রিন সিগারেট-মদ খাওয়ার দৃশ্য দেখে দর্শক সংক্রমিত হতে পারেন, তা হলে আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়াবার ছবি দেখেও এই সৎ সংক্রমণ হোক! মানুষের পাশে দাঁড়ান মানুষ। যাঁরা এই সব নিয়ে কূটকচালি করেন, তাঁদের নামে পাড়ার মোড়ে মূর্তি হোক!

শুধু আমরা কয়েক জন নয়, সাহায্যে নেমেছেন টিভি আর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নানান লোকজন। কেউ প্রকাশ্যে আসছেন,কেউ অর্থসাহায্য করছেন আড়ালে থেকে। এনজিও ছাড়া ত্রাণ দিচ্ছেন, অনুদান দিচ্ছেন একক মানুষরা নিজের ইচ্ছায়।

তবে সেই সব রাজনৈতিক আহাম্মকদের প্রণাম, যাঁরা গরিব সেবার নাম করে, ২০২১-এর বিধানসভার ঘেঁটু পুজোর মন্ত্র জপছেন মনে মনে!

পায়ের ধুলো নিতে চাই সেই সব মানুষের, যাঁরা বাড়ি বসে এসি চালিয়ে ভুরু কুঁচকে নিউজ চ্যানেলে রাজ্যের সব খবর জানার পরেও, গরিব মানুষের জন্য এক টাকাও সাহায্য করেননি।

সব হুজ্জুতির মধ্যেও কিন্তু, কিছু মানুষকে একটু কম দেখছি! যাঁরা এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে রাজপথের পিচ গলিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের দুঃখে, তাঁদের একটা বড় অংশ ত্রাণের কাজে অদৃশ্য কেন বুঝলাম না! তেমন মিডিয়া নেই বলে? নাকি, করোনা কামড়ে দিলে নিজের মরে যাওয়ার ভয়? কে জানে বাপু!

সেই সব বুদ্ধিজীবীর জয় হোক, মানুষের দুঃখে তাঁরা বিনা দুধে দার্জিলিং চা খান ‘সাতে পাঁচে না থাকা’ বারান্দা-কাকুদের সঙ্গে সমালোচনার অ্যাপার্টমেন্টে বসে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement