বেঁচে থাক ভালবাসা। ঘরে জায়গা নেই তো কী হয়েছে! কার্নিসে ওই আটকে থাকা ঘুড়ির মতোই থাকুক না হয় সে। কার্নিস মানে বাড়ির বাইরের ওই ঢালটা। যেখানে ঝাপটায় ঝড়। তাণ্ডব নাচে বৃষ্টি। তবু মন বলে, ও ব্যাটা ঠিক সামলে দেবে জানালা।
তাই ঘুড়িও থাকুক। সঙ্গোপনে। নিশ্চিন্তে। কেউ না জানুক, বাড়ির মালিক জানবে ঠিক— ঘরে আর বাইরে মিলিয়ে বসত করে মোট কয়জনা। আর ঘুড়ির দায়িত্ব জানালার উপরওয়ালা কার্নিসের।
তিন পা গেলে গল্প রটে...
কিন্তু এ কেমন প্রেম, যাকে আড়ালে এমন টঙে টাঙিয়ে রাখতে হয়? হ্যাঁ, সাদা চোখে এ প্রেম পরকীয়াই। তবু যেন ছকভাঙা। কেউ বলবেন এ জুটি গোঁয়ারগোবিন্দ। কেউ বলবেন, বড্ড দেমাকি— যত্ত সব আদিখ্যেতা। নগরকীর্তনিয়া কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বোঝাতে চাইলেন, মানুষে মানুষে তফাত শুধু শিরদাঁড়ায় নয়, দৃষ্টিকোণেও। জীবনের দৃষ্টিকোণে। জীয়ন মিত্রেরও।
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা...
সেটা ছিল ‘প্রাক্তন’। ২০১৬-র ছবি। শিবপ্রসাদ-নন্দিতার হাত ধরে দীর্ঘ ১৪ বছরের নির্বাসন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটি। দু’বছরের মধ্যে ফের তাঁদের আনলেন কৌশিক। মুখোমুখি জীয়ন মিত্র আর শ্রীমতী সেন। উকিলের চেম্বারে মক্কেল।
কিন্তু এ কেমন উকিল? বাঁ চোখটা যে পুরো সাদা! বিকল কর্নিয়া জীয়ন মিত্রের। স্বামী পলাশ সেনের (কৌশিক সেন) রহস্যমৃত্যুর হদিস নিতে তবু সেই ‘খুঁতো’ কালো কোট পরা লোকটাকেই জীয়নকাঠি ভেবে জড়িয়ে ধরে শ্রীমতী। তরতরিয়ে এগোতে থাকে গল্প। চলতে থাকে মামলার খুঁটিনাটি খোঁজ। আর সমান্তরালে উকিল-মক্কেলের কাছে আসাও। চিত্রনাট্যই দেখিয়ে দেয়, ব্যক্তিগত জীবন আর পেশার মধ্যে সীমারেখাটা কেমন খড়ির গণ্ডির মতো। যা হাঁটতে হাঁটতেই মুছে যায়।
সকলেই আড়চোখে দেখে...
অনাহূত সম্পর্কের সঙ্গে আসে সন্দেহও। ছবিতে জীয়নের স্ত্রী রুমকির ভূমিকায় চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়। একটা সময় যে রুমকি দাপিয়েছে কোর্টরুম। স্বামীর কলারে পরস্ত্রীর সুগন্ধি টের পাওয়া তার কাছে খুব কি কঠিন? মিত্রবাড়িতে অশান্তির ঝড় তাই ঠেকানো যায় না।
ঝড় ওঠে সেনবাড়িতেও। যে দুর্ঘটনা ঘিরে রহস্য, তাতে পলাশেরই গাড়িতে ছিল শ্রীমতীর ভাসুর প্রীতম সেন। বেঁচে যায়, তবে সেই থেকে সে হুইলচেয়ারে। হঠাৎ জানা যায়, সে চলৎশক্তিহীন নয়। প্রশ্ন জাগে, তা হলে কি সে-ই খুনি?
রহস্যটা থাক। ছবিতে প্রীতমের ভূমিকায় পরিচালক নিজে। ক্যামেরার সামনেও তিনি যে কী খেল দেখাতে পারেন, হালে ‘বিসর্জন’-এর পরে ফের তা দেখালেন কৌশিক।
আর প্রসেনজিৎ? সকাল সকাল হল-ভরানো দর্শকেরই একাংশ বললেন— ‘ময়ূরাক্ষী’ তুমিই দিলে! ‘উৎসব’, ‘দোসর’, ‘প্রাক্তন’ পেরিয়ে প্রসেনজিতের এই ধ্রুপদী অথচ ছকভাঙা ব্যাটিং চোখেরও সুখ। অনবদ্য ঋতুপর্ণাও। জুটিটা কখন যে স্ট্রাইক বদলাচ্ছে, যেন টেরই পাওয়া যায় না। আবার ঘর-বাঁচানোর আকুতি সর্বস্ব হয়েও জীয়নের স্ত্রীর ভূমিকায় বলিষ্ঠ ছাপ রেখেছেন চূর্ণী। কৌশিক সেনের বিশেষ কিছু করার ছিল না। নবাগত সোহম মজুমদার বেশ প্রতিশ্রুতিমান।
আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি তবে আসল মুনশিয়ানা অবশ্য কৌশিকেরই। একটা থ্রিলারেই দিব্যি আড়াই ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারতেন তিনি। করলেন না। বরং সমান্তরালে নিয়ে এলেন একটা অন্য ঘরানার প্রেমও। সেটাও থ্রিলার। অথচ একটুও বিরক্ত করলেন না কাউকে।
দ্বিতীয় গল্পটাও তিনি যে ভাবে বললেন, পরকীয়ার এই দৃষ্টিকোণ নিয়েও বিতর্ক চলবে। ছবির সব গান অনুপম রায়ের সুরে। যার মধ্যে ‘আমি কি তোমায়’, ছবি পাতে পড়ার আগে থেকেই গোগ্রাসে গিলেছেন অনেকে।
আলাদা করে বলতে হয় গোপী ভগতের ক্যামেরার কথাও। আবেগের চুমুতে বন্ধ হয়ে যায় চোখ। সামনে তখন কিচ্ছুটি দেখা যায় না। এটা বোধ হয় ধ্রুব। কৌশিকের সেলাই মেশিনও চলল সেই তালেই। সাদা সর পড়ে যাওয়া যে চোখটা দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তা প্রায় এক বারও দেখালেন না পরিচালক।
প্রশ্নটা তবু থাকলই— আপাত উটকো প্রেমটাকে কেন সরিয়েই রাখতে হল? শুধুই কি প্লেটোনিক ভালবাসা দেখানোর তাগিদ?
শুধু এটুকুই বলার— দৃষ্টিকোণ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির ফারাকেও যে কী ভাবে বদলে যেতে পারে বন্ধুত্ব, ভালবাসা আর সম্পর্কের মানে, ‘সিনেমাওয়ালা’ কৌশিক সেটাও দেখিয়ে দিলেন চোখে আঙুল দিয়ে।