আলিগড় নেই আলিগড়ে! সেই শহরের মিলাত বেদারি মুহিম কমিটি নামের মুসলিম-সংগঠন জানিয়েছে, হনসল মেটার ছবিটি তারা দেখাতে দেবে না। কারণ, ‘‘আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির দৌলতে এই শহর শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। সিনেমার নামটা তাই অপমানজনক। ছেলেমেয়েদের আর কেউ এখানে পাঠাবে না। ভাববে, জায়গাটা সমকামীদের আখড়া।’’ সেন্সরের ছাড়পত্র থাকা সত্ত্বেও হুমকিতে ব্যতিব্যস্ত প্রদর্শকেরা তাই সেই শহরে ছবি দেখাতে পারছেন না। মিলাতের উটকো দাবির সমর্থনে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছেন বিজেপি মেয়র শকুন্তলা ভারতী: ‘ছবিটা এই শহরে দেখানো যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছি।’ অসহিষ্ণুতার আবহে পরিচালক হনসল মেটা ছবিটি অন্য ভাবে তৈরি করেছিলেন। বিশেষ কোনও সম্প্রদায়কে দাগাতে চাননি বলেই ছবির দৃশ্য, সংলাপ সর্বত্র বলা হয়েছে আলিগড় ইউনিভার্সিটি। কিন্তু গোঁড়ায়-গোঁড়ায় মাসতুতো ভাই!
ওই আলিগড় ইউনিভার্সিটি ছাড়া এই ছবির সব চরিত্র ও পটভূমি বাস্তব। ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্টের রায় ছিল, ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামিতাকে আর অপরাধ বলে গণ্য করা যাবে না। তার পরও এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে সমকামিতার অভিযোগে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি তাদের মরাঠি ভাষার অধ্যাপক শ্রীনিবাস রামচন্দ্র রাওকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার তৎকালীন সাংবাদিক দীপু সেবাস্টিয়ান ফার্নান্ডেজ এই বেআইনি কাজটি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। তাঁর লেখা পড়েই অ্যাক্টিভিস্টরা সাইরাসের হয়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় তাঁদের জয় হয়, সাইরাসকে সসম্মানে পুনর্নিয়োগের জন্য আদালত নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ হস্তগত হওয়ার আগেই তাঁকে ঘরে মৃত অবস্থায় দেখা যায়। ময়নাতদন্তে বিষ পাওয়াও গিয়েছিল। হত্যা, না আত্মহত্যা?
পরিচালক হনসল মেটার সবচেয়ে বড় গুণ, এই হত্যা-আত্মহত্যা নিয়ে তিনি থ্রিলার তৈরির চেষ্টা করেননি। বরং মোক্ষম একটি প্রশ্ন তুলেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে অন্যের বেডরুমে উঁকি দেওয়ার আদৌ কোনও অধিকার কি আমাদের আছে? কে সমকামী, কে বিষমকামী এটা সেক্সুয়াল চয়েস। ব্যক্তির বাছাই, পছন্দ-অপছন্দের অধিকার থাকবে না? ছবিটির গুরুত্ব এখানেই। হত্যা না আত্মহত্যা, সাইরাস সত্যিই সমকামী ছিলেন, নাকি সহকর্মীদের চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন, সেই সব ছেঁদো প্রশ্নে নয়।
এই চিত্রনাট্যে সাইরাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের মলয়ালম ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক শ্রীধরণ, উপাচার্য পি কে আব্দুল আজিজ, সাংবাদিক দীপু সেবাস্টিয়ান সকলে বাস্তব চরিত্র। শুরুতে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ নামের প্রথাগত নোটিস সেঁটেও তার পর বাস্তব ঘটনা এবং চরিত্রদের নিয়ে ছবি...এখানেই সিনেমার সততা।
সমকামিতা নিয়ে অহেতুক আতঙ্কের এই হোমোফোবিক দেশে ছবিটা তাই উজ্জ্বল উদ্ধার। এর আগে ওনিরের ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ বা ‘আই অ্যাম’ ছাড়া বলিউডের বেশির ভাগ ছবিতেই সমকামিতা মানে এক ধরনের ক্যারিকেচার। ‘দোস্তানা’ ছবিতে অভিষেক বচ্চন আর জন আব্রাহাম নিজেদের সমকামী ঘোষণা করে ঘর ভাড়া নেবেন, লোকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে। প্রাদেশিক সাহিত্য, নাটক অবশ্য সেই বলিউডি চ্যাংড়ামির বাইরে গত কয়েক বছর ধরে অন্য ভাবে ভাবছিল। বাংলা ভাষায় নবনীতা দেবসেনের ‘বামাবোধিনী’ এবং ‘অভিজ্ঞান’ নামে দুটি উপন্যাস রয়েছে। সেখানে বিবাহিত পুরুষ সংসার ছেড়ে চলে যান বিদেশে পুরুষসঙ্গীর কাছে। সমকামিতার অভিযোগে মেনস্ট্রিম সমাজ এক অধ্যাপককে কী ভাবে নিঃসঙ্গ করে দেয়, ধরা পড়েছিল ব্রাত্য বসুর ‘কৃষ্ণগহ্বর’ নাটকে। হনসল মেটার ছবির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তিনি আলিগড় নামের এক শহর, একটি বিশ্ববিদ্যালয়, সমকামিতা এই ক্ষুদ্র বৃত্তগুলিকে গুরুত্ব দেননি। বরং বলিউডি ছক ভেঙে ছবিটাকে নিয়ে এসেছেন বৃহত্তর সর্বভারতীয় সহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে। মেনস্ট্রিম সমাজ কি সমকামী লেবেল লাগিয়ে সাইরাসদের এ ভাবেই নিঃসঙ্গতার ধূসর প্রান্তে ঠেলে দেয়? ছবির এক জায়গায় দীপু (রাজকুমার রাও) সাইরাসবেশী মনোজ বাজপেয়ীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘গে’ বলেই কি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাবে অচ্ছুৎ হতে হল? মনোজের জবাব, ‘ওই তিন অক্ষরে আমার অনুভূতিকে ধরা যায় না। যেটা লেখা হয় না, সাদা পৃষ্ঠার সেই অংশটুকুই কবিতা।’ প্রতিবাদের ঝোঁকে মিলাত বেদারি, শকুন্তলারা বোঝেননি, আলিগড় প্রকৃত প্রস্তাবে অনুভবমুখর এক কবিতা।
কবিতার অন্যতম দিকচিহ্ন, মনোজ বাজপেয়ীর অভিনয়। হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গি, সবই বদলে ফেলেছেন ‘সত্য’ ছবির গ্যাংস্টার ভিখু মাত্রে। কখনও তিনি সাংবাদিককে দেখে রেগে যান, ‘আমাকে সার্কাসের জোকার পেয়েছেন?’ পরে সেই সাংবাদিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে তিনি অনেক নম্য। এমনকী রেস্তোরাঁয় ‘আপনাকে তো হ্যান্ডসাম দেখতে’ বলার পর হাসিতে লজ্জা ও গর্ব এক সঙ্গে ফুটে ওঠে।
অন্ধকার ঘরে রেডিওতে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘আপকি নজরোঁ নে সমঝা’, আর সেই গানে বেসুরো গলা মেলাতে মেলাতে মনোজ ঘুমিয়ে পড়ছেন, তৃতীয় পেগ হুইস্কি ঢালার আগে অতিথিকে জিজ্ঞেস করছেন‘অ্যাম আই ড্রাঙ্ক?’ ইত্যাদি জায়গা চমৎকার।
এই সিনেমাটিক অভিনয়ে চমৎকার সঙ্গত করেছে সত্যরাজ নাগপালের ক্যামেরা। অন্ধকার রাস্তায় লং শটে রিকশা আসে, তার পর মরা হলুদ রঙের বাড়ি। মাঝে মাঝে খাঁচার মতো বাড়িটার পাশে অন্ধকার ফ্লাইওভার দিয়ে বাস ছুটে যায়। দমবন্ধ এক ক্লস্ট্রোফোবিক দুনিয়া, লোকের আক্রমণের ভয়ে নিজেকে সারাক্ষণ ফ্ল্যাটের মধ্যে বন্দি রাখেন মনোজ। নিচু তারে বাঁধা এই অভিনয় ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এ ছিল না। ফলে এই ছবিটাই মনোজের সেরা।
মনোজের পাশাপাশিই থাকবেন দীপু সেবাস্টিয়ানের চরিত্রে রাজকুমার রাও। তরুণ সাংবাদিকের মতোই ছটফটে এবং সতর্ক। মনোজকে বাড়িওয়ালা দূর করে দেওয়ার পর অন্য সাংবাদিকেরা বুম হাতে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন লাগছে?’ দীপু কখনও এই জাতীয় বোকা বোকা প্রশ্ন করে না। বরং মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করে। স্থানীয় টিভি চ্যানেলের এক দল সাংবাদিক নীতির বালাই না রেখে সাইরাসের বাড়িতে অন্ধকারে স্টিং অপারেশন চালিয়ে রিকশাওয়ালা ও অধ্যাপককে এক বিছানায় আবিষ্কার করেছিল। দীপুর জিজ্ঞাস্য, ‘কিন্তু আপনার তো প্রাইভেসির অধিকার আছে। দরজায় তিনটে তালা। তা হলে আপনার অজান্তে তালাগুলি কেউ খুলে রেখেছিল?’ দুই ধরনের দুই সাংবাদিক। সিনেমায় নেই, কিন্তু আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখপাত্র একদা বলেছিলেন, ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্থানীয় ক্যামেরাম্যানদের দিয়ে ওই স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছিল। তার কয়েক বছর আগে সাইরাসের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিল, প্রমাণ করা যায়নি। হনসল মেটার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তিনি কোথাও অভিযোগের আঙুল তোলেননি। কিন্তু অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলিতেও চেয়ার দখলের জন্য যে এক ধরনের মাফিয়ারাজ অস্বাভবিক নয়, নিঃশব্দে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তৃতীয় উল্লেখ্য: আইনজীবীর চরিত্রে আশিস বিদ্যার্থী। ‘গে’ পার্টিতে দুই পুরুষের পরস্পর নাচ ও চুম্বনের দৃশ্যটিও চমৎকার। ছবির রিলিজ টাইমটি মোক্ষম। সুপ্রিম কোর্ট একদা দিল্লি হাইকোর্টের রায় নাকচ করে দিয়েছিল, এখন ৩৭৭ ধারা ফের খতিয়ে দেখছে তারা। কিন্তু সেটিই সব নয়। মরাঠি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক সাইরাস এক জায়গায় বলে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ২০ বছর পড়িয়েছে। জায়গাটাকে ভালবাসে। তবু এখানে সে আউটসাইডার। উর্দু ভাষার মাঝে মরাঠি ভাষা, মুসলিমপ্রধান জায়গায় নাগপুরের হিন্দু অধ্যাপক কি বহিরাগতই রয়ে যান? রেস্তোরাঁয় দীপুকে সাইরাস বলেন, ‘বাটিটা ছুঁয়ে দিলে? আমি নিরামিষ খাই।’ বোঝা যায়, সংখ্যাগুরুর হাতে আক্রান্তরাও ছাড়তে পারেন না নিজস্ব সংস্কার। আলিগড় কোনও স্লোগান দেয় না, অ্যাক্টিভিজমের কথা বলে না। বরং সংখ্যালঘুর নিঃসঙ্গতাকে কবিতার মতো মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে তুলে ধরে।