বোম্বাগড়ের রাজা-রানি।
রূপকথার ছবি দেখতে বসলে প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। বাস্তব জীবনের যা কিছু অপ্রাপ্তি, রূপকথার মধ্যে সেই সুখ অথবা সুখের বিভ্রমকে আমরা আঁকড়ে ধরতে চাই। তাই দেখি, রাজা-রানি রাজসভায় এসে দু’হাত জোড় করে সভাসদদের প্রণাম জানান। মন্ত্রী আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে রাজার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলতে পারেন, প্রজাদের অর্থে রাজার এবং রাজ্যের যে সমৃদ্ধি, তার ভাগীদার প্রজারাও। তাই রাজকোষ থেকে প্রজাদের কল্যাণে অর্থব্যয় একেবারেই অপচয় নয়।
বোম্বাগড় এক সুখের রাজ্য। সেখানকার রাজা হবুচন্দ্র। পাশের রাজ্য চন্দ্রগড়ের রাজকুমারী কুসুমকলিকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন রাজা হবুচন্দ্র। রাজপুত্রের জন্ম হল। রাজার খুব কন্যাসন্তানের শখ। সে শখও পূরণ হল। আনন্দ উথলে উঠছে চারদিক। রাজ্যে মহা ধুমধাম। আর সেই উৎসবের মধ্যেই ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব গবুচন্দ্রের।
এ ভাবেই চলছিল রাজত্ব। সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল প্রজারা। রাজা ভারি সাদাসিধে। বৃদ্ধ মন্ত্রীর প্রজ্ঞায় সম্পূর্ণ আস্থা রেখে চলতেন তিনি এবং তাতে সকলেরই ভাল হচ্ছিল।প্রজারা রাজা, রানি এবং মন্ত্রীকে খুব শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত। রাজার হাতিশালে হাতি, কোষাগারে মণিমুক্তো... কোনও কিছুরই অভাব ছিল না।
এই ছবিতেও ছন্দ মিলিয়ে কথা, রূপের জগৎ থেকে অরূপের ভুবনে যার চলন।
কিন্তু ওই যে, রূপকথাতেও ঢুকে পড়ে কঠিন বাস্তব, লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে কালসাপের প্রবেশের মতো! যতই সুখশান্তির নিশ্ছিদ্র দেওয়াল থাক, তারই মাঝে লুকোনো ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ে সে। আর সে হল গবুচন্দ্র। গুর্জর প্রদেশের কোন এক অংশ থেকে আগমন ঘটলো এই অদ্ভুত মানুষ গবুচন্দ্রের। তার কুমন্ত্রণায় রাজা-রানির মন ঘুরে গেল অন্য দিকে। গবুচন্দ্র ক্রমশ রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে লাগল।
সহজ সরল রাজা-রানির মনে অর্থলিপ্সার বিষ ঢুকিয়ে, ছলে বলে কৌশলে তাদের ভুল বুঝিয়ে, রাজ্যের পরিস্থিতি পাল্টে দিল গবুচন্দ্র। বৃদ্ধ মন্ত্রীকে সরিয়ে নিজেই মন্ত্রী হয়ে বসল। মানুষের কষ্টের শেষ রইল না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত দর্শককে স্বস্তি দিয়ে গবুচন্দ্রের শাস্তি হল আর প্রজাহিতকারী সৎ চরিত্রের বৃদ্ধ মন্ত্রী ফিরে এলেন। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের হৃদয়ে বাস করে, তা দিয়েই ছবির পরিসমাপ্তি।
ছবিটি দেখতে দেখতে বারবার সত্যজিৎ রায়ের সেই অতিবিখ্যাত ‘হীরক রাজার দেশে’-র কথা মনে হচ্ছিল। রাজা-রানি-মন্ত্রীর রাজত্বের জাঁকজমকের আড়ালে বাস্তব জীবনের জটিল রাজনীতি আর সাপ-লুডো খেলার আনাগোনা। চরিত্রগুলোতেও বেশ মিল।
এই ছবিতেও ছন্দ মিলিয়ে কথা, রূপের জগৎ থেকে অরূপের ভুবনে যার চলন। তাই হাতি ঘোড়া পাল্কির সঙ্গে পাই ‘হনিমুন’, ‘গ্লোবালাইজেশন’। মাথায় মুকুট, ভারী পোশাক পরিচ্ছদে সজ্জিত রাজা-রানি। আর সেখানে যখন রানি ‘হনিমুনে’ না নিয়ে যাওয়ার অভিমান প্রকাশ করে স্বয়ং রাজার কাছে, সে কথা একেবারেই কানে লাগে না। বরং বেশ মজার উদ্রেক হয়। এই ভাবেই বাস্তব থেকে পরাবাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ। তাই কয়েকশো বছর আগের সাজসজ্জায় সজ্জিত রাজা, দরবারে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীর দেওয়া চিনে খাবার চাউমিন খান রসিয়ে। আর সেই মন্ত্রীই নগর উন্নয়নের প্রসঙ্গে বিশ্বায়নের কথা বলেন, যা আধুনিক জীবনের অঙ্গ।
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের হৃদয়ে বাস করে, তা দিয়েই ছবির পরিসমাপ্তি।
তবে গল্পের কিছু জায়গা আলগা লাগে। প্রজাহিতকারী রাজা কুমন্ত্রণায় বদলে যাচ্ছেন, এ তো হতেই পারে। কিন্তু বদলের এই পথটি ততটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আর একটু বিস্তারের প্রয়োজন ছিল বোধ হয়। রাজা কখনও সরলমনা, কখনও নির্বোধ এবং নিষ্ঠুর। দর্শকের ধাঁধা লাগতে পারে। বোধগম্য হয় না, শেষ পর্যন্ত রাজার ব্যক্তিত্ব কেমন!
রূপকথা এবং বাস্তব যখন পাশাপাশি দাঁড়ায়, আমরা দর্শন খুঁজি, আবার একই সঙ্গে মায়ায় আবিষ্ট হতে চাই।
এ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছেন বৃদ্ধ মন্ত্রী শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। চমৎকার লেগেছে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। রানি হিসেবে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়কেও ভাল লাগে। কবীর সুমনের সঙ্গীত পরিচালনা প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয় এবং তা পূরণও হয়। স্যান্ডির আবহসঙ্গীতও ভাল। গ্রাফিক মন্দ নয়।
অনেক দিন বাদে একটি রূপকথার গল্প। যার মোড়কে রাজা-মন্ত্রীর দাবার ছক, দর্শকদের তা ভালই লাগবে।