Movie Review Pariah

‘পারিয়া’ দেখে একটাই প্রশ্ন, এত রক্ত কেন?

ট্রেলার বা পোস্টারেই স্পষ্ট, এ ছবি আদ্যন্ত বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর চরিত্র লুব্ধকের একটা অতীত রয়েছে, যা তাড়া করে বেড়ায় তাকে। সে কাছেই এক ভাতের হোটেলে খেতে যায় নিয়মিত।

Advertisement

সায়নী ঘটক

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৭
Share:

তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘পারিয়া’ দেখে এই প্রশ্নটাই মাথায় আসে প্রথমে। পরিচালক পথকুকুরদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার বার্তা দিতে চেয়ে একটা ছবি তৈরি করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য যে সৎ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ছবি জুড়ে রক্তারক্তির চোটে আসল বার্তাটাই আড়ালে রয়ে গেল প্রায়। ‘ভায়োলেন্স কাকে বলে, দেখিয়ে দেব’ গোছের সাম্প্রতিক ট্রেন্ড মেনে তৈরি আর একটি ছবি হয়েই রয়ে গেল ‘পারিয়া’, যেখানে মনে ধরার মতো মুহূর্ত কম। বরং দর্শককে ‘ডিস্টার্ব’ করার উপাদান অনেক বেশি। পর্দায় রক্তগঙ্গা বইয়ে, শতাধিক ফুটের কাটআউট বানিয়ে, চমক দিয়ে হাততালি আদায় করার এই প্রবণতা বাংলা ছবির নিজস্বতা নয়। কুকুরদের নিয়ে ছবি, অথচ তাদের মুহূর্ত ছবিতে বেশ কম। কুকুরের মাংস নিয়ে কারবারের মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে তৈরি ছবি যদি অ্যাকশন মুভিতে পরিণত হয়, তা হলে তা দুঃখজনক।

Advertisement

ট্রেলার বা পোস্টারেই স্পষ্ট, এ ছবি আদ্যন্ত বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর চরিত্র লুব্ধকের একটা অতীত রয়েছে, যা তাড়া করে বেড়ায় তাকে। সে কাছেই এক ভাতের হোটেলে খেতে যায় নিয়মিত। সেই হোটেলটি চালায় যে বৃদ্ধা, তাকে ও তার কাছে খেতে আসা পথকুকুরদের নিষ্ঠুর ভাবে উৎখাত করে এক প্রোমোটার (লোকনাথ দে)। পাশাপাশি চলে শান্তনুর (সৌম্য মুখোপাধ্যায়) মাংসের দোকান। খাসির মাংসের আড়ালে কুকুরের মাংসের ব্যবসা করে সে। আর আছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যার কর্ত্রী (শ্রীলেখা মিত্র) রাস্তার কুকুরদের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের প্রধান মুখ। তার সংস্থায় সদ্য যোগ দিয়ে কুকুরদের জন্য কাজ করতে আসে কমলিনী (অঙ্গনা রায়)। এ ছাড়া ধনী ব্যবসায়ী শর্মাজি (অম্বরীশ ভট্টাচার্য), লুব্ধকের সহকর্মী লাট্টুর (দেবাশিস রায়) মতো আরও কিছু বিশেষ চরিত্র রয়েছে, যারা গল্পে নানা পরত সংযোজন করে। ছবিতে না-মানুষদের অধিকারের প্রশ্নটিই বারবার উঠে আসে, কিন্তু তার জবাব হিসেবে উঠে আসে শুধু হত্যালীলা। নৃশংস হত্যালীলা! পুলিশের নাকের ডগায়, সিসিটিভির ঘেরাটোপের মধ্যেই কুকুরের মুখোশ পরে ভিলেনদের শায়েস্তা করে চলে নায়ক। মুখোশের রূপকটি এখানে চিরাচরিত কায়দায় দেখানো হয়েছে, হালকা ঘাড় হেলানোর ভঙ্গিটি-সহ! ‘ওদের থাবায় ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই’ কিংবা ‘মরে গেলে তো সবাই মাংস’-র মতো উচ্চকিত সংলাপও এমন ছবিতেই সুপ্রযুক্ত হতে পারে!

রক্তপাত না দেখিয়ে যদি বিদেশি জাতের বদলে ‘পারিয়া’দের দত্তক নেওয়া, তাদের ভ্যাকসিনেশন, পার্ভো নিয়ে সচেতনতা কিংবা ব্যবসার স্বার্থে ব্রিডিং করানোর বিরোধিতা নিয়ে দু’-চার কথা থাকত গল্পে, তা হলে হয়তো সফল ভাবে ছবিটির আসল উদ্দেশ্য ধরা দিত। যদিও এনজিও-র দ্বিচারিতা, ডগ রেসের অন্ধকার দিকগুলি এখানে যথার্থই তুলে ধরা হয়েছে। কুকুরের মাংস দেশের উত্তর-পূর্বে সরবরাহ করা নিয়েও যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা একপেশে ও অতিরঞ্জিত। খাবার হিসেবে পশুমাংসের ব্যবসায়িক লেনদেন আর কুকুরের প্রতি মমত্বকে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে চিত্রনাট্যে। এলোপাথাড়ি অ্যাকশন আর পর্দায় বিক্রমের পরাক্রম দেখাতে গিয়ে শেষে দড়িতে ঝোলানো ক্লিপ হাতেও শত্রু নিকেশ করতে হল নায়ককে!

Advertisement

বিক্রম চিত্রনাট্যের দাবি মেনে যথাসাধ্য করেছেন এ ছবির জন্য। শরীরী সৌষ্ঠব থেকে তাঁর অ্যাকশনময় ঝাঁঝালো উপস্থিতি যে কোনও বাঙালি নায়কের কাছে ঈর্ষণীয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রে নিজের চেনা ম্যানারিজ়ম ছেড়ে বেরোতে পারেননি যদিও। কিছু দৃশ্যে অতিঅভিনয় ছাড়া অঙ্গনাকে মন্দ লাগে না। লোকনাথ দে, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শ্রীলেখা মিত্রের মতো শক্তিশালী অভিনেতারা তথাগতর ছবির জোরের জায়গা। এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রগুলি অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। ‘গা ঘিনঘিনে’ শব্দটিকে মানুষের রূপ দিয়েছে সৌম্য মুখোপাধ্যায় অভিনীত মাংসব্যবসায়ী কসাইয়ের চরিত্রটি। মানসিক ভাবে সে যে অসুস্থ, তা সৌম্যর অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লাট্টুর চরিত্রে দেবাশিসের কাজ চোখে পড়ার মতো। যদিও তাঁর মধ্যে ‘ওম শান্তি ওম’-এর বিনয় পাঠকের চরিত্রটিকে নকল করার হালকা প্রয়াস নজরে আসে। ছবির দৃশ্যগ্রহণ, সঙ্গীত কোনওটিই তেমন দাগ কাটে না। রণজয় ভট্টাচার্য আবহে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, গল্পের মেজাজ অনুযায়ী। তবে পঞ্চেন্দ্রিয়কে ধাক্কা দেওয়া এ ছবি পারিয়াদের উপরেই আর একটু আলো ফেলতে পারত।

অবোলা প্রাণীদের গুরুত্ব দিয়ে ছবি বাংলায় কমই হয়েছে। তাদের প্রতি মমত্ববোধ থাক বা না থাক, তাদের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে কাজ করার, লড়াই করার প্রয়োজন আছে বইকি। সে দিক থেকে বিষয় নির্বাচনের জন্য পরিচালকের সাধুবাদ প্রাপ্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement