‘তুফান’ মুক্তির পর আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি পরিচালক রায়হান রাফী। ছবি: সংগৃহীত।
‘তুফান’ বাংলাদেশের বক্স অফিসে নজির গড়ার পর এ পার বাংলায় মুক্তি পেয়েছে। দুই বাংলার ছবি, সীমান্তের দু’দিকের সুবিধা-অসুবিধা এবং বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্প্রতি এক বিকালে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন পরিচালক রায়হান রাফী।
প্রশ্ন: ভারতে মুক্তি পেল ‘তুফান’। আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
রায়হান: খুবই ভাল। যাঁরা ছবিটা দেখছেন, তাঁদের ভাল লাগছে। এখানে একটা কথা বলে রাখতে চাই। বাংলার সিংহভাগ দর্শক সহজ-সরল। তাঁদের কথা ভেবেই ছবির ভাবনা। কারণ প্রচারের শুরুতেই আমি বলে দিয়েছিলাম, ‘কেজিএফ’, ‘পুষ্পা’ বা ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ছবি ‘তুফান’।
প্রশ্ন: কিন্তু সমাজমাধ্যমে ছবির ব্যবসা নিয়ে নানা মতও চোখে পড়ছে।
রায়হান: দেখুন, ‘পাঠান’ বা ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ছবি মুক্তির পরে ভাল-মন্দ বক্তব্য থাকবেই। আমি জানি, চলচ্চিত্র সমালোচকদের কারও হয়তো ‘তুফান’ তেমন ভাল লাগেনি। আমি তাঁদের মতামতকে শ্রদ্ধা করি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে দুই শ্রেণিকে খুশি করা একটু কঠিন। আগামী দিনে আমরা আরও ভাল করব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ‘হাওয়া’ বা ‘সুড়ঙ্গ’-এর মতো ছবি এ পার বাংলার দর্শকের পছন্দ হলেও ভারতে বক্স অফিসে ছবিগুলির ব্যবসা তো আশানুরূপ নয়।
রায়হান: ‘তুফান’ বড় বাজেটের ছবি। বাংলাদেশে ১০-১৫ দিনের মধ্যে সেই টাকা আমরা ফিরে পেয়েছি। অসাধারণ ঘটনা। তার মানে, বাণিজ্যিক ছবির চাহিদা এখনও রয়েছে। আবার দেখুন, বলিউডের অনেক ছবি কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসা করতে পারছে না। এ পারে ‘হাওয়া’র পর ‘সুড়ঙ্গ’-এর ক্ষেত্রে একটু ভাল ব্যবসা করেছি। ‘তুফান’-এ সেটা আরও একটু ভাল হয়েছে। আমার বিশ্বাস, আগামী দিনে বাংলাদেশের ছবি পশ্চিমবঙ্গে আরও বেশি সংখ্যক দর্শককে আকর্ষণ করবে। এক দিনে তো নজির তৈরি হয় না! ছোট ছোট পদক্ষেপেএকদিন সাফল্য আসবেই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে সিঙ্গল স্ক্রিন বিশিষ্ট প্রেক্ষাগৃহের পরিস্থিতি এখন কী রকম?
রায়হান: খুব একটা ভাল নয়। ‘তুফান’-এর জন্য বেশ কিছু বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ নতুন করে চালু হয়েছে। অনেক হল মালিক ব্যবসায় খুশি। তাঁরা জানিয়েছেন, এই টাকায় তাঁরা আগামী এক-দেড় বছরের হলের খরচ তুলে নিয়েছেন।
প্রশ্ন: এ পার বাংলায় সম্প্রতি যশ-নুসরত ও অঙ্কুশ মূল ধারার ছবি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই ভাবে সাফল্য আসছে না।
রায়হান: আমি তাঁদের ছবিগুলো দেখিনি। তাই মন্তব্য করতে চাই না। তবে সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ছবি ফর্মুলানির্ভর— চারটে গান, একটু অ্যাকশন, একটু প্রেম। বাংলাদেশেও ফর্মুলা ছবি চলে না। আমরা সেটা থেকে বেরিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প বলার চেষ্টা করেছি। গল্প বলার মধ্যে নতুন একটা স্টাইল আনার চেষ্টা করেছি। ‘রকি ভাই’ বা ‘পুষ্পা’র মতো আমরাও বাংলায় একটা চরিত্র তৈরি করতে চেয়েছি। ছবিটা কেউ না দেখতেই পারেন। কিন্তু আমার ধারণা, ‘তুফান’ নামটা কিন্তু মানুষের মাথায় ঢুকে গিয়েছে।
প্রশ্ন: ছবির সিক্যুয়েলের প্রস্তুতি কত দূর?
রায়হান: ইন্টারেস্টিং বিষয়, ভারতে ছবির সেন্সরের সময় সেন্সর বোর্ডের কর্তারা জানতে চেয়েছিলেন কবে সিক্যুয়েল আসবে। আমাদের তিনটে সিক্যুয়েলের পরিকল্পনা রয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় পর্বের ঘোষণা করব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে এখন নির্মাতাদের কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে?
রায়হান: শিল্পসত্তার নিরিখে আমরা কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে রয়েছি। সেন্সর বোর্ডের একটু কড়াকড়ি রয়েছে। তবে তার থেকেও বড় বিষয়, প্রযুক্তি। কলকাতায় শুটিং করতে হলে প্রয়োজনে সহজেই একটা ক্যামেরা মুম্বই থেকে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু, বাংলাদেশ হলে ক্যামেরার জন্য ভিসা করাতে হয়! আবার দেখুন, ‘তুফান’-এর শুটিংয়ে প্রায় ১৫০টি পিস্তল ব্যবহার করেছি। এটা বাংলাদেশে করতে হলে কিন্তু খুব কঠিন হত। পাশাপাশি, এগুলো যে ‘শুটিংয়ের বন্দুক’, তা বোঝানোর জন্য কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতির প্রয়োজন।
‘তুফান’ ছবির একটি দৃশ্যে শাকিব খান ও মিমি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: বাঙালিরা নাকি এখন বাংলা ছবি দেখছেন না বলে শোনা যায়।
রায়হান: বাঙালি হলে বাংলা ছবি দেখতে হবে। বাংলা ছবি নিয়ে নাক সিঁটকানোর অর্থ কিন্তু সে নিজেকেই অপমান করছে। শুনছি, কলকাতার নির্মাতারা নাকি সবাই বলিউডে চলে যাচ্ছেন। কেন সেটা হবে? আমাদের মেধা আমাদের কাছেই থাকা উচিত। আমরা হয়তো কম স্মার্ট। শাকিব আল হাসান ছয় মারলে আমাদের ভাল লাগে, কারণ তিনি আমাদের দেশের ক্রিকেটার। আজকে বিরাট কোহলি ছয় মারলেও আমাদের কিন্তু ভাল লাগে। ক্রিস গেল মারলে ভাল লাগে না। কারণ সেই একটাই। আমরা আমরা একই মানসিকতার মানুষ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ভারতে তামিল, তেলুগু, মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে আগে তাদের ছবিকে অগ্রাধিকার দেয়। তা হলে আমরা কেন পারব না?
প্রশ্ন: ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’ হঠাৎ করেই এ পার বাংলায় কাজ বন্ধ করে দিল। কী সমস্যা হয়েছিল?
রায়হান: ‘চরকি’র কোনও সমস্যা নেই। আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম— বিদেশি ছবির শুটিং হলে দুই থেকে তিন গুণ পারিশ্রমিক দিতে হবে। তাতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রজেক্টকেও ‘আন্তর্জাতিক’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তা হলে আর আমরা দুই বাংলা এক হব কী ভাবে! বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি তো হলিউড বা বলিউড নয়! বেশি টাকা দিয়ে কলকাতায় শুটিং করা আমাদের মতো ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির কর্তাব্যক্তিদের বিষয়টা একটু ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্রশ্ন: ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘তুফান’। ব্লকবাস্টারের হ্যাটট্রিক করে নিজেকে নিয়ে গর্ব হয়?
রায়হান: (হেসে) আমি সৌভাগ্যবান। ছবি হিট করলে পরিচালকেরা অনেক সময়েই এক ধরনের ছবি তৈরি করতে চান। আমি আমার কেরিয়ারে সেটা করিনি। নিজেকে ফর্মুলায় বেঁধে রাখতে চাই না। একটা ছবি ব্লকবাস্টার হলে শুধু ছবির সঙ্গে জড়িত মানুষরা নন, সিনেমাহল থেকে শুরু করে বাইরের খাবার বিক্রেতারাও লাভবান হন। দর্শক বাংলা ছবির পাশে থাকুন, এটাই চাই।
প্রশ্ন: আপনি নাকি এ পার বাংলায় জিতের সঙ্গে ছবি করছেন? ইন্ডাস্ট্রিতে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
রায়হান: (হেসে) আমিও তাই শুনছি। দেখুন, কলকাতার সব শিল্পীর সঙ্গেই আমার কথা হয়। আমি তাঁদের ভক্ত। কেন কাজ করব না! আমি আগে গল্প লিখি। তার পর অভিনেতা নির্বাচন করি। অনুরাগী এবং দর্শকদের বলতে চাই, দয়া করে কোনও গুঞ্জনে কান দেবেন না। ঠিক সময়ে জানতে পারবেন।
প্রশ্ন: ‘তুফান’-এর নেপথ্য অনুপ্রেরণার কথা আপনি বলেছেন। বাংলায় যদি ‘গুপ্তচর ব্রহ্মাণ্ড’ তৈরি করেন, তা হলে সেখানে কারা থাকতে পারেন?
রায়হান: (হেসে) আমার তো ইচ্ছে আছেই। তবে এখনই বলা কঠিন। শাকিব ভাই থাকতে পারেন। আবার দেব বা জিৎও থাকতে পারেন। শাকিবের সঙ্গে চঞ্চল ভাই (চঞ্চল চৌধুরী) আমার ছবিতে আসার পর যেন একটা বিস্ফোরণ হল। কলকাতার সুপারস্টারেরা একসঙ্গে কাজ করলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাণিজ্যিক ছবি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন: আপনি নাকি অভিনেত্রী তমা মির্জ়াকে চলতি বছরে বিয়ে করছেন?
রায়হান: এখনও এ রকম কোনও পরিকল্পনা নেই। আরও কয়েকটা হিট ছবি পরিচালনা করি। তার পর বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে (হাসি)।