‘ভূতপরী’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
আমাদের বাংলার গল্পকথার ভূতেরা বেশ মজাদার। ইংরেজি ভূতের মতো ভয়ানক নয়। এখানকার ভূতেদের সঙ্গে গল্প করা যায়, চোখ পাকিয়ে বকুনি দেওয়া যায়, চাইলে দু’-চারটে কাজও করিয়ে নেওয়া যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার তেঁনাদের নিয়ে কেমন সব নোনতা-মিষ্টি গল্প লিখেছেন। সেই স্বাদই ধরা দিল সৌকর্য ঘোষালের ‘ভূতপরী’ ছবিতে। বনলতার (জয়া আহসান) সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ে সূর্য (বিষান্তক মুখোপাধ্যায়) গোলগোল চোখে প্রশ্ন করে, ‘ভূতেরা তো দেখছি মানুষকে ভয় পায়! তা হলে কি এত দিন আমাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল?’’
সৌকর্যর ছবিতে ভূত আছে, সিঁধেল চোর আছে, আর আছে গ্রাম বাংলার রূপরস। সবচেয়ে বেশি যে আছে সে একটা খুদে বিচ্ছু, সূর্য। বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকে সে। সূর্যর স্লিপওয়াকের সমস্যা আছে। শিলালিপি (সুদীপ্তা চক্রবর্তী) ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। ডাক্তার পরামর্শ দেয়, বেড়াতে যাওয়ার। তবে পাহাড়ে নয়, তাতে ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। শিলালিপি তার গ্রামের বাড়ি যায়। সেই ভাঙাচোরা পেল্লায় বাড়িতে দু’-চারটে ভূত থাকা আশ্চর্যের নয়! যে ছেলে স্লিপওয়াক করে, হ্যালুসিনেট করে, তাকে এমন নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তির অভাব আছে। কিন্তু ভূতের গল্পে যুক্তি খুঁজতে গেলে রসভঙ্গ হয়, তার চেয়ে মেনে নেওয়া যাক ওই অঞ্চলে গপ্পো ফাঁদতে হবে বলেই এমন ফাঁকফোকর! কংক্রিটের জঙ্গলে কি ভূতপরী থাকতে পারে! সেখানে থাকে শুধু মানুষবেশী রোবট। ‘ভূতপরী’র গল্প বলার জন্য চাই সবুজ গ্রাম, ইট পাঁজরা বেরিয়ে আসা বাড়ি, ঘন গাছের ছায়াপথ, লেডি ম্যানড্রেকের ম্যাজিক...
গ্রামের বাড়িতে সূর্য, তার মা আর এক চাকর থাকে। ছেলে সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। খানিক চোখ পাকিয়ে বকুনি দেওয়া ছাড়া মা-কে বেশি উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় না। ঘুরঘুর করতে করতেই বনলতা আর সিঁধেল চোর মাখনের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) সঙ্গে মোলাকাত হয় ছেলেটির। এই দু’জনের সঙ্গে সূর্যর বন্ধুত্বই ছবির সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গা। গল্প কথায় উঠে আসে সূর্যর পূর্বপুরুষ তন্ত্রসাধক কালো ঠাকুরের (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) কালো কীর্তি, জানা যায় কেমন করে ভূত হল বনলতা। যে হালকা মেজাজ দিয়ে কাহিনি শুরু হয়েছিল তা ক্রমে সিরিয়াস দিকে বাঁক নেয়। তার পর পরিচালক যে কেন হঠাৎ তাড়াহুড়ো শুরু করলেন বোঝা গেল না। পাতালপুরীর সুরের দুনিয়া, বনলতার আচরণ বদল... সব কিছু বড় দ্রুত হয়ে গেল।
ভূতের ছবিতে একটু গা ছমছমে ভাব থাকলে জমে ভাল। গোটা সিনেমা হলে অল্প সংখ্যক দর্শকের সঙ্গে ছবি দেখার পরেও কোনও ভৌতিক অনুভূতি হয় না। বনলতা, মাখন আর সূর্যর অংশেই ছবির আবেগ লুকিয়ে, যার আরও মন্থনের প্রয়োজন ছিল। পুজোর আগের সময়ে গল্প বলা হচ্ছে, অথচ তার কোনও আমেজ পাওয়া গেল না ছবিতে। শেষ দৃশ্যে শিলালিপির হাতে অঞ্জলির থালা ধরিয়ে দিয়ে, ধর তক্তা গোছের একটা ব্যাপার করা হল।
ছবিতে জয়া আহসান, ঋত্বিক চক্রবর্তীর মতো শক্তিশালী অভিনেতা রয়েছেন। বেনারসি, সোনার গয়না পরা জয়া যথার্থই ভূতপরী। ঋত্বিক সব ধরনের চরিত্রে সব সময়েই সাবলীল। সূর্যর মায়ের চরিত্রে সুদীপ্তার বেশি কিছু করার ছিল না। নজর কেড়ে নিয়েছে বিষান্তক। ওজনদার একটা চরিত্র অনায়াসে করে ফেলেছে সে।
ছোটদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিতে আলাদা দক্ষতা লাগে। সৌকর্য সেটা পারেন। ছোটদের নিয়ে তাঁর গল্প বলার ঝোঁকও প্রশংসনীয়। পরিচালকের ‘রেনবো জেলি’র ঘোঁতন এখনও মনে রয়ে গিয়েছে। থ্রিলার, সিরিয়াল মার্কা ছবির ভিড়ে যে তিনি অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করেছেন, সেটাই মন ভাল করে দেয়।