ছবির একটি দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত।
শুরুতেই একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। জানা গেল ‘মন্দার’ নামক একটি ওয়েব সিরিজ তৈরি হবে। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য! ব্যস, আলোচনা শুরু— অবশ্যই সমর্থনের তুলনায় বিরোধ ছিল বেশি। কিন্তু মুক্তির পর ‘মন্দার’ যাবতীয় জল্পনায় জল ঢালার পাশাপাশি অনির্বাণকেও দক্ষ পরিচালক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই অনির্বাণের প্রথম ছবি ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।
খুব বেশি গভীরে প্রবেশ না করে স্বল্প পরিসরে কিছু জিনিস আলোচনা করা যেতে পারে। মূলত পরিচালকের সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে। প্রথমত, নাটক থেকে ছবি। ছয়ের দশকে লেখা বাদল সরকারের জনপ্রিয় নাটক এই ছবির আধার। পরিচালক ছবি জুড়ে হরর কমেডির স্বাদ বজায় রেখেছেন। গল্পটা একটু ধরিয়ে দেওয়া যাক। বল্লভপুরের বর্তমান বংশধর রাজা ভূপতি রায় সর্বস্বান্ত। সাত মহলা ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ বিক্রি করতে তিনি এক ফন্দি আঁটেন। কলকাতার ব্যবসায়ী হালদার মশাইকে এই বাড়ি বিক্রি করতে ভূপতির লড়াই ছবির মূল উপজীব্য। তবে তার সঙ্গেই রয়েছে বাড়িতে রয়ে যাওয়া শতাব্দীপ্রাচীন এক পূর্বপুরুষের ভূত। সব মিলিয়ে এক রাতের প্যান্ডেমোনিয়ামে বল্লভপুর রাজবাড়ি সরগরম।
ছবিতে তথাকথিত ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত মুখ নেই বললেই চলে। এখানেই পরিচালক তাঁর মাস্টারস্ট্রোকটি খেলেছেন। আপাত-নতুন মুখের ভিড়ে ছবি জুড়ে যেন বয়ে গিয়েছে টাটকা হাওয়া। রাজার ভূমিকায় সত্যম ভট্টাচার্য এক কথায় অসাধারণ। কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রতি সুবিচার করার পাশাপাশি রঘুদা চরিত্রটিকেও তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। ছন্দার ভূমিকায় সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ সপ্রতিভ। ছবির কমেডির হাল যাদের হাতে সেই ভৃত্য মনোহর (শ্যামল চক্রবর্তী), ব্যবসায়ী হালদার (সন্দীপ ভট্টাচার্য), স্বপ্না (ঝুলন ভট্টাচার্য) বেশ ভাল। তবে অভিনেতাদের অভিনয় মাঝেমধ্যে চড়া দাগের মনে হয়েছে। তিন পাওনাদার সাহা (কৃপাবিন্দু চৌধুরী), শ্রীনাথ (সুরজিৎ সরকার) ও পবনকেও (সুমন্ত রায়) স্বল্প পরিসরে ভাল লাগে। আর এঁদের প্রত্যেককে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালকের। তবে অনির্বাণ ও প্রতীক দত্তর বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্য এবং সংলাপ মূল নাটককেই অনুসরণ করেছে। সিকি ভাগ পরিবর্তন শুধুই ছবির স্বার্থে।
সৌমিক হালদারের ক্যামেরার গুণে ছবিতে বল্লভপুর রাজবাড়ি আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। তাকে যোগ্য সঙ্গত করেছে সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা। টাইটেল কার্ড থেকে শুরু করে ছবির এন্ড স্ক্রোল— পরিচালক সেখানে রেখেছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছোঁয়া। সঙ্গীতে শুভদীপ গুহ ও দেবরাজ ভট্টাচার্যের সঙ্গীত মনে জায়গা করে নেয়। ছবির প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে গতি কিছুটা শ্লথ। তবে তা দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় না।
অতিমারির পর বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। জল মেপে পা ফেলতে কেউ ‘ফর্মুলা’ অনুসরণ করছেন, কেউ নির্দিষ্ট দর্শকমণ্ডলী নিয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরেছেন। অনির্বাণ সেখানে জোর দিয়েছেন কনটেন্টে। জোর দিয়েছেন নিজ দর্শনে। ফলে বল্লভপুরে ঢুঁ মেরে দর্শক হিসেবে প্রাপ্তি একরাশ নতুন বাতাসের স্পর্শ। অনির্বাণ জানিয়েছিলেন আগামী দু’বছর তিনি পরিচালনা থেকে বিরতি চান। কিন্তু বাংলার দর্শক কি রাজি হবেন?