দ্য জিসাইপল
দ্য ডিসাইপল (মরাঠি)
পরিচালক: চৈতন্য তামহানে
অভিনয়: আদিত্য মোদক, অরুণ দ্রাবিড়, সুমিত্রা ভাবে
৭/১০
শিক্ষা, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ, একাগ্র সাধনার পরিণতি কি সব সময়েই দিশা দেখাতে পারে আমাদের? অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা গুরুবাক্য ও গুরুধর্ম পালনেই কি সত্যিকারের মোক্ষলাভ সম্ভব? তার সঙ্গে বহির্জগতের, এমনকি নিজের অন্তরাত্মার দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে ওঠে কোনও কোনও সময়ে। চৈতন্য তামহানে তাঁর মরাঠি ছবি ‘দ্য ডিসাইপল’-এ এই অন্তর্দ্বন্দ্বটিই তুলে ধরেছেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ যাপনের পথে জীবনজিজ্ঞাসা ছুড়ে দিয়েছেন, ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রেক্ষাপটে।
শরদ নেরুলকর (আদিত্য মোদক) শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষার্থী। তার গুরু পণ্ডিত বিনায়ক প্রধান (অরুণ দ্রাবিড়) অলওয়র ঘরানার পরম্পরা বহন করছে, তস্য গুরু সিন্ধুবাই যাদবের (সুমিত্রা ভাবে) কাছ থেকে। শরদ তার অধ্যবসায়ের মাধ্যমে পুষিয়ে দিতে চায় প্রতিভার খামতি। পিতৃজ্ঞানে সেবা করে অশীতিপর গুরুজির।
শরদ নিঃসঙ্গ। ছেলেবেলা জুড়ে তার বাবার অনুশাসন, যৌবনে মায়ের সঙ্গেও তার কথা হয় ফোনে। প্রেম পূর্ণতা পায়নি। অন্ধকার নামলে মুম্বইয়ের রাস্তায় বাইক চালাতে চালাতে সে শোনে তার ‘মাই’, অর্থাৎ গুরু সিন্ধুবাইয়ের লেকচারের রেকর্ডিং। তার প্রতিটি বাক্য বাস্তবে মেনে চলার চেষ্টা করতে গিয়ে হোঁচট খায়। টিভিতে সে দেখে, দেশের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে আসা শিল্পীরা রিয়্যালিটি শোয়ের দৌলতে খ্যাতি পাচ্ছে নিমেষে। আর তার দিনগুলি আবর্তিত হচ্ছে, হয় জলসায় খেয়াল পরিবেশন করে, নয়তো এক ঘর ছাত্রছাত্রীকে ‘...ঘড়িপল ছিনদিন’ শেখাতে। ছবি যত এগিয়েছে, একাকিত্ব, হতাশা, শূন্যতা ফুটে উঠেছে শরদের চোখে। আদিত্য মোদকের অভিনয়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে শরদ, তার যন্ত্রণাও।
‘দ্য ডিসাইপল’-এর এগজ়িকিউটিভ প্রোডিউসর অস্কারজয়ী পরিচালক আলফন্সো কুয়েরন। ভেনিস, টরন্টোর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চেও পুরস্কার জিতে এনেছে আদ্যন্ত ভারতীয় এই ছবি। আজন্ম লালিত গুরুশিষ্য পরম্পরা কখনও বোঝাস্বরূপ, কখনও বা এক মধ্যমেধাকে নিজের সঙ্গে আপ্রাণ লড়াই করতে হয় ঐতিহ্য বহন করার স্বার্থে। এ সবই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন পরিচালক চৈতন্য। ডেবিউ ফিচার ‘দ্য কোর্ট’-এর পরে এই ছবির জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন পরিচালক। চিত্রনাট্য সম্পর্কে নিজে এক বার বলেছিলেন, সঙ্গীত সম্মেলনে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে যে উস্তাদজিরা ঝড় তোলেন, এই ছবি তাঁদের নিয়ে নয়। বরং তাঁদের নিয়ে, যাঁরা তাঁদের নেপথ্যে তানপুরা ধরেন, যাঁদের কথা না বলাই থেকে যায়।
এ ছবির ‘ডিসাইপল’ শরদও তাঁদেরই একজন। প্রকৃত শিষ্য হয়ে উঠতে গিয়ে যার আরও অনেক কিছুই হওয়া হল না। মাইয়ের রেকর্ডেড প্রবচন তার কানে বাজে— মার্গসঙ্গীতের পথে যদি হাঁটতে চাও, নিঃসঙ্গতা আর অপূর্ণতা তোমার নিত্যসঙ্গী হবে। শুনতে শুনতে এক সময়ে এক ঝটকায় ইয়ার প্লাগ খুলে ফেলে শরদ। মুম্বইয়ের রাস্তা জুড়ে তখন অপার নৈঃশব্দ্য। মাইয়ের প্রবচনের সবক’টি টেপ দান করতে যায় সে। ইউটিউবের ট্রোলকে কড়া জবাব দিতে গিয়েও থমকে যায়। তাকে থামিয়ে দেয় শিষ্যত্বের মূল্যবোধ। এগিয়ে যাওয়া সময়ে সঙ্গীতের বাণিজ্যিকীকরণকে গ্রহণ করতে পারে না শরদ। এ দিকে সনাতন সঙ্গীতে তার পারদর্শিতা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ‘যে জন আছে মাঝখানে’র এই দোলাচলই ‘দ্য ডিসাইপল’-এর মূল সুর।
এ ছবির সেই মূল সুরটি ধরতে আহীর ভৈরব-টোড়ি-বাগেশ্রীর সমঝদার না হলেও চলবে। এক নব্য মুম্বইকরের জীবনের অন্য রকম যুদ্ধ দেখাতে গিয়ে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের যে প্রেক্ষাপট বেছে নিয়েছেন চৈতন্য, তার জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। ঐতিহ্য, মূল্যবোধে এতটুকু আঘাত না দিয়েও গুরুশিষ্য পরম্পরার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন তিনি। কমবেশি দু’ঘণ্টার এই ছবি মন্থর লয়ের, গল্পের চাহিদা মেনেই। অনীশ প্রধানের সঙ্গীত ছাড়া এ ছবি অসম্পূর্ণ, চৈতন্যের পরে সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁরই। পাহাড় আর জলরাশি ঘেরা প্রান্তরে আয়োজিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের দৃশ্যটি চোখজুড়ানো। আবার আর এক জায়গায় সুরের মাদকতা নিমেষে খানখান করে দেয় শরদের নিজের গলার সঙ্গে লড়াই করার দৃশ্যটি। প্রতি দৃশ্যের অভিঘাতকে অন্য মাত্রা দিয়েছে মিখেল সোবোচিনস্কির ক্যামেরা। আলফন্সোর সহযোগিতা ছাড়া যা সম্ভব ছিল না।
এক অদ্ভুত বিষাদ রয়েছে সারা ছবি জুড়ে। তানপুরার তারের সঙ্গেই যা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকমনে। সেই সঙ্গে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানবমনকে দেখতে শেখায় ‘দ্য ডিসাইপল’।