Toofan Movie Review

তুফান: যুক্তি-তর্কে না গিয়ে, স্রেফ আরাম করে বসে বিনোদনটুকু ছেঁকে নেওয়ার ছবি

প্রযোজনা সংস্থার দাবি, কলকাতায়ও ছবিটি প্রথম সপ্তাহেই দারুণ ব্যবসা করছে। কী রয়েছে এই ছবিতে, যাতে এত অনায়াস হচ্ছে বাণিজ্যিক সাফল্য? ‘তুফান’ ছবিকে ঘিরে কেন এত উন্মাদনা?

Advertisement

অতীন্দ্র দানিয়াড়ী

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৪ ১৯:০০
Share:
Poster of the film Toofan

‘তুফান’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

সব ছবিই বাণিজ্যিক। ছবি তৈরি করার জন্য একজন প্রযোজকের প্রয়োজন, যিনি লাভের কথা ভেবে ছবিতে টাকা লগ্নি করেন। পরিচালক, অভিনেতা এবং অন্য কলাকুশলীরা তাঁদের দক্ষতা দিয়ে প্রযোজককে লাভের মুখ দেখানোর চেষ্টা করেন। তার বদলে তাঁরা পারিশ্রমিক পান। এটাই একটি সফল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান শর্ত।

Advertisement

বাংলাদেশের পরিচালক রায়হান রাফীর ‘তুফান’ ছবিটি সেই শর্ত মেনেই নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও আরও দশ-বারোটি দেশে মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশে এই ছবির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। ছবিটি দেখার জন্য সেখানে প্রেক্ষাগৃহের সামনে লম্বা লাইন, এমনকি একটি টিকিট পাওয়ার জন্য মারদাঙ্গা, ভাঙচুরের খবরও পাওয়া গিয়েছে। প্রযোজনা সংস্থার দাবি, কলকাতায়ও ছবিটি প্রথম সপ্তাহেই দারুণ ব্যবসা করছে। কী রয়েছে এই ছবিতে, যাতে এত অনায়াস হচ্ছে বাণিজ্যিক সাফল্য? ‘তুফান’ ছবিকে ঘিরে কেন এত উন্মাদনা?

image of Mimi Chakraborty

‘তুফান’ ছবির একটি দৃশ্যে মিমি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

ছবির গল্প মূলত দু’জন একই রকম দেখতে যুবককে নিয়ে, যে দুই যুবকের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন ও পার বাংলার ‘সুপারস্টার’ শাকিব খান। ছবি শুরু হয়, এক জন শান্ত, নিরীহ, মধ্যবিত্ত ঘরের যুবকের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে, যে স্বপ্ন দেখে একদিন বড় অভিনেতা হবে। কিন্তু কেউ তাকে সামান্য সুযোগও দেয় না। ফলে দিনের পর দিন ‘জুনিয়র আর্টিস্ট’ হয়েই থেকে যেতে হয়। স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য শান্ত (ছবিতে চরিত্রের নামও শান্ত) আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু সব জায়গা থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরই পর্দায় আসে হুবহু শান্তর মতো দেখতে এক নৃশংস মাফিয়া ডন গালিব বিন গনি। সহমর্মিতা, মমত্ববোধ ইত্যাদি শব্দগুলো যার অভিধানেই নেই। মানুষকে খুন করাটা যার কাছে মশা-মাছি মারার থেকেও সহজ ঘটনা। সেই ভয়ঙ্কর ডন একদিন শান্তর সন্ধান পায়। ছবির আসল চমক এখান থেকেই শুরু হয়। জুনিয়র আর্টিস্ট শান্তর কপাল খুলে যায়, সে এক ডনের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যায়। এর পর গল্প এগোতে থাকে তার নিজস্ব গতিতে। চোখা চোখা সংলাপ এবং অফুরন্ত অ্যাকশন দর্শকদের আসন থেকে নড়তে দেয় না। ছবির শেষে শান্ত এবং ডনের কী পরিণতি হয়, সেটাই ‘তুফান’ ছবির তুরুপের তাস, যা দেখার জন্য দর্শককে হলে যেতে হবে।

Advertisement

ছবি সম্পর্কে কিছু কথা বলার আগে একটা কথা অবশ্যই বলে নেওয়া দরকার, এই ছবি দেখতে বসে কেউ যুক্তি-তর্কের কথা ভাববেন না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছবিটির একটাই মন্ত্র, বিনোদন, বিনোদন এবং বিনোদন। দর্শকদের একশো শতাংশ বিনোদন দেওয়ার জন্য যদি চূড়ান্ত অবাস্তবতাকেই আশ্রয় করতে হয়, তাতেও কোনও পরোয়া নেই। তাই ছবিটি দেখতে দেখতে যদি দর্শকের মনে হয় এগুলো কেন হচ্ছে, এইটা অযৌক্তিক, ওইটা অবাস্তব ইত্যাদি, তা হলে রায়হান রাফীর ‘তুফান’ তার জন্য নয়।

ছবিটি দেখতে দেখতে দর্শকের মনে ১৯৭৮-এর ‘ডন’ বা ২০২৩ সালের ‘অ্যানিম্যাল’ ছবি ভেসে উঠতেই পারে, জনপ্রিয় হিন্দি ছবির বেশ কিছু দৃশ্যের সঙ্গে এই ছবির অনেক দৃশ্যের মিল পেতেই পারেন। ছবি দেখতে দেখতে ভাবতেই পারেন, ছবিতে এত হত্যা, এত রক্ত, এত সন্ত্রাসের কি খুব প্রয়োজন ছিল? উত্তরে হয়তো পাওয়া যাবে সেই একটাই শব্দ— বিনোদন। আড়াই ঘণ্টার ভরপুর বিনোদন নিয়ে দর্শক বাড়ি ফিরলেন কি না, সেটাই এই ছবির একমাত্র লক্ষ্য।

‘তুফান’ ছবির একটি দৃশ্যে শাকিব খান। ছবি: সংগৃহীত।

ছবির প্রথমার্ধ জুড়েই জুনিয়র আর্টিস্ট শান্ত। মূলত কমেডিকে আশ্রয় করেই এই সময় ছবির গল্প এগিয়ে চলে। কাহিনির গতি একটু শ্লথ, বলতেই হয়। পোশাকশিল্পী জুলি (মাসুমা রহমান নাবিলা)-র সঙ্গে তার প্রেম বেশ কৌতুকের দৃশ্য তৈরি করে। এই সময়, বেশ কিছু দৃশ্যে শাকিব খানের অভিনয় খুব সাদামাঠা মনে হয়। চিত্রনাট্যের দিকেও মনে হয় আরও একটু নজর দেওয়া যেত।

পর্দায় নায়িকা সূচনা (মিমি চক্রবর্তী) এবং ডনরূপী শাকিব খানের আবির্ভাবের পর থেকেই শুরু হয় একেবারে অন্য রকম একটি ছবি। সিনেমার ছন্দ, লয়, বদলে গিয়ে পর্দায় যেন ‘তুফান’ আসে। হাতে মদের গ্লাস, ঠোঁটে জলন্ত সিগারেট নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে মানুষ মারতে মারতে ডনের সাম্রাজ্য বেড়ে চলে। মানুষের মৃতদেহের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া নৃশংস এক গ্যাংস্টারের চরিত্রে শাকিব খান পর্দায় এক অন্য মেজাজ নিয়ে আসেন। তাঁর হাঁটাচলা, চাহনির প্রতিটি মুহূর্ত যেন বিনোদনের জ্বলন্ত উনুনে তৈরি হটকেক। যে হটকেকের স্বাদ পেতে বাংলাদেশের মানুষ দলে দলে ভিড় করছেন প্রেক্ষাগৃহে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ডনের প্রেমিকা সূচনার চরিত্রে মিমি চক্রবর্তীকে ভাল লাগে। ডনের সহকারীর চরিত্রে লোকনাথ দে-র অভিনয় নজর কাড়ে। ছবির আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ‘আক্রম’-এর ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় মনে রাখার মতো।

সম্পূর্ণ বিনোদন নির্ভর ছবি ‘তুফান’-এর সিনেমাটোগ্রাফি ও সঙ্গীত উপভোগ্য। ‘উড়া ধুরা’ এবং ‘দুষ্টু কোকিল’ গানে সেট, আলো এবং ক্যামেরার কাজ মনোরম। এই দুই গানের দৃশ্যে মিমি চক্রবর্তীকে দেখে সত্তরের দশকের হেলেনকে মনে পড়ে। বলিউড বা দক্ষিণের মূল ধারার ছবিতে এমন ধরনের গানের চিত্রায়ণ লক্ষ্য করা যায়।

তবে, চিত্রনাট্যে দ্বৈত চরিত্রের শাকিব খানকে জায়গা করে দিতে গিয়ে অনেক দক্ষ অভিনেতাকেই কোণঠাসা করা হয়েছে। পর্দায় তেমন কিছু করার থাকে না তাঁদের, বলা যায় এটিই এই ছবির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। বাণিজ্যিক ছবির ধারাকে মাথায় রেখে, ছবির আবহসঙ্গীত ভাল হলেও মাঝেমাঝে খুবই উচ্চ দাগের এবং একই রকম হওয়ায় বেশ একঘেয়ে লাগে। যুক্তি-তর্কের কথা না বলেও এটুকু স্বচ্ছন্দে বলা যায়, চিত্রনাট্যে কিছু কিছু জায়গায় সামান্য যুক্তির প্রয়োজন ছিল। যেটি থাকলে ছবিটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। একটু যুক্তিযুক্ত নাটকীয় সংঘাত এবং আর একটু ঝরঝরে চিত্রনাট্য বোধহয় ছবিটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারত, তখন দর্শক একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা পেতেন। ছবির শেষে ‘তুফান ২’-এর আগাম ঘোষণায় সেই প্রত্যাশাই রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement