নায়ক

উত্তম-সৌমিত্র, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, ইলিশ-চিংড়ি... বিভাজনপ্রিয় বাঙালি। তবে একটা ব্যাপারে তারা একমত। ‘নায়ক’, একজনই উত্তমকুমার! ‘নায়ক’স্রষ্টার পুত্র সন্দীপ রায়-ও তাই বলছেন। উত্তমের পঁয়ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন বিশপ লেফ্রয় রোডে নিবেদিতা দে।...ঝিরঝিরে শ্রাবণ-সন্ধ্যায়, বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই ঘরে, যেখানে এক সময়ে খেরোর খাতায়, দৃশ্যের পর দৃশ্য তৈরি হয়েছিল কোনও এক জাদুকরের পরশপাথরের ছোঁয়ায়, তার পর তা রূপ নিয়েছিল বাস্তব ‘নায়ক’-এ, সেই ঘরে বসে, সেই টেবিল-চেয়ার-ক্যাবিনেটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো সসঙ্কোচে করেই ফেললাম সন্দীপ রায়কে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ২২:৫৫
Share:

*‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’। সত্যজিত্‌ রায়ের মাত্র দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। কেন?

Advertisement

*ফেলুদার চরিত্রে সত্যজিত্‌ রায় কখনও উত্তমকুমারের কথা ভাবেননি। কেন?

*আচ্ছা, ‘চারুলতা’য় অমল চরিত্রে উত্তম থাকলে কেমন হত?

Advertisement

*উত্তম-প্রয়াণের পর সত্যজিত্‌ যদি ‘নায়ক’ রিমেক করতেন, কাকে নিতেন?

*উত্তম-সুচিত্রাকে জুটি করে সত্যজিত্‌ কোনও ছবি বানালেন না কেন?

প্রশ্নগুলোর যে সোজাসুজি কোনও উত্তর হয় না জানাই ছিল। তবু...

...ঝিরঝিরে শ্রাবণ-সন্ধ্যায়, বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই ঘরে, যেখানে এক সময়ে খেরোর খাতায়, দৃশ্যের পর দৃশ্য তৈরি হয়েছিল কোনও এক জাদুকরের পরশপাথরের ছোঁয়ায়, তার পর তা রূপ নিয়েছিল বাস্তব ‘নায়ক’-এ, সেই ঘরে বসে, সেই টেবিল-চেয়ার-ক্যাবিনেটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো সসঙ্কোচে করেই ফেললাম সন্দীপ রায়কে।

হাসলেন সন্দীপ। তার পর কৌতূহলগুলোকে স্বভাবসুলভ বিনয়ে সরিয়ে রেখে বললেন, “যে-বছর ‘নায়ক’ করলেন বাবা, প্রায় সেই সময়েই রবিকাকুকে (ঘোষ) নিয়ে তপনবাবু (সিংহ) বানিয়েছেন ‘গল্প হলেও সত্যি’, আর তার এক বছর আগে-পরে মৃণালবাবু অপর্ণা-সৌমিত্রকে নিয়ে তৈরি করেন ‘আকাশকুসুম’... সময়টা তখন কী ছিল ভাবতে পারছেন তো? ...স্বর্ণযুগ! সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে উত্তমকুমার, সৌমিত্রকাকুরা ভাগ্যবান যে এমন সব মানুষদের সঙ্গে পেয়েছেন। আর ‘নায়ক’ যখন হয় তখন আমরা এখানে থাকতাম না। থাকতাম লেক টেম্পল রোডে।”

ও! আচ্ছা, সত্যজিত্‌ রায় যখন এত ছবি সৌমিত্রকে নিয়েই করেছেন, তখন ‘নায়ক’-এর বেলায় উত্তম...কী এমন হয়েছিল?

সত্যজিত্‌ রায়ের বাড়িতে বসে তাঁরই পুত্রের কাছে এ প্রশ্ন না করলে সিনেমাপ্রেমী বাঙালি ‘পাপ’ দেবে।

এত কাল লালিত বাঙালির জিজ্ঞাস্য!!

“আচ্ছা, এর কি কোনও উত্তর হয়?” বললেন সন্দীপ। “বাবা তো উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেই ‘নায়ক’ লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনও গল্প থেকে নেওয়া নয়। ওঁকে বাদ দিয়ে কোনও বিকল্পও ভাবেননি... ভাবা যাবে না বলেই ভাবেননি নিশ্চয়ই।”

কিন্তু অনেকেই তো বলেন, সৌমিত্রকে নিয়েও নাকি ‘নায়ক’ করা যেত? প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে সন্দীপ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘নায়ক’-এর সময়...আমি বোধ হয় তেরো কী চোদ্দো...সৌমিত্রকাকু সম্ভবত ত্রিশ-একত্রিশ...উত্তমকুমার চল্লিশ...

...তবে উত্তমকুমারকে আমি দেখি তারও বেশ কিছু দিন আগে। মনে আছে আমার বড়মাসির সঙ্গে উত্তমবাবুর কী ভাবে যেন একটা সম্পর্ক ছিল। বড়মাসি সেই সময় সন্ধ্যা রায়কে ইংরেজি পড়াতেন...তো সেই মাসির জন্মদিনের নিমন্ত্রণে এসেছিলেন উত্তমকুমার। ছাদে পাত পেড়ে খাওয়া হয়েছিল, উনিও সবার সঙ্গে বসে খেয়েছিলেন। তখন উনি বিশাল তারকা! আর অন্যদের মতো আমিও সেই বয়সে ওঁর ভক্ত। খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই বাড়িয়ে দিয়েছিলাম অটোগ্রাফের খাতা, যাতে উনি সই করেছিলেন ‘শ্রীউত্তমকুমার’। আজও সেই খাতা আমার কাছে আছে।

পরে যখন ‘নায়ক’ দেখি...

...ছবির সেই দৃশ্য, যেখানে উনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন এবং পেনে কালি বেরোচ্ছে না বলে টুক করে পেনটা গ্লাসের জলে ডুবিয়ে নিচ্ছেন, আমার মনে হয়েছিল বাস্তব আর ছবির দুটো মানুষ এক্কেবারে এক। কোনও পার্থক্য নেই ব্যবহারে, শরীরী ভাষায়। সত্যিই ‘নায়ক’-এর উত্তমকুমারই ছিলেন রিয়েল লাইফের সেই মানুষটা। যে কারণে অন্য কাউকে নিয়ে কেন ‘নায়ক’ করা হল না, এটা কোনও প্রশ্নই হতে পারে না। ওই ভাবে আর কে বলতে পারতেন, ‘মিস আধুনিকা...’

একটা দুষ্টু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, বলি?

“বলুন।”

আপনি কোনও দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অটোগ্রাফ নিয়েছেন?

...না। আসলে সৌমিত্রকাকু তো ছিলেন আমাদের বাড়িরই ...উনি বাবাকে নানা সময়ে বই-টই উপহার দেবার সময়ে ভেতরে লিখে সই করেই দিতেন...(হেসে) বুঝতে পারছি... মানে আপনি যেভাবে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, ঠিক ওভাবে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় ...তবে হ্যাঁ, নায়কোচিত আদব-কায়দা, ভঙ্গি, ম্যানারিজম...যাকে বলে কমপ্লিট ‘নায়ক’ তা তো ছিলেন উত্তমবাবুই।

প্রসঙ্গ সরিয়ে, সন্দীপ রায় ফিরে গেলেন স্মৃতিতে। মনে আছে, ‘নায়ক’-এর স্বপ্নের সেই টাকার দৃশ্যটা... যেখানে টাকার স্তূপের চোরাবালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন তিনি, তারপর ঝটকা দিয়ে যখন কামরায় ঘুমটা ভাঙল আর হাত গিয়ে পড়ল ট্রেনের জানলার কাচে... ওই যে অভিব্যক্তি...কষ্ট...বেদনা...সব থেকেও একটা ইনসিকিওরিটি...বাস্তবেও উত্তমবাবুকে আমি ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম একবার ঠিক ওইভাবে।

তাই নাকি!

‘নায়ক’-এর পরে সেই ঘটনাটা!

আসলে ছুটি পড়লেই বাবা পুরী নয় দার্জিলিং বেড়াতে যেতেন আমাদের নিয়ে। তো সে বার এক আমন্ত্রণেই আমি-মা-বাবা গেছি দার্জিলিং। উঠেছি, ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হোটেলে। গিয়ে শুনি উত্তমবাবুও এসেছেন ওই হোটেলেই। তখন ‘ছোটিসি মুলাকাত’-এর সমস্যায় উত্তমবাবু জর্জরিত। দার্জিলিং-এ এসেছেন কোনও এক ব্যক্তিগত কাজে।

এক ভদ্রলোক এসে বাবাকে বললেন উত্তমবাবু দেখা করতে চাইছেন। বাবা বললেন, “অবশ্যই, আসতে বলুন।” তো সেই সময়ে দেখেছিলাম...উনি এলেন। একেবারে ভেঙে পড়া চেহারা, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত...যেন ‘নায়ক’-এর সেই বেদনাক্লিষ্ট অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। ঠিক ওই রকম টালমাটাল চেহারা... ওখানেই শুনলাম, ওঁর সঙ্গে ছবির অভিনেতা-কলাকুশলীরা কী ভাবে নন-কোঅপারেট করছে। ক্যামেরা, লোকেশন সমস্ত ভাড়া নিয়ে বসে...অথচ আর্টিস্টরা আসেননি। টাকা বেরিয়ে গেছে জলের মতো...আর উনিই ছবির প্রডিউসর...সেই সময়ে বাবা বলেছিলেন, ‘‘টু লেট উত্তম”সত্যিই বড় দেরি করে ফেলেছিলেন। টাকার দেনা মাথায় নিয়ে তার পরই তো ‘চিড়িয়াখানা’র শ্যুটিং-এ ওঁর একটা অ্যাটাক হয়।

আমার স্থির বিশ্বাস, সেই সময়ে শুভেন্দুকাকু (চট্টোপাধ্যায়) ওই শ্যুটিঙে না থাকলে আরও সিভিয়র হতে পারত ব্যাপারটা। ডাক্তার ছিলেন তো শুভেন্দুকাকু...উপসর্গ দেখেই ধরতে পারেন যে ওটা হার্ট অ্যাটাক।

কথা বলতে বলতে একটু থামলেন সন্দীপ। তার পর বললেন, নাহ্‌, কেবল বেদনা কেন? ওঁর সেই ভুবনভোলানো হাসির কথাও তো না বললেই নয়। মনে আছে, ‘নায়ক’-এর ওই টাকার দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল ‘এনটিওয়ান’-এ। ঢেউ খেলানো টাকার টিলা, নকল টাকার নোট দিয়ে তৈরি হয়েছিল...কিন্তু এমন অপূর্ব, লোভনীয় দেখতে লাগছিল... অ্যাসিস্ট্যান্টদের সঙ্গে সে দিন আমারও কাজ ছিল শটের সময় ব্যালকনি থেকে টাকা ছড়ানোর, যাতে মনে হয় যেন টাকার বৃষ্টি হচ্ছে। সেট তৈরির পর, বাবা একজনকে বললেন, “উত্তমকে ডাকো তো, দেখি সেট দেখে কী বলে?” আমি বাবার পাশেই তখন। দেখলাম সেটে ঢুকেই সেই ভুবনভোলানো হাসি। ঝকঝকে দৃষ্টি। বাবাকে বললেন, “মন ভরিয়ে দিলেন মানিকদা...কত টাকা!” দু’জনেই খুব জোরে হেসে উঠেছিলেন। আজও যেন সেই হাসির রেশ কানে বাজে...শুনতে পাই।

তাই আপনার মতো আজ যখন কেউ জানতে চান আবির (চট্টোপাধ্যায়) ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করা সত্ত্বেও, ওঁকে কেন ফেলুদা হিসেবে ছবিতে নিলাম। কিন্তু উত্তমবাবুকে কেন ফেলুদা হিসেবে ছবিতে নেওয়া হল না! তখন বলব, তার একটাই কারণ বোধহয় বয়স। ইনফাক্ট সৌমিত্রকাকুরও কিন্তু ফেলুদা করার কথা ছিল না। বাবা নতুন কাউকে খুঁজছিলেন, মনের মতো পাননি... উত্তমবাবুর ক্ষেত্রে বয়সটা একটা ফ্যাক্টর ছিল। আরেকটা কথা, যদি ধরে নিই এখন উত্তমবাবুর বয়স তিরিশ এবং আমি ফেলুদা বানাচ্ছি, তা হলে কি ওঁকে কাস্ট করতাম? ভাবতাম বইকী!

আচ্ছা, ‘নায়ক’-এ শর্মিলা ঠাকুরের সেই শেষ সংলাপ, যেখানে উনি সাক্ষাত্‌কারের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছেন আর উত্তম খুব রোম্যান্টিক ভাবে জানতে চাইছেন, ‘মন থেকে লিখবেন নাকি?” উত্তরে শর্মিলা বললেন, “মনে রেখে দেব”...কী বলবেন এই রোম্যান্সকে?

“দেখুন, তারকা সে-ই, যাকে ছোঁয়া যায় না। পাশে বসে থাকলেও যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে...পাশে থাকলেও যে কাছে নেই। অথচ যার সঙ্গে শেয়ার করা মুহূর্তগুলো সযত্নে মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সকলে...সে-ই প্রকৃত ‘নায়ক’, তারকা। ‘রোমান হলিডে’র শেষ দৃশ্য...একই অপূর্ণ পরিণতি...তাই না?”

ঝিরঝিরে শ্রাবণ তখনও বাইরে। সত্যজিত্‌-সন্দীপের ‘জাদুঘর’ থেকে বেরিয়ে আসার আগে মিহি করে ভাবলাম, অস্কারের সেই ট্রফিটা যদি একটু দেখা যেত... বলতে পারা গেল না। বরং বেরিয়ে আসার আগে বললাম, এ বছর তো সত্যজিত্‌ রায়, উত্তমকুমারের সঙ্গে আর এক জন যোগ দিয়েছেন... ‘মহানায়িকা’।

ঠোঁটে হাসি, দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা। সন্দীপ বললেন, “সত্যিই...নতুন কোনও খেরোর খাতায় অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট নিয়ে ওঁরা এখন মিটিঙে বসেছেন কিনা কে জানে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement