মায়ের জন্য কলম ধরলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
কোভিড-১৯ এনেছে অনেক আঘাত, কাটাছেঁড়া ও ভয়ে ভরা এক সময়। আমরা বুঝতে পারছি না কী হতে পারে এর ভবিষ্যৎ! রোজই নতুন আবেদন, নতুন কর্মসূচি, নতুন নিষেধাজ্ঞা, স্বাস্থ্য বিভাগের আশ্বাস। সত্যি আমাদের জীবনটা আবার আমরা একই রকম ভাবে ফিরে পাব? অবশ্য একই রকম ভাবে আর ফিরে পেতে চাইও না। কারণ এই সময়টা আমাদের সবাইকে অনেক বড় সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে, অনেক উত্তরও। আমরা শুধু ছুটে বেড়াতাম। কত দিন আমরা নিজের সঙ্গে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কত দিন আমরা ভেবে দেখিনি। আজ সে সব জরুরি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা স্বীকারোক্তি দিচ্ছি।
এই জীবনটাকে আমরা কীভাবে দেখেছি এত দিন? আমরা কি সঠিক ছিলাম? হঠাৎ খবর পেলাম যে আমার বান্ধবী আর নেই। কোভিড তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে।এরকম বহু মানুষের কাছের মানুষজন হারিয়ে গেছে। কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবীর স্বামী চলে গেছে। মানুষ চলেই যাচ্ছে। চিকিৎসা করার সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছে না।
কোথায় রাখব জীবনের এই নির্মম সত্যকে? আমাদের জীবদ্দশায় যে এরকম ঘটনা দেখতে হবে সত্যি কোনওদিন ভাবিনি। অনেক বছর আগে যে অতিমারি এসেছে— প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু বা কলেরা তার বইয়ে পড়েছি, গুগলে দেখেছি বা ছোটপর্দায়। মহামারি দেখব নিজের চোখের সামনে, সত্যি কোনওদিন ভাবিনি। এই মহামারি যেন শুধু রোগ বা মৃত্যু নয়, এই মহামারি যেন আমাদের জীবনের অন্তরের মহামারি। এই অন্তরকে যত ক্ষণ না আমরা ঠিক করতে পারছি, এই সচেতন বা অসচেতন জায়গাটাকে আমরা কোনও একটা শান্ত জায়গায় না আনতে পারছি, তত দিন কিন্তু এই যন্ত্রণা, এই যুদ্ধ নিজের সঙ্গে নিজের করেই যেতে হবে। শুধু আমার জীবিকা না, আমার মনে হয় যে-কোনও মানুষের জীবিকা অর্জনের জন্য যে সাংঘাতিক লড়াই চলছে, যে যুদ্ধ চলছে, সেটা কি থামবার? সেটার যে পরিণতি হচ্ছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিরাট একটা অর্থনৈতিক ধস। তার মধ্যেই আবার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ধ্বংস ধ্বংস ধ্বংস! প্রকৃতি আমাদের মুছে দিতে চাইছেন যেন।
প্রকৃতি যেমন তাঁর ওপরে অত্যাচারের শোধ নিচ্ছে, সেরকম মানুষও মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমরা নিজেরাই প্রকৃত মানবিকতা থেকে সরে এসেছিলাম। কিন্তু আজকে তো মানবিকতা ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই। ঐশ্বর্য, ধন, প্রত্যাশা সবই একটা ভাইরাস নিয়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে থাকছি এই ছোট্ট মানুষগুলো যাদের ভেতরে একটা মন, একটা বিবেক আছে। এই মন আর বিবেকটা যত ক্ষণ না আমরা ঠিক করতে পারব তত ক্ষণ বোধহয় এই সমাজে কোনওরকম বদল আসবে না। সামাজিক কোনও পরিকাঠামোর পরিবর্তন হবে না। আমাদের সবাইকে জীবনে কোথাও না কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে হবে। থামতে হবে। বুঝতে হবে। ভাবতে হবে। দেখতে হবে। কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মীর পোস্টে পড়ছিলাম যে, একটু দাঁড়িয়ে থাকলে কী হত? একটু আকাশটা দেখলে কী হত?একটু জলটা অনুভব করলে কী হত? একটু নদীর ধারে হাঁটলে কী হত? একটু বাতাসটা গায়ে মাখলে কী হত?
মায়ের সঙ্গে অভিনেত্রী
মৃদুমন্দ বাতাসকে ভুলে গিয়ে আমরা শুধু ছুটছি... শুধু ছুটছি। আমরা কোলাহলের মধ্যে ডুবে যেতে চাই। কিন্তু না, আমাদের জীবনটা আসলে অন্য। জী-ব-ন! এই জীবন কথাটার মধ্যে যে কত বড় একটা মানে লুকিয়ে আছে সেটা ভুলেই গেছিলাম। আজকে সবকিছুই তো স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের উৎসব, ভালবাসা, আদান-প্রদান। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারছে না কেউ। এক দেশে মা-বাবা থাকেন, এক দেশে সংসার। দুই দেশের বড় ব্যবধানের মধ্যে কত মানুষ আটকে গেছে। মানুষ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে সীমান্তে। দেশের ভেতরেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেমেয়ের থেকে দূরে কত মা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছেন, কত বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছেন। আত্মীয়-পরিজনের কাছে কেউ যেতে পারছি না। এই তো সেদিন আমার প্রিয় বান্ধবীর মা চলে গেলেন। সে যেতে পারেনি। এত নিষেধাজ্ঞা চারদিকে! হতাশায় চলে যাচ্ছে অনেকে। আমার মা রোজ কাঁদে টেলিফোনে, “তোদের কি আর দেখতে পাব না?” এরকম অনেক মা-ই কাঁদছেন। অনেক বাবাই হাহাকার করছেন। আমার ছেলে বাইরে পড়তে গেছে, সে আসতে পারছে না। কিন্তু এটাই কি একমাত্র সত্যি? মানুষের প্রচণ্ড কষ্ট চলছে। হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই। হাহাকার। আবার চিকিৎসা চলাকালীন হঠাৎ মারা যাচ্ছেন অনেকে। বলতে গেলে চোখে জল আসে। জানি না এর শেষ কোথায়।
কিন্তু কোথাও না কোথাও আমাদেরকে একটা পরিবর্তনের সামনে দাঁড়াতে হবে। কী সেই পরিবর্তন, সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না। সমাজের কী সেই আমূল পরিবর্তন, হয়ত অনেক বড় মানুষেরা বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয় জীবনের দৌড়ে আমরা যন্ত্রকে বড্ড বেশি প্রায়োরিটি দিয়ে ফেলেছিলাম।
বিনোদনের জগৎ আজ নিদারুণ সংকটে। যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তারা হয়তো চালিয়ে নিতে পারছে। কিন্তু যাদের নেই? তাদের অবস্থা খুব খারাপ। তাদের জন্য কিছু করা নিশ্চয়ই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি আমার মতো করে চেষ্টা করছি। অনেকেই করছেন। আমার মনে হয় যে আমাদের প্রশাসন, সরকার যথেষ্ট চেষ্টা করছে, কিন্তু তারপরেও বোধহয় আমাদের কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। আমরা কেউ কমিউনিটি কিচেন করেছি। আমরা কেউ টিকার ব্যবস্থা করেছি। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি হয়েছে। সেবামূলক নানা কাজ চলছে। সবই হচ্ছে, আবার এ কথাও ভাবি, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের এই চেষ্টায় কতদূর কী হবে, বড় কোনও বদল আসা দরকার। ভাবনার পরিবর্তন আসা দরকার। সব ছাপিয়ে মনে হানা দিচ্ছে এক অমোঘ প্রশ্ন— এটাই কি জীবন? আমাদের এতদিনের চেনা জীবনটা কি একেবারেই শেষ? কিছুই কি নেই বাকি?
আর একটা জিনিস কষ্ট দেয়, অনেক বড় ব্যবধান তৈরি হয়ে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের। দেখা না হওয়া। কোথাও না যাওয়া। বিশেষত প্রবীণ মানুষেরা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। দিনের পর দিন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। এ দিকে অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত যারা, তাদের চিকিৎসা নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। সবকিছু নিয়ে আমাদের জীবনটা একটা পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃত্যুপুরী
তবে এই কোভিড পরিস্থিতি আমাদের একটা কথা শিখিয়েছে যে, জীবনে যা আছে তাকে উপভোগ করতে শেখো। যেটা নেই, যেটার জন্য তোমরা দৌড়োচ্ছ, সেটা কিন্তু ক্ষণিকের। সেটা পেতেও পারো, না-ও পেতে পারো, কিন্তু যেটা আছে সেটা যদি উপভোগ না করতে পারো তা হলে সেটাও থাকবে না। এইটা আমাদের একটা বড় উপলব্ধি।
পরিবেশবিদ, পরিবেশপ্রেমীরা বরাবর বলে আসছেন, প্রকৃতিকে ভালবাসো। কিন্তু সত্যিই কি আমরা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ভেবেছি? প্রকৃতিকে আমরা অন্য চোখে দেখেছি। প্রকৃতির মূল্য ভুলেছি। যে প্রকৃতি আমাদের আলো দেয়, বাতাস দেয়। আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় শক্তি দেয়। তাকে আমরা নাই-বা নষ্ট করলাম। তাকে ভালবেসেই আমাদের বাঁচতে হবে।
আমাদের জীবনে ছোটবেলায় কত কিছু মূল্যবান ছিল। সেই যে একটা মায়ের রান্না। বাড়িতে একটা কেক আসা। একটা খেলনা পাওয়া। একটা নতুন সাইকেল পাওয়া। প্রথম গাড়ি চড়া, প্রথম বাসে চড়া, প্রথম ট্রামে চড়া। প্রথম কিছু পাওয়ার সেই যে আনন্দ আজ আর কাউকে দিতে পারি না। সবকিছুই আছে সবার কাছে। সবাই সবকিছু জেনে গেছে, সবাই সবকিছু বুঝে গেছে। বাচ্চাদেরকে আজ পাওয়ার আনন্দ দিতে পারি না। প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কিন্তু বস্তুগত দিক এবং মানবিক অনুভূতির দিক, এই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। এর মধ্যেই আমাদের সৃষ্টিশীল থাকতে হবে। গান গাইতে হবে। সিনেমা তৈরি করতে হবে।
সিনেমা-হল বন্ধ। যারা সিনেমা-হল চালায় তাদের মধ্যে আজকে হাহাকার। কিন্তু মানুষ কী করে যাবে? মানুষ তো ভীত। আশা করব সব ঠিক করে দেবেন ঈশ্বর। আমাদেরও সঠিক হতে হবে। পাখির গান শুনতে হবে। আকাশ দেখতে হবে। জল ছুঁয়ে হাঁটতে হবে। মাটিকে স্পর্শ করতে হবে। মাটির শস্যকে ভালবাসতে হবে। পৃথিবীটাকে কেবল ভোগ নয়, আদরে আপন করে নিতে হবে। বুঝতে হবে পৃথিবীকে আমরা খুব কষ্ট দিয়েছি। এবার তাকে বাঁচাতে হবে। তা হলেই বাঁচব আমরা। বাঁচবে আমাদের শিল্প-গান-সিনেমা, আমাদের কীর্তি। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। ‘আমার’ ‘তোমার’ ‘ওদের’— এই ব্যাপারটা না, ‘আমাদের’।
এই লড়াই আমাদের।