Review of Panchayat 3

পঞ্চায়েত ৩: সততা আর সারল্য বনাম কোটি টাকার বোকামো

দু’শো-তিনশো কোটি টাকা বাজেটের বলিউডি ছবি দেখতে দেখতে বহু দিন চোখে পড়েনি নিপাট গ্রামজীবনের সরল গল্প। অথচ খবরের পাতায় রোজই পড়ছি, উত্তর বা মধ্যপ্রদেশের গ্রামে আজও প্রান্তিক মানুষের জীবন প্রাগৈতিহাসিক।

Advertisement

দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ ১৫:৩৭
Share:

‘পঞ্চায়েত ৩’ সিরিজ়ের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

বহু দিন পর একটা সিরিজ় দেখে ঘোর কাটছে না কিছুতে।

Advertisement

‘পঞ্চায়েত’ নামের এ সিরিজ়ের আগের দু’টি পর্বেও একই জিনিস ঘটেছিল। মনে হয়েছিল, আমিও যেন ফুলেরা গ্রামেরই এক বাসিন্দা। এই প্রত্যন্ত গ্রাম, গ্রামের সমস্ত চরিত্রদের সঙ্গে এতটা একাত্ম শেষ কোন সিরিজ় দেখে হয়েছি, মনে পড়ছে না। জানি, এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। ‘পঞ্চায়েত’ নামের এ সিরিজ়ে জাদু আছে নিশ্চিত। আর রয়েছে সারল্য এবং সততার সঙ্গে গল্প বলা, যা একটানা আপনাকে সিরিজ় শেষ না করে উঠতে দেবে না। তাই বিগত কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তি-যৌনতা-বিপুল টাকা না থাকলেও সারা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এই সিরিজ় ‘পঞ্চায়েত’, যার তিন নম্বর সিজ়ন মুক্তি পেল গতকাল।

সারা দেশের নির্বাচনের তুঙ্গ মুহূর্তেই মুক্তি পেল ‘পঞ্চায়েত ৩’। তাই সুরটা যেন বেশ কিছুটা চড়া, আগের সিজ়নগুলির তুলনায়। এবং চড়া হওয়ার কারণ অবশ্যই এ সিরিজ়ে রাজনীতির আধিক্য। আগের সি‌জ়নগুলিতে যে নিপাট সারল্য আর ছেলেমানুষি বন্ধুতার গন্ধ ছিল, এ সিজ়নের শুরু থেকেই যেন তা বদলে কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। আগের সিজ়নের উপপ্রধানের পুত্রের সৈন্যবাহিনীতে গিয়ে মৃত্যুর পর থেকেই গল্প যেন বেসুর বাজছিল। পাশাপাশি, বিধায়কের দলের বচসার পরও মনে হচ্ছিল, এ বারে হাওয়া ঘুরবে। আর নেহাত শহুরে যুবকের গ্রামে গিয়ে পদে পদে নাজেহাল হওয়ার মজা বা বোকামিতে আটকে থাকবে না ‘পঞ্চায়েত’। ঘটলও তাই।

Advertisement

গ্রামজীবন আমরা সিনেমা বা টিভির ইতিহাসে পর্দায় বারে বারে ফিরে আসতে দেখেছি খুব গুরুত্বের সঙ্গে। তা সে ‘পথের পাঁচালী’ হোক বা ‘শোলে’ বা ‘মালগুডি ডেজ়’। ‘পঞ্চায়েত’ দেখতে দেখতে সেই সব ক’টি গ্রামকেই কেন যেন আবার মনে পড়ে গেল। মিলটা কোথায়? এককথায় বলতে গেলে, সারল্যে। প্রধানের বদলে সেখানে গ্রামকে সামলাচ্ছে প্রধানের স্বামী, তাঁকেই প্রধান বলে মানে গ্রামবাসী, শহুরে সচিব হতাশ হয়ে সপ্তাহান্তে মদ্যপান করে দরজা খুলে ঘুমোলে তার ঘরের কম্পিউটার তুলে নিয়ে যায় সেখানকার স্থানীয় চোর, সিসিটিভি লাগানোর বদলে কার ছাগল চুরি হয়েছে তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছাগলের মালিক দেখে যায়, দুটো বাচ্চার বেশি সন্তান জন্ম দেওয়া অপরাধ লিখলে তা নিয়ে বচসা বেধে যায় গ্রামবাসীদের মধ্যে, শৌচালয় বা পাকা বাড়ির ভাগাভাগি নিয়ে লড়াই করছে গ্রামবাসীরা। এর পাশাপাশি আবার সচিবের ভালোমানুষিকে পুলিশ সন্দেহ করলে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিচ্ছে প্রধান, জেলাশাসককে ঘুষ দিতে ক্ষেতের ফসল নিয়ে যাচ্ছে তারা, বিধায়কের সঙ্গে সম্মুখসমরেও পিছপা হচ্ছে না এই ছোট্ট গ্রামের বোকাসোকা মানুষগুলো। আবার, উপপ্রধানের ছেলে মারা গেলেও শোকের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। দেখতে দেখতে আমারও কান্না পাচ্ছে। চোখ মুছছি। তার পর, সচিবের সঙ্গে প্রধানের মেয়ের প্রেম ঘনিয়ে এলে নিজের অজান্তেই বলছি, সচিব যেন এ গ্রাম ছেড়ে বড় চাকরি নিয়ে চলে না যায়, হে ঠাকুর...

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আসলে দুশো-তিনশো কোটি টাকা বাজেটের বলিউডি ছবি দেখতে দেখতে বহু দিন চোখে পড়েনি নিপাট গ্রামজীবনের সরল গল্প। অথচ খবরের পাতায় রোজই পড়ছি, উত্তর বা মধ্যপ্রদেশের গ্রামে আজও প্রান্তিক মানুষের জীবন প্রাগৈতিহাসিক। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে যে, আজ আর তিস্তাপাড়ের বাঘারু বা ঢোঁড়াইয়ের গল্প লেখার কেউ নেই। ‘শোলে’র জয় আর বিরুও তো সেই সত্তর দশকেই শেষ গ্রামের দুই উদ্দাম যুবক! তাই হঠাৎ ‘পঞ্চায়েত’-এর এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পর মনে হচ্ছে, আসলে আমরা, দর্শক ভাল গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। দর্শক বদলে গিয়েছে, এ কথা ভুল। একটা নিপাট গল্প দেখতে আজও মুখিয়ে থাকি আমরা, ভারতবাসীরা। তা সে শপিংমলের হোক বা বনগাঁ লোকালের। গল্প আমরা পাই না, তাই সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর এত আহ্বানের পরেও মুখ ফিরিয়ে নিই বার বার।

কিন্তু ‘পঞ্চায়েত’ থেকে মুখ ফেরানো গেল না আবারও। বরং ফুলেরা গ্রামের প্রধান ও তাঁর দলবল আবারও দর্শক টেনে নিল তাদের দলে। সিরিজের শেষে এসে তাই সচিবের সঙ্গে প্রধানের মেয়ের প্রেমটা কখন হবে, তা বহু যুগের ও পার থেকে ডাক পাঠাল। কেন প্রেমটা জমছে না, তা নিয়ে তিলে তিলে কষ্ট হল। প্রধান গুলি খেলে সে গুলি যেন এসে লাগল আমারই বুকে। কান্না পেল খুব। খুব। ঠিক যতটা আনন্দ হয়েছিল দেখে, প্রধানদের সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে বিধায়ক।

‘পঞ্চায়েত-৩’ আসলে আজকের গ্রামীণ ভারতেরই এক খণ্ড আখ্যান। যেখানে প্রতিটি চরিত্র এতটাই সাবলীল যে, মনেই হয় না কেউ অভিনয় করছেন। প্রথমেই বলতে হয় রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তের কথা। প্রধান ও প্রধানের স্ত্রীর ভূমিকায় অনবদ্য ও তুলনাহীন তাঁরা। সচিবের ভূমিকায় শহুরে যুবকের গ্রামে গিয়ে অসহায়তাকে অসাধারণ ফুটিয়ে তোলেন জিতেন্দ্র কুমার। উপপ্রধানের ভূমিকায় অম্লমধুর চরিত্রে দারুণ ফয়জ়ল মালিক, যেমন বিধায়কের ভূমিকায় পঙ্কজ ঝা দুরন্ত। এ ছাড়াও প্রতিটি চরিত্রের কথাই আলাদা ভাবে লিখতে ইচ্ছে করছে, এতটাই নিখুঁত প্রত্যেকে। নির্মাতাদেরও ধন্যবাদ, আগাগোড়া স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য।

‘পঞ্চায়েত ৩’ সিরিজ়ের একটি দৃশ্য।

প্রধানের মোবাইলের রিংটোনটা এখনও বার বার কানে বাজছে, আপনমনেই হাসছি তার পর। ফুলেরা গ্রামে বিজলি বাতি, সিসিটিভি লাগানো গেলেও এখনও রাস্তা সারানো গেল না। সচিবের বড় চাকরি বা প্রেম, এখনও কোনওটারই পাকা খবর মিলল না। খেলায় শেষমেশ ভূষণ আর বিধায়কেরা জিতবে, না সচিব আর প্রধানেরা— তার জন্য পরের পর্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল জেনে যাব আমরা। জানব, এই গ্রামীণ বাস্তবতা বদলাবে না। দুর্নীতি আরও বাড়বে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু ৩ নম্বর সিজ়নের পর আপাতত এটুকুই স্বস্তি, ভারতের নাম বহু দিন পর কান চলচ্চিত্র উৎসবে মঞ্চে শোনা গিয়েছে। এবং তা শোনা গিয়েছে আনকোরা নতুন ছবি-করিয়েদের জন্যেই। ফুলেরা গ্রামের এই সরল মানুষগুলোর বন্ধুত্ব আর শত্রুতার এ হেন আখ্যানমালা দেখে আশা জাগছে কোটি কোটি টাকার বলিউডি বোকামো পেরিয়ে আমাদের ক্যামেরা আবার দেখতে পাবে সাধারণ গ্রামের জীবন, সাধারণ মানুষ, যাদের কোনও আড়ম্বর নেই, থাকার মধ্যে রয়েছে স্রেফ সততা। যা কোটি টাকা দিয়েও কেনা যায় না। হয়তো কোনও দিন যাবেও না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement