অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ ও দেবশ্রী রায়
দেখতে দেখতে ২৮ বছর পার! আজ ১৯ এপ্রিল! এই তারিখ বাঙালির কাছে অদ্ভুত ভাবে ২৮ বছর পরেও স্মরণীয়। অপর্ণা সেন, আমার আর ঋতুপর্ণ ঘোষের দৌলতে। ১৯৯৮-এ মুক্তি পেয়েছিল আমাদের ছবি উনিশে এপ্রিল। ঋতুপর্ণ তখন এক দম নতুন। ওকে চিনতাম না সে ভাবে। এক বিয়েবাড়িতে প্রথম দেখা। সেখানেই ঋতুর প্রথম সম্বোধন, ‘‘আমি একটা ছবি করছি। তোকে কিন্তু অভিনয় করতে হবে। রিনাদিও আছে। অভিনয়, প্রযোজনা দুটোই করবে।’’ প্রথম দেখায় তুই সম্বোধন! শুনেই কানে খট করে বেজেছিল। পরে রিনাদি ওরফে অপর্ণা সেন জানিয়েছিলেন, ঋতু সবাইকেই প্রথম দেখায় এ ভাবেই আপন করে নেয়।
বিয়ে বাড়িতে আর কী বলব? বলেছিলাম, চিত্রনাট্য শোনাও। পছন্দ হলে অবশ্যই করব। চিত্রনাট্য শুনে বড় ভাল লেগেছিল। মা-মেয়ের এ রকম গল্প তখনও পর্যন্ত বাংলা ছবিতে হয়নি। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ঋতু তখন বলল, ‘‘দেখ, আমি কিন্তু বেশি পারিশ্রমিক দিতে পারব না। কারণ, প্রযোজক রিনাদি, স্পন্দন ফিল্মসের রেণু রায় আর ঋতুপর্ণ ঘোষ। আরআরআর মিলে প্রযোজনা করছি।’’ ভাল ছবি পেলে পারিশ্রমিক নিয়ে কোনও দিনই মাথা ঘামাইনি। সে দিনও ঋতুর অনুরোধ মেনে নিয়েছিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা শ্যুট শুরু করলাম। রেণুদির বাড়ির পাশে একটি ফাঁকা বাড়ি ছিল। ওটাকেই সাজিয়ে গুছিয়ে সেট বানিয়ে নিল ঋতু। টানা শ্যুট চলল সেখানে। ভীষণ হই-হুল্লোড় করতে করতে নির্দিষ্ট দিনে কাজও শেষ হয়ে গেল। তার পরেই ঋতুর ফোন। বিমর্ষ গলায় বলল, ‘‘চুমকি সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। সাত দিনের কাজ প্রযুক্তির কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’ এ দিকে বাড়িটা প্রমোটার ভেঙে ফেলবেন। তিনি তো আর শ্যুটের সময় দেবেন না। কী হবে? ঋতুর ফের অনুরোধ, ‘‘তুই আর রিনাদি তারকা। তোরা গিয়ে যদি অনুরোধ জানাস প্রমোটার হয়তো মেনে নেবেন।’’ পরিচালকের কথামতো আমরা গেলাম কথা বলতে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালাম। সাত দিনের শ্যুট আবার নতুন করে হল।
তত দিনে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যদিও ছবির কথা যখন ঋতু প্রথম বলেছিল তখনও আমার আর বুম্বার (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) বিয়ে হয়নি। ১৯৯৮-এ ‘উনিশে এপ্রিল’ মুক্তি পেল। জাতীয় পুরস্কারও পেল। সেই সময় একটা কথা কানে এসেছিল, আমার বিয়েটা নাকি পয়া! সেই জোরেই বিয়ের পরেই এই বিশেষ সম্মানলাভ আমার। সে দিন কোনও কথা বলিনি। ২৮ বছর পরে বলছি, ছবিটা করতে করতেই অপর্ণা সেন মানে রিনাদি বলেছিল, ‘‘দেখিস, আমাদের এই ছবি জাতীয় সম্মান পাবে।’’ পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘কী করে বলছ?’’ রীণাদির দাবি, ‘‘গল্প, অভিনয়, পরিচালনা--- সব এত উঁচু মানের যে সম্মানিত হতে বাধ্য এই ছবি।’’ অপর্ণা সেনের কথা মিলে গিয়েছিল। অভিনয়ের জোরেই আমি জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী।
রিনাদির কথা শুনে মনে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। নামী পরিচালক। এত বড় কথা বলছেন! তবে পুরস্কারের আশা সত্যিই তখন করিনি। মন দিয়ে কাজ করে গিয়েছি। জাতীয় পুরস্কারের তালিকা ঘোষণার পরে আমি অবাক! সত্যি সত্যিই পুরস্কৃত হচ্ছে 'উনিশে এপ্রিল'। নির্দিষ্ট দিনে পুরস্কার আনতে দিল্লি গেলাম। মঞ্চে অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচালক চেতন আনন্দ। তিনি জুরি সদস্যদের অন্যতম। আমার হাতে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেওয়ার সময় চেতন জানান, বিচার করার জন্য তাঁকে ৩৪৫টি ছবি দেখতে হয়েছিল। তার মধ্যে সেরা 'উনিশে এপ্রিল'! চেতন আার অভিনীত চরিত্র থেকে চোখ ফেরাতে পারেননি! শুনে আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল। নানা পাটেকর সে দিন বলেছিলেন, ''দেবশ্রী ভাগ্যবান। তাই চেতনের থেকে এত বড় প্রশংসা পেলেন। তারকা পরিচালক চট করে কারওর প্রশংসা করেন না।''
আরও একটা ঘটনা আজও মনে পড়ে। ছবি-মুক্তির পরে পরেই একটি ফোন। ধরতেই এক তরুণীর গলা। প্রথম কথাই ছিল, ‘‘অজস্র ধন্যবাদ!’’ হতবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘ধন্যবাদ জানানোর মতো কী করলাম?’’ মেয়েটি বলেছিল, ‘‘আমার মা-ও চাকরি করেন। কর্পোরেট দুনিয়ায়। সদা ব্যস্ত। আমায় একটুও সময় দিতে পারেন না। এই নিয়ে আমার মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ। আপনার ছবি দেখে সেই ভুল ধারণা মিটেছে। মায়ের পেশাদারিত্বের কারণে আমি গর্বিত। মায়ের সঙ্গে মিল হয়ে গিয়েছে। সবটাই হল আপনার কারণে।’’