Hubba Review

মরা বাংলার গ্যাংস্টার

আইপিএস অফিসার সুপ্রতিম সরকারের ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ বইয়ের একটি পরিচ্ছেদ এই ছবির মূল অবলম্বন।

Advertisement

সোমেশ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪০
Share:

‘হুব্বা’ ছবির একটি দৃশ্যে মোশাররফ করিম। ছবি: সংগৃহীত।

এ আসলে এক দিশি গ্যাংস্টারের দিশি গল্প।

Advertisement

ঢিসঢাস গুলি, ঘুপঘাপ কোপ। ছিটকে আসা রক্ত, চলকানো বোতল, চনমনে মেয়ে। স্মার্ট কপ, রুলিং পার্টির নেতা আর গদ্দারি। কয়েক জনের মারকাটারি অভিনয় আর চিত্রনাট্যের কিছু আলগা সুতো। চুম্বকে এই হল ব্রাত্য বসুর ‘হুব্বা’।

কপোলার ‘গডফাদার’ না হয় বাদই রইল। বলিউডের ‘সত্য’, ‘বাস্তব’, ‘সরকার’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’ বা হালে ওটিটি জমানায় ‘পাতাললোক’ বা ‘মির্জ়াপুর’ দেখে ফেলা বাঙালির কাছে এ সব অ্যাকশন জলভাত। কিন্তু এ ছবির ইউএসপি বাংলার মফস্সলি ‘ডন’ হুব্বা শ্যামল আর নামভূমিকায় বাংলাদেশি তারকা মোশাররফ করিম।

Advertisement

২০১১-র ২ জুন হুগলির বৈদ্যবাটি খালে এক মাঝবয়সি পুরুষের নগ্ন লাশ আটকে ছিল। গলার নলি কাটা, পেট চেরা। তার মাত্র সপ্তাহ দুই আগে ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় এসেছে। মৃতের স্ত্রী পুলিশের সক্রিয়তা চেয়ে তাঁর দ্বারস্থ হন। লাশ শনাক্ত হতে সময় লাগেনি। ধরপাকড়, হইচই, কিছু দিন বাদে যে-কে-সেই। আশির দশকে কোন্নগর ও রিষড়ার মাঝে রেললাইন লাগোয়া ধর্মডাঙার শ্যামল দাস ওরফে হুব্বার শুরু ছোটখাটো চুরিচামারি দিয়ে। তার পর দুঃসাহসিক রেল ডাকাতি থেকে শুরু করে একের পর এক খুন আর হাওড়া, হুগলি, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় চোরাই স্ক্র্যাপ আর জমির কারবারের সুবাদে ‘বাংলার দাউদ ইব্রাহিম’ হয়ে ওঠে সে। বিস্তার বা প্রতিপত্তির বিচারে এই শিরোপা নেহাতই আলঙ্কারিক, কিন্তু শিল্পগতিহীন মরা বাংলায় হুব্বার তুলনীয় ‘ডন’, অন্তত ‘গ্যাংস্টার’ কমই পয়দা হয়েছে। টানা একুশ বছর পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। ২০০৫ সালের ২২ ডিসেম্বর সিআইডি যে দিন তাকে ধরে, ডান হাত বেনারসি বাপি আর দ্বিতীয় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সে সল্টলেকে সিটি সেন্টার আইনক্সে হিন্দি অ্যাকশন ফিল্ম দেখতে গিয়েছিল।

আইপিএস অফিসার সুপ্রতিম সরকারের ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ বইয়ের একটি পরিচ্ছেদ এই ছবির মূল অবলম্বন। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ বলার তাগিদে হয়তো শ্যামল হয়েছে বিমল, বেনারসি বাপি হয়েছে বোকারো বাপি, গ্যাংয়ে দু’নম্বর রমেশ মাহাতো হয়েছে উমেশ, নৃশংস খুনি নেপু গিরি হয়েছে খেপু। দুই দশকের লুকোচুরি সাঙ্গ করে হুব্বাকে যিনি ধরেন, সেই ডিআইজি (সিআইডি) অপারেশনস রাজীব কুমারের ছায়ায় গড়া চরিত্রটির নাম দিবাকর মিত্র। কিন্তু যে দু’জনের পরিচয় গোপন রাখা সবচেয়ে জরুরি ছিল, তাঁরা হাজির স্বনামেই!

চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে উন্মাদনার বহু আগে, ওটিটি আসারও আগে, স্রেফ ইউটিউবের দৌলতে‌ মোশাররফ করিম এ বাংলায় পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। হুব্বা চরিত্রে বড় পর্দায় তাঁর অভিনয় বড় প্রাপ্তি— তার ঝাঁঝ, অসহায়তা এবং কমেডি সমেত। ‘নামুমকিন হ্যায়’ ডেলিভারি সমেত। তাঁর পাশে বোকারো বাপির চরিত্রে লোকনাথ দে-ও জাত চিনিয়েছেন। হুব্বার প্রতিদ্বন্দ্বী বাঘা চরিত্রে বুদ্ধদেব দাস বা পার্টিনেতার ভূমিকায় অশোক মজুমদার বেশ ভাল। ডিআইজি চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও মন্দ নন। তবে চমকে দিয়েছেন অল্পবয়সি হুব্বার চরিত্রে গম্ভীরা ভট্টাচার্য। সত্যি বলতে, মোশাররফ এবং থিয়েটারের কয়েক জন সুঅভিনেতার কাজই আদতে নাট্যকার-নির্দেশক ব্রাত্য বসুর পঞ্চম ছবিটিকে স্মরণীয় করার পক্ষে যথেষ্ট।

টিভিতে ‘সাগর’ (১৯৮৫) থেকে পর্দায় ‘বাস্তব’ (২০০২), ঊষা উত্থুপের ‘রাম্বা হো হো’— ব্রাত্য এই ছবিতে সময়ের চিহ্ন ধরতে চেয়েছেন বার বার। তা কাজে দিয়েছে। যেমন কাজে দিয়েছে হুব্বার উড়ে উড়ে গুলি করার খোয়াব-দৃশ্য বা তার স্কুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার গল্পে ‘আসলে যা হয়েছিল’-র মতো নিখাদ সিনেম্যাটিক প্রয়োগও। সৌমিক হালদার ক্যামেরা করেছেন জমিয়ে। বেশ ভাল অ্যাকশন কোরিয়োগ্রাফিও। কিন্তু ডক-স্টাইলে জল-ছপছপ ছোটাছুটির বদলে চোখ খোঁজে হুব্বার ডেরা-ঘেঁষা অন্ধকার রেললাইন, লাল-হলুদ সিগন্যাল, মরা আলো ঘষটে লোকালের ছুটে যাওয়া আর মন্থর মালগাড়ি, যা সমবেত ভাবে নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠতে পারত।

অতীত থেকে বর্তমানে যাতায়াতও সব সময়ে মসৃণ হয়নি। বিশেষত, হবু স্ত্রীর বাড়ি ছাড়ার রাতে হুব্বার চরিত্রে আচমকা অভিনেতা বদলে তো ভালই ঝাঁকুনি লাগে। তবে গপ্পো যদি যুক্তির পাকা রাস্তা ছেড়ে কানাগলিতে গিয়ে সেঁধোয়, সব ঝাঁকুনির দায় সম্পাদক সংলাপ ভৌমিকের ঘাড়ে বর্তায় না। ছবির খান তিনেক গানের কথায় বুদ্ধির ছাপ, ভাল সুর করেছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, বেশ ভাল গেয়েছেন শিলাজিৎ। কিন্তু অস্থানে-কুস্থানে গান থ্রিলারের গতিরোধ করে। ‘হুব্বা হুব্বা’ টাইটেল ট্র্যাক ও তার দৃশ্যায়নও কার্যত ‘সত্য’ ছবির ‘কাল্লুমামা’-র দুর্বল অনুকরণের মতো দেখায়।

সুতোকল মজুরের ছেলে শ্যামলের উত্থান-পতনের নেপথ্যে ছিল টাকা কামিয়ে ‘সফল’ জীবন ছোঁয়ার বাসনা। সেই তাগিদেই সে অপরাধজগৎ ছেড়ে শেষ দিকে ব্যবসায়ী ‘ভদ্দরলোক’ হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল। সেই শ্রেণি-বাসনা তথা শ্রেণি-অসহায়তা অনিবার্য ভাবে এসেছে, কিন্তু অন্তিম পর্বে তা হয়তো আরও কিছু স্পষ্ট হওয়ার দাবি রাখে। স্পষ্টতার দাবি রাখে কিছু চরিত্র এবং তাদের কাজকর্মের গতিপথও। হুব্বার জীবনে যে বিপর্যয় আকস্মিকতা নিয়ে এসেছিল তা দর্শকের কাছেও আকস্মিক হলে এক ধরনের থ্রিলার হয় ঠিকই, কিন্তু নাট্যনির্মাণের কার্যকারণ হারিয়ে যায়। উপরিতল ছেড়ে আখ্যান গভীরে ডুব দেয় না। শুধু পুলিশকর্তার লেখা সম্বল না করে সংবাদপত্রের পাতা ঘাঁটলে হয়তো ‘গবেষণা’ সেই গভীরতা পেত।

ঘটনা ছেড়ে গল্পের আশ্রয়ে গিয়ে ডিআইজি দিবাকর মিত্রের চরিত্রে বেশ কিছু গোপন দুর্বলতা গুঁজে দিয়েছেন ব্রাত্য। তা চরিত্রে তথা গল্পে নোনতা পরত এনেছে। কিন্তু হুব্বার ঘনিষ্ঠ এক মহিলা চরিত্র সম্পর্কে শেষে যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, গল্পের খাতিরে হলেও তা কতটা সঙ্গত বা নৈতিক সেই প্রশ্নটিও রাখা রইল, মন্ত্রীমশাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement