‘স্কুপ’ সিরিজ়ে সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন করিশ্মা তন্না। ছবি: সংগৃহীত।
সাংবাদিকতার প্রতি ভালবাসা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এক জন সাংবাদিককে কী কী করতে হয়, সেটা শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া খবর পড়ে বা দেখে সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুমান করা বেশ কঠিন। ‘সোর্স’, ‘এক্সক্লুসিভ’, ‘পেজ ওয়ান’ এবং ‘বাইলাইন’-এর আকর্ষণে সাংবাদিক কখনও কখনও ক্ষমতার কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। আবার কখনও সেই ক্ষমতাই তাঁর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায়। হনসল মেহতা তাঁর সাম্প্রতিক ওয়েব সিরিজ় ‘স্কুপ’-এ এমনই এক মহিলা ক্রাইম রিপোর্টারের জীবনকে তুলে ধরেছেন, যার লড়াইয়ের সহযোদ্ধা হয়ে উঠতে দর্শককে খুব বেশি চেষ্টা করতে হয় না।
জাগ্রুতি পাঠক (অভিনয়ে করিশ্মা তন্না) মুম্বইয়ের এক প্রথম সারির সংবাদপত্রের ক্রাইম রিপোর্টার। অপরাধ সংক্রান্ত খবর সংগ্রহে পুলিশ থেকে শুরু করে অপরাধ জগৎ সঙ্গে তার সাবলীল যোগাযোগই জাগ্রুতিকে সহকর্মীদের কাছে ঈর্ষণীয় করে তুলেছে। সব কিছুই ঠিক চলছিল। কিন্তু প্রতিযোগী সংবাদপত্রের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার জয়দেব সেনকে (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) গ্যাংস্টাররা হত্যা করার পর জাগ্রুতির জীবন ‘নরক’-এ পরিণত হয়।
বাস্তব থেকে সিরিজ়ের গল্প নিয়েছেন হনসল এবং ম্রুন্ময়ী লাগু ওয়াইকুল। মুম্বইয়ের ক্রাইম রিপোর্টার জিগনা ভোরার লেখা ‘বিহাইন্ড বারস্ ইন বাইকুল্লা: মাই ডেজ় ইন প্রিজ়ন’ বইটি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিরিজ়। একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক। সময়টা ২০১১ সাল। মুম্বইয়ের বর্ষীয়ান ক্রাইম রিপোর্টার জ্যোতির্ময় দে-কে প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে একদল আততায়ী। হত্যার দায় স্বীকার করেন মাফিয়া ছোটা রাজন এবং দাবি করেন জ্যোতির্ময়ের খুনে জিগনাই নাকি তাঁকে প্ররোচনা দেন। মুম্বই পুলিশ ‘অভিযুক্ত’ জিগনাকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় বিচার।
‘স্কুপ’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) হরমন বাওয়েজা এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
হনসল এই সিরিজ়ে মূলত তিনটি দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন— সাংবাদিকতার জগৎ, পুলিশের দ্বিচারিতা এবং অবশ্যই কারাগারের অভ্যন্তরীন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সব দিকই বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। অপরাধ সংক্রান্ত খবর সংগ্রহের পুরুষশাসিত জগতে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহিলা সাংবাদিককে ঠিক কী কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নিত্যদিন খবর সংগ্রহ করতে হয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ‘স্কুপ’।
জাগ্রুতি ‘সিঙ্গল মাদার’, ১০ বছর বয়সি এক ছেলে রয়েছে তার। এক দিকে চলছে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা। পাশাপাশি, দৈনন্দিন খবরের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই। জাগ্রুতির চরিত্রে করিশ্মা তন্নার অভিনয় পর্দা থেকে চোখ সরতে দেবে না। নিউজ়রুমের দাপুটে সাংবাদিক থেকে বাইকুল্লার জেলের মাটিতে পাতা বিছানা— এই সফরে তাঁর অভিনয় অনবদ্য। বিশেষ করে জেল পর্বে চরিত্রটির অসহায়তা এবং লড়াকু মনোভাব ফুটিয়ে তুলে করিশ্মা রীতিমতো চমকে দিয়েছেন।
‘স্কুপ’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে করিশ্মা তন্না। ছবি: সংগৃহীত।
সিরিজ়ে একগুচ্ছ চরিত্র রয়েছে। জাগ্রুতির সঙ্গে যারা জড়িয়ে রয়েছে, তাদের চরিত্রের অভিনেতারাও এই সিরিজ়ে সমান তালে ব্যাটিং করেছেন। জাগ্রুতির বস্ তথা সংবাদপত্রের সম্পাদক ইমরান (মহম্মদ জ়িশান আইয়ুব), জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ হর্ষবর্ধন শ্রফ (হরমন বাওয়েজা), জাগ্রুতির অফিসের সহকর্মী পুষ্কর (তন্ময় ধানানিয়া), তরুণ সাংবাদিক দীপা (ইনায়াত সুদ), প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রের সম্পাদক লীনা (তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়) প্রমুখ। তবে আলাদা করে নজর কেড়েছেন হরমন। দীর্ঘ দিন পর অভিনেতা দেবেন ভোজানি পর্দায় স্মৃতিমেদুরতা হাজির করেছেন। জাগ্রুতির মামার চরিত্রে তাঁর অভিনয় চোখে পড়ার মতো।
‘জুবিলি’র পর হিন্দি সিরিজ়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে বাড়তি কৌতূহল রয়েছে। তবে এই সিরিজ়ে তিনি অতিথি শিল্পীর ভূমিকায়। যতটুকু জায়গা পেয়েছেন, তাতে তিনি দুঁদে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন। আরও এক জনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন জৈমিনি পাঠক। সিরিজ়ের শেষ লগ্নে জাগ্রুতির আইনজীবী বশিষ্ঠের চরিত্রে তিনি একাই আদালতের দৃশ্যটি ধরে রেখেছেন।
সাংবাদিকতায় ‘ইঁদুরদৌড়’— এই বিষয় বলিউডের বিভিন্ন ছবিতে ঘুরেফিরে এসেছে। অনিল কপূর অভিনীত ‘নায়ক’, অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘রণ’ থেকে শুরু করে হালের কার্তিক আরিয়ান অভিনীত ‘ধমাকা’— তালিকাটি নিঃসন্দেহে দীর্ঘ। তবে এই সব ছবিতে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করা হলেও নির্মাতারা তার গভীরে প্রবেশ করেননি। সে দিক থেকে ‘স্কুপ’-এর গবেষকদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এখন সমাজমাধ্যমে একটা ‘লাইভ সেশন’ করে যে কেউ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারেন। সেখানে এক জন সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর ‘সোর্স’-এর সম্পর্ক, অফিসে সম্পাদককে নিয়মিত ‘স্টোরি ব্রিফিং’, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে মাঝরাতের সংস্করণে খবর ধরানোর তাগিদ এবং সর্বোপরি সঠিক খবরকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে একটি সংবাদপত্রের যে দলগত প্রয়াস, এই সিরিজ় স্বল্প পরিসরে আমার সেই অতীত স্মৃতিকে ফিরে দেখার সুযোগ করে দেয়।
ছ’টি পর্বে বাঁধা এই সিরিজ়ের দ্রুত গতি তার চলনে বাধা সৃষ্টি করেনি। তবে মূল গল্পের কিছু চরিত্রের নাম বদল করে কিছুটা ঝুঁকিহীন থাকতে চেয়েছেন নির্মাতারা। সিরিজ়ের শেষে জিগনা ভোরার ছোট্ট উপস্থিতি দর্শককে নিয়ে যায় বাস্তবের আঙিনায়। তাঁর মুখে, ‘‘আমিই কেন? এর উত্তরটা এখনও আমি খুঁজে পাইনি!’’ যেন আরও বেশি করে দর্শককে ধাক্কা দেয়। ‘স্ক্যাম ১৯৯২’ এর পর ‘স্কুপ’, পরিচালকের থেকে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা বহু গুণ বাড়িয়ে দিল।