গ্রহণ
(ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালনা: রঞ্জন চান্ডেল
অভিনয়: পবন, জ়োয়া, অংশুমান, ওয়ামিকা, তিকাম
৬.৫/১০
ভারতীয় ওটিটির জন্মলগ্ন থেকে যে থ্রিলারগুলি নজর কেড়েছে, তাদের মধ্যে বিষয়গত একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ‘সেক্রেড গেমস’ থেকে শুরু করে হালফিল ‘ফ্যামিলি ম্যান’ সিজ়ন টু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনও দেশের শুধুই বর্তমান নয়। দেশ-রাজনীতি-সময়ের বিবর্তনের মতো, দাঙ্গার ইতিহাসও বহমান। সাম্প্রদায়িক হানাহানির বীভৎসতা এখনও চিত্রনাট্যকারদের নতুন সৃষ্টি করতে উৎসাহ জোগায়। ডিজ়নি প্লাস হটস্টারের সিরিজ় ‘গ্রহণ’ তুলে ধরেছে ১৯৮৪ সালে সংঘটিত বোকারো শহরের শিখ-বিরোধী দাঙ্গা। তিন দশকের টাইমলাইনে সিরিজ়টি দেখাতে চেয়েছে, রাজনীতির আকাশে দাঙ্গার গ্রহণ হয় না। তার দাবদাহে এখনও ছারখার অগণিত সাধারণ মানুষ।
সত্য ব্যাসের লেখা জনপ্রিয় হিন্দি উপন্যাস ‘চৌরাসী’ অবলম্বনে রঞ্জন চান্ডেলের এই সিরিজ়। কমবেশি চল্লিশ মিনিটের আটটি পর্বে ২০১৬ এবং ১৯৮৪... দু’টি টাইমলাইনে গল্প বলা হয়েছে। রাঁচীর আইপিএস অফিসার অমৃতা সিংহের (জ়োয়া হুসেন) চোখের সামনে আগুন লাগিয়ে খুন করা হয় এক সাংবাদিককে। এ দিকে ২০১৬-র আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বোকারো দাঙ্গার তদন্তের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গড়ে তোলা হয়েছে এসআইটি। সিস্টেমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ অমৃতাকে দেওয়া হয় তদন্তের ভার। সাংবাদিক খুনের সূত্র ধরে অমৃতার ফোনে আসে এক দাঙ্গাবাজের ছবি, যার সঙ্গে তার বাবা গুরুসেবক সিংহের (পবন রাজ মলহোত্র) যৌবনের চেহারা মিলে যায়। তবে কি অমৃতার বাবা দাঙ্গার মুখ্য অভিযুক্ত? প্রথম পর্বে তোলা হয় এই প্রশ্ন। বাকি সাতটি পর্ব ধরে চলে, তদন্তের হাত ধরাধরি করে গুরুসেবকের অতীত এবং অমৃতার জীবনের সত্যির উন্মোচন। প্রতিটি পর্ব টানটান না হলেও, শেষ পর্ব অবধি কৌতূহল ধরে রাখে সিরিজ়টি।
উপন্যাস-নির্ভর বলে হয়তো সিরিজ়ের গল্পটি মর্মস্পর্শী। ইস্পাতের শহর বলে পরিচিত চুরাশির বোকারোয় বিভিন্ন ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক আখের গোছানোর মতলবে স্থানীয় ইউনিয়ন নেতা চুন্নু সিংহ (তিকাম জোশী) ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় প্ররোচিত করে। সেই দাঙ্গার আগুনে ঝলসে যায় ঋষি (অংশুমান পুষ্কর) এবং মনুর (ওয়ামিকা গব্বি) নিষ্পাপ প্রেম। গুরুসেবকের যৌবনের নাম ঋষি। ইউনিয়ন নেতা চুন্নু সিংহ যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে, তখন সে পরিচিত সঞ্জয় সিংহ নামে। সময়ের সঙ্গে নামের রকমফেরেই লুকিয়ে রয়েছে সিরিজ়ের থ্রিল, বাস্তব ও অতীতের টানাপড়েন।
সিরিজ়ের পরিচিত মুখ পবন এবং জ়োয়া। কিন্তু ছোট-বড় সব চরিত্রে নামী-অনামী অভিনেতারা সিরিজ়টির মান বাড়িয়েছেন। ‘মুক্কাবাজ়’-এর পরে জ়োয়াকে আরও এক বার বলিষ্ঠ চরিত্রে পাওয়া গেল। ছোট-বড় পর্দার পরিচিত মুখ পবনের সিরিজ়ে সংলাপ কম। কিন্তু শরীরী ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন দর্শক তাঁকে এই চরিত্রে মনে রাখবেন। অংশুমান এবং ওয়ামিকাকেও ভারী সুন্দর লেগেছে তাঁদের চরিত্রে। পোড়খাওয়া রাজনীতিকের চরিত্রে তিকাম জোশীও দারুণ। অমিত ত্রিবেদীর আবহসঙ্গীত উপরি পাওনা। খামতি বলতে, সিরিজ়ের বেশ কয়েকটি জায়গায় অতি সরলীকরণ করা হয়েছে। কোথাও বাস্তবের বিভীষিকায় রং লাগিয়েছে সিনেম্যাটিক লাইসেন্স। পুরনো অনুষঙ্গ ফিরে আসায় একঘেয়েমি তৈরি হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে।
সিরিজ়ের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছেন শিখ সম্প্রদায়ের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় এক শিখকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে, যা ইতিহাসের বিকৃতি। যদিও তাঁদের আপত্তির ভিত্তি সিরিজ়ে প্রতিষ্ঠিত নয়। কারণ ঋষি কী ভাবে গুরুসেবক হল, কেনই-বা হল, তা নিয়ে সিরিজ় বেশি গভীরে যায়নি। তবে ইঙ্গিতটি তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এই বেশ ও নাম বদলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে দাঙ্গাপীড়িত সময়ের রাজনীতি এবং সমীকরণ। এই বিতর্কটির জন্য সিরিজ়টি বৃহত্তর দর্শকের নজরে এসেছে। তবে গল্প ও অভিনয়ের গুণেও ‘গ্রহণ’ স্বকীয়তার দাবি রাখে।