পেটে প্রজাপতি ওড়ার ফুরফুরে দিনগুলো নিয়ে গল্প বুনেছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। কলেজে সদ্য পা রাখা ছেলেমেয়েদের গল্প। তারা প্রেমে পড়ে, ‘কেস খায়’, প্রেম ভাঙে। এ ছবি ভ্যালেন্টাইনস ডে আর সরস্বতী পুজোর সপ্তাহে রিলিজ় করবে, সেটাই স্বাভাবিক। পোড় খাওয়া প্রেমিক বা সদ্য ডানা-গজানো কিশোর-কিশোরী— অনিন্দ্যর এই ছবি সকলকেই কলেজের দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, নিমেষে।
পাবলো (সৌম্য মুখোপাধ্যায়), রাজি (সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়) আর আরশির (শ্বেতা মিশ্র) গল্প। খটমট ভাল নামগুলোর মতোই তারা জীবন থেকে বাদ দিয়েছে যাবতীয় দ্বিধা-সঙ্কোচ, প্রেমের প্রকাশে বাধা নেই তাদের। তবে আরশিকে প্রথম চুমুটা খেতে গিয়েই বিপদে পড়ে পাবলো। সিনিয়রদের হাতে পড়ে হেনস্থা হতে হয় সারা কলেজের সামনে। আরশি কলেজ আসা বন্ধ করে দেয়, পাবলোর হয়ে প্রতিবাদে নামে ইউনিয়ন। সেখানকার ডাকাবুকো লিডার রাজনন্দিনী, ওরফে রাজির প্রেমে পড়ে পাবলো। রাজির প্রতি তার ‘তোমায় ছাড়া বাঁচব না’ গোছের প্রেম গড়ায় লিভ-ইন পর্যন্ত। পাবলোর সঙ্গে থাকতে আসে রাজি, সঙ্গে তার প্রিয় পোষ্য খগেন। এর পরেই প্রেমের গ্রাফের ওঠানামা শুরু।
ছবিটা যে গড়পড়তা ত্রিকোণ প্রেমের নয়, তা স্পষ্ট হয় ছবির দ্বিতীয়ার্ধে। সেখানে ‘পাড়ার অ্যালসেশিয়ান’ খগেনই আসল হিরো। প্রেমিকার মন পেতে গেলে আগে তার পোষ্যকে ভালবাসতে হবে, এমন দাবির মুখোমুখি পাবলোর মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম। গল্পের খাতিরে তা মেনে নেওয়া গেলেও চিত্রনাট্য হোঁচট খায় বেশ কয়েকটি জায়গায়। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে লিভ-ইন সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে নানা ভাবে। এই ছবিতে কাঁচা বয়সে আবেগের ঝোঁকে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে দুই কলেজপড়ুয়া, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ছেলেটির মা। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে কি এত সহজেই সম্ভব এমনটা? এ ক্ষেত্রে ক’জন প্রতিবেশীই বা বলে, ‘তুমি কী লাকি গো’? যে প্রেমের জন্য এত কিছু, তা ঠিকমতো জমে ওঠার আগেই আচমকা নিরুদ্দেশ হয়ে যায় রাজি। তার কারণ সম্পর্কে দর্শক অন্ধকারে। ছবির অন্যতম নায়িকার কোনও ব্যাকস্টোরিই তৈরি করা হয়নি সে ভাবে। লাইব্রেরিতে বসে রিসার্চের পড়াশোনা করা, কথায় কথায় কবিতার লাইন আওড়ানো, ছাত্র আন্দোলন করা রাজির ইমেজ তৈরির চেষ্টা হয়েছে মাত্র। সুস্মিতার স্ক্রিন প্রেজেন্স থাকলেও অভিনয়ের চেষ্টা চোখে পড়েছে।
প্রেম টেম
পরিচালনা: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়: সৌম্য, সুস্মিতা, শ্বেতা
৫.৫/১০
তুলনায় পাবলোর চরিত্রে সৌম্য সাবলীল। গোবেচারা প্রেমিকের কষ্ট, কনফিউশন, একা থাকার মুহূর্তগুলোয় প্রাণবন্ত তাঁর অভিনয়। আরশির চরিত্রটির দৈর্ঘ্য আরও বেশি হলে ভাল লাগত, স্বল্প পরিসরেই সুন্দর কাজ করেছেন শ্বেতা। পাবলোর মায়ের চরিত্রে চৈতী মিত্রের অভিনয় একটু আড়ষ্ট। ছবিজুড়ে বিভিন্ন শব্দবন্ধ নিয়ে অনিন্দ্যসুলভ মজা ছড়িয়ে, যা চিত্রনাট্য ও সংলাপকে উপভোগ্য করেছে। তবে ‘মেঘদূত’-এর রচয়িতা হিসেবে কালিদাসকে অ্যাডিডাস বলার মতো ভুল বোধহয় এখনকার ব্র্যান্ড-সচেতন কলেজপড়ুয়ারা করে না! পার্শ্বচরিত্রে কঙ্কণা চক্রবর্তী, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কাজ ভাল।
পরিচালককে ধন্যবাদ, গল্পটা তিনি চন্দননগর-চুঁচুড়া-শ্রীরামপুর অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন। চার্চ, ইমামবাড়া, স্ট্র্যান্ড-সহ চোখজুড়ানো সব লোকেশনে ঘুরেছে শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরা। জায়গাটার মতোই ওভারস্মার্টনেসের গন্ধ নেই সেখানকার প্রেমেও। ‘তাকে অল্প কাছে ডাকছি’, ‘তোমারই তো কাছে’র মতো গানেও সেই মনকেমনের মিঠে রেশ, যা অনিন্দ্যর ছবি থেকে প্রত্যাশিত। ছবির দৈর্ঘ্য আরও কম হতে পারত, বিশেষ করে গল্প যখন একমুখী। তবে প্রেমের ছবি বলেই হয়তো অনেক ফাঁকফোকর সত্ত্বেও একটা ভাল লাগা জড়িয়ে থাকে শেষ পর্যন্ত। ‘প্রেম-টেম’-এর মজা কিন্তু সেখানেই।