১৯৮৫-এর ২২ জুলাই। বেঁচে থাকার লড়াই শেষ। আগুনে প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিথর। টলিউডের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল, মাত্র ২৭-এ প্রতিভা ঝরে গেল। মহুয়া রায়চৌধুরী। মৃত্যুর আগে যাঁর হাতে নাকি ২২টি ছবির কাজ ছিল! সেই সময়ের সংবাদমাধ্যম ঘাঁটলে জানা যায়, ২২টির মধ্যে মাত্র চারটি ছবির কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন। সাতটি অর্ধসমাপ্ত। বাকি ১১টা ছবি সই করেছিলেন শুধু।
সকাল থেকে স্টুডিয়োপাড়া নিস্তব্ধ। মহুয়ার দেহ পৌঁছতেই চত্বরে তাঁর প্রিয় পোষ্যদের ভিড়! কী ভাবে পথকুকুরেরাও বুঝেছিল, তাদের ডেকে খাবার দেওয়ার মালকিন চিরঘুমে আচ্ছন্ন। আর তিনি আদর করে ডাকবেন না। এক পাশে দাঁড়িয়ে শোকস্তব্ধ তাপস পাল, দেবশ্রী রায়। সন্তান হারানোর ব্যথায় মূক পরিচালক তরুণ মজুমদার। তিনি মহুয়ার অভিনয় জীবনের ‘জন্মদাতা’। তাঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে প্রয়াত নায়িকার আত্মপ্রকাশ। তাঁকে নিজের হাতে গড়েছিলেন সন্ধ্যা রায়। মহুয়ার মৃত্যুতে যিনি ভেঙে পড়ে জানিয়েছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে অভিনেত্রী বড্ড বেশি ভালমানুষ ছিলেন। ওঁর ভালমানুষির সুযোগ ইন্ডাস্ট্রি নিয়েছে।
আশ্চর্য বিষয়, মহুয়ার মৃত্যুর খবর জানার পরেও টলিউডে শুটিং বন্ধ হয়নি। খবর, সে দিন ‘আশীর্বাদ’ ছবির পরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায়, প্রযোজক রথীন মজুমদার টানা শুটিং করেছিলেন বিরাটির এক বাগানবাড়িতে। এই ছবির নায়িকা মহুয়া। তাঁর স্মৃতি জীবন্ত থাকতে থাকতেই নাকি দর্শকদের কাছে সে ছবি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা, যাতে বক্স অফিসে ঝড় তোলে ছবিটি!
এই ইঁদুরদৌড়ই কি কেড়ে নিল প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে? সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি সে কালের চলচ্চিত্র সাংবাদিকেরা। সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, মহুয়া মুঠোভর্তি ছবি করলেও তাঁর পারিশ্রমিক নাকি ৩০ হাজারের বেশি ছিল না। অনেক ছবিতে তাঁকে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকেও নাকি কাজ করতে হয়েছে! অভিনয় ভালবাসতেন বলে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে পরিচালক-প্রযোজকেরাও তাঁকে নিঙড়ে নিতেন।
পেশাজীবনের এই না-পাওয়ার যন্ত্রণা আরও তীব্র ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েনে। যে তিলক চক্রবর্তীকে তিনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তখন সম্পর্ক অবনতির পথে। অশান্তি এক এক দিন এমন আকার নিত যে, স্বামীর মারের দাগ লুকিয়ে নাকি শট দিয়ে হয়েছে মহুয়াকে! সে কথা তিনি বলে ফেলেছিলেন রঞ্জিত মল্লিককে। দৃশ্য অনুযায়ী, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী রঞ্জিত ক্রাচ দিয়ে মারবেন নায়িকাকে। শট দিতে গিয়ে মারটা একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিল। শট শেষে মহুয়ার কাছে দুঃখপ্রকাশ করতেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘এর থেকেও বেশি জোরে মার খাওয়ার অভ্যেস আছে রঞ্জিতদা।’’
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তিলকের সঙ্গে আলাপ মহুয়ার। তিলক গাইতেন। মহুয়া নৃত্যশিল্পী। সদ্য বড় হচ্ছেন দু’জনে। মহুয়া সে দিন শিল্পীর অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে তিলককে ব্যাঙ্কে চাকরি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। চাকরি পাওয়ার পরেই বিয়ে করবেন ঠিক করেন তাঁরা। কিন্তু বেঁকে বসেছিলেন দুই পরিবারের কর্তাই। মহুয়ার বাবার ভয়, ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ছেলের বাবা নায়িকা বৌমাকে মানবেন না। শেষে তাঁরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। অন্যতম সাক্ষী রত্না ঘোষাল। বিয়ের উদ্যাপন উত্তমকুমারের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে।
দাম্পত্যের প্রথম তিন বছর দারুণ সুখের। সারা ক্ষণ আনন্দে মেঘমুলুকে নবদম্পতি। ওই সময়ে গোলা ওরফে তমাল চক্রবর্তীর জন্ম। ছেলেকে খুব ভালবাসতেন মহুয়া। কিন্তু কাজের কারণে সঙ্গ দিতে পারতেন না। ক্রমশ, স্ত্রীকে নিয়ে সন্দেহ বাড়তে থাকে তিলকের। কারণ, মহুয়াও ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তিনি তখন মদ ধরেছেন। পেটে পানীয় গেলেই উগ্র। তিলককে নিয়ে মাঝরাতে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। চাকুরে স্বামীকে পরের দিন অফিস যেতে হবে, মনেই থাকত না তাঁর! শেষের দিকে তিলক সঙ্গ দিতে না পারলে তিনি নাকি একের পর এক নায়কের বক্ষলগ্না। শোনা যেত, সেই তালিকায় কখনও তাপস পাল, কখনও অমোল পালেকর। এত কিছুর মধ্যেও ক্যামেরার সামনে কিন্তু মহুয়া নিখুঁত অভিনেত্রী।
খবরের কাগজ তোলপাড় মহুয়ার বেসামাল জীবনযাপনের কিস্সায়। সেই সব খবর পড়ে আরও বিরক্ত তিলক। সঙ্গে মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরীর কানভাঙানি। তাঁর মদের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন নায়িকা কন্যা। সেই বিষ ছুঁয়েছিল একমাত্র সন্তান গোলাকেও। গুঞ্জন, বাবা আর দাদু মিলে তাকে বোঝাতে পেরেছিলেন, তার মা কোনও দিক থেকেই ঠিক নয়, বেপথু। একটু একটু করে তাঁরা মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন সন্তানকে। শোনা যায়, মৃত্যুশয্যায় ছেলের নাম ধরে বান্ধবী রত্না ঘোষালের কাছে মহুয়ার আর্তি, তাঁর গোলাকে যেন দেখেন তিনি। গোলাও কি মায়ের জন্য একই ভাবে হাহাকার করেছিল? অভিনেত্রীর মৃত্যুর ৩৯ বছর পরে প্রযোজক রানা সরকার মহুয়ার জীবন নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন। পরিচালনায় সোহিনী ভৌমিক। অনুমতি নিতে প্রযোজক দেখা করেছিলেন মহুয়ার ছেলের সঙ্গে। তখনই জানতে পারেন, প্রয়াত নায়িকাকে নিয়ে পরিবারের প্রত্যেকে এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে, ভুলেও তাঁরা মহুয়া রায়চৌধুরীর নাম মুখেও আনেন না!
তাঁকে নিয়ে গুঞ্জনের আঁচ মহুয়ার কানেও পৌঁছত। তিনি বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, যতটা রটেছে ততটাও ঘটেনি। তিনি বদমেজাজি নন। কাজে ফাঁকি দেননি কখনও। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি। কোনও নায়ককে অকারণ বিরক্ত করতেন না। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি বলে, তৎকালীন নায়িকাদের মধ্যে তিনি বেপরোয়া, একরোখা, ঠোঁটকাটা, জেদি এবং দুঃসাহসী। তার ছাপ পড়েছিল ব্যক্তিজীবনেও।
কেন এমন হয়ে গিয়েছিলেন পর্দার ‘পারাবত প্রিয়া’? সেই সময়ের ছায়াছবির ইতিহাস বলছে, মহুয়া বিব্রত ছিলেন নিজের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও। কথিত, নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী নাকি তাঁর পালক পিতা। দুই বোন আর এক ভাই তাঁরা। দিদি শান্তা, বোন শিপ্রা। শিপ্রাই পরে মহুয়া। দাদা পিনাকী বরাবর নেপথ্যে। এঁরা মহুয়ার নিজের ভাই-বোন? আজও অজানা। মেধাবী মহুয়া কোনও দিন নাকি স্কুলের পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। সেই তিনিই স্কুলের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার আগে পড়া ছেড়ে অভিনয়ে। বাবার নির্দেশে। ছোট থেকেই নাচের অনুষ্ঠান করতেন। অর্থাৎ, ‘শৈশব’ বলে কিছুই ছিল না তাঁর। মহুয়া যেন তাঁর বাবার অর্থ উপার্জনের যন্ত্র!
এমনও দিন গিয়েছে, তিন শিফটে শুটিং করে বাড়ি ফিরে দেখেছেন, বাবা নেশায় চুর। তাঁর জন্য রান্না নেই, খাবার নেই। উল্টে তিনি ক্লান্ত মেয়েকে ভালমন্দ রান্নার হুকুম করেছেন। দিনের পর দিন অত্যাচারে, অবিচারে জর্জরিত মহুয়া তাই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে বেপরোয়া, বিদ্রোহী। জোর করে দামি গাড়ি কিনেছেন রাতবিরেতে ইচ্ছেমতো হাওয়া খেতে বেরোতে পারবেন বলে। ওই সময় থেকেই তিনি আত্মহত্যাপ্রবণ। শোনা গিয়েছে, বাবা বিয়েতে বাধা দেওয়ায় অভিমানী মেয়ে গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিলেন। যত বার তিলকের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, তত বার তিনি হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন। শেষে জ্বালা ভুলতে দিনরাত নেশায় ডুব দিতেন।
অভিনয় দক্ষতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই ভিতরে ভিতরে নাকি ফুরিয়ে যাচ্ছিলেন মাত্র ২৭-এর মেয়েটি। চোখমুখে ক্লান্তি, অত্যাচারের ছাপ। তিলককে ছাড়তেও পারেন না, ভুলতেও পারেন না! উল্টে সব পুরুষের মধ্যে কেবল তাঁকেই খোঁজেন। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দিন মহুয়ার সকাল শুরু মদ্যপান দিয়ে। খবর, রত্না ঘোষালের বাড়িতে গিয়ে মদ্যপান করতে চেয়েছিলেন। অভিনেত্রীর বাড়িতে পানীয় ছিল না। মহুয়া পানীয় আনিয়ে পান করেন। সেখান থেকে যান প্রয়াত পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর বাড়িতে। সেখানেও পানাহার চলে। এ-ও জানা যায়, অঞ্জনের বেহালার বাড়ির এক তলাতেই নাকি মহুয়া-তিলকের সংসার। এর পর নীচে নিজের বাড়িতে নেমে আসেন তিনি। মহুয়া তখন সম্পূর্ণ বেসামাল!
মহুয়া অগ্নিদগ্ধ, খবর ছড়াতেই নানা প্রশ্ন উঠে এসেছিল টলি-মহল্লায়। তখন কি তিনি গায়ে আগুন দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন? তিলক নাকি জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন, ছেলের দুধ গরম করতে বসেছিলেন মহুয়া। স্টোভ থেকে আগুন ধরে যায়। তা-ই যদি হবে, তা হলে পিছন থেকে গায়ে আগুন লাগল কী করে? সকাল থেকে যিনি মদ্যপান করেছেন, তিনি রান্না করতে কতটা সক্ষম? বেসামাল মহুয়াকে কেন পরিবারের কেউ আগুনের কাছে যেতে নিষেধ করেননি? মহুয়ার বাবা, স্বামী— কেউই তাঁর উপরে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই মৃত্যু কি তারই ফলাফল? রটেছিল, নীলাঞ্জনের লোভের আওতা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মহুয়া। তিলকের শাসনের বাইরেও। ফলে, মহুয়া নাকি ক্রমশ তাঁদের অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
প্রমাণের অভাবে পুলিশি তদন্ত এক সময় থেমে গিয়েছে। ৩৯ বছর পরেও তাই মহুয়া রায়চৌধুরীর মৃত্যু রহস্যাবৃত। ১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুদিনটি ছিল সোমবার। প্রকৃতি কেঁদেছিল তাঁর জন্য। আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি হয়েছিল। এক প্রতিভার অকালমৃত্যুতে আক্ষেপ করেছিল টলি-পাড়া। তাঁর মৃত্যুর পর একটা সংলাপ কানে বেজেছিল মহুয়া-ঘনিষ্ঠদের। বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘আশীর্বাদ’-এ নায়িকার মুখে “আশিস, আমি ভাল নেই” সংলাপ শুনে তৎকালীন টলিউডের বহু গণ্যমান্যের দাবি, ছবির মধ্যে দিয়েই যেন নিজের পরিস্থিতি জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সিনেবোদ্ধাদের দাবি, মহুয়ার এক সত্তা নাকি চেয়েছিল যশ-অর্থ-খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে মোড়া ভোগসর্বস্ব জীবন। আর তাঁর ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ সত্তার নাকি চাওয়া ছিল, ‘চাই না কারও দয়া, যাচি প্রিয়র আঁখিজল, একটু দুঃখে অভিমানে নয়ন টলমল’...!