বাণিজ্যে বসতে নায়িকা

২০১৫-র বক্স অফিসের হিসেবে নারী কেন্দ্রিক ছবি এগিয়ে। তা হলে বলিউডের নায়কেরা কি প্রশ্নের মুখে? উত্তর খুঁজলেন নাসরিন খান ও স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়২০১৫-র বক্স অফিসের হিসেবে নারী কেন্দ্রিক ছবি এগিয়ে। তা হলে বলিউডের নায়কেরা কি প্রশ্নের মুখে? উত্তর খুঁজলেন নাসরিন খান ও স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০০:৩০
Share:

হরিয়ানার ঝাঁঝরের রাস্তায় কঙ্গনা রানাওত (তনু) মদ্যপ অবস্থায় ফিরছেন। তিনি হারিয়েছেন তাঁর প্রেম। এত দিন ছবির পর্দায় দেখা যেত একজন পুরুষ প্রেম হারিয়ে বা প্রেমে আঘাত পেলে সুরার বোতলে তাঁর হতাশা লুকোতেন। ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’য়ে দৃশ্যটা একই রইল। কিন্তু তনু ছবির নায়কের মতো শুধু যে ‘ড্রিঙ্কিং’, ‘ফ্লার্টিং’ চালিয়ে গেলেন তাই নয়, সলমন খান যেমন ‘যায়ে যায়ে এক বার জো যায়ে’ গানটিতে তোয়ালে জড়িয়ে নেচেছিলেন, কঙ্গনাও একই রকম ভাবে সেই ‘টাওয়েল-মোমেন্ট’কে নিয়ে এলেন ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’য়ে। আমদর্শক এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তো তোলেনই নি, উল্টে ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’ বক্স অফিসে সংগ্রহ করে ফেলল প্রায় ১২০ কোটি টাকার বিশাল অঙ্ক।

Advertisement

একই ঘটনা ঘটছে ‘পিকু’র ক্ষেত্রেও। বাবা বনেদি বাড়ি বিক্রি করবেন কি করবেন না, সেই মতামত দিচ্ছে পিকু। সচরাচর ছেলেদের মতামতকেই এত দিন গুরুত্ব দেওয়া হত এ সব ব্যাপারে। বয়স্ক বাবার দায়িত্ব থেকে পার্টনারের চাহিদা মেটানো— পিকু একাই একশো।

Advertisement

‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’ দম লগা কে হইসা

এনএইচ-১০-এর কথাই যদি ধরি। নায়িকা অনুষ্কা শর্মা গাড়ি চালাতে চালাতে ভিলেনকে পিষে মেরে দিচ্ছেন, ভিলেনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছেন, ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত শরীরে রোয়াকে বসে সিগারেট ধরাচ্ছেন— বলিউডি সুপারস্টার কালচারে এ দৃশ্য বিরল। বোঝাই যাচ্ছে বাথটাব-স্নান, বরফে শিফন শাড়ির লাস্য একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে দর্শকের কাছে। তা হলে একের পর এক মহিলাকেন্দ্রিক ছবির সাফল্যের কারণটা ঠিক কী?

‘‘আসলে সিনেমায় এখন রিয়েলিজম ফিরে আসছে। রোজের দিনে মেয়েদের মতামত, মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এখন আমরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিই। ছবিতেও এখন এই স্বাধীন মহিলাদের কথাই বলা হচ্ছে। তবে স্বাধীনতা বলতে শুধুই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয় কিন্তু। ‘পিকু’তে যেমন ভাস্কর ব্যানার্জি মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। এই প্রজন্মের মেয়েরা পিকুর মতোই।

‘এনএইচ টেন’

এই রিয়েল লাইফ, রিয়েল ওম্যানকে ছবিতে দেখতেই দর্শক এত ভিড় বাড়াচ্ছেন সিনেমা হলে। অনেকে এমনকী নিজের মেয়ের নাম বদলে রাখছেন পিকু। সিনেমার চরিত্র বাড়ির চরিত্র হয়ে উঠছে। ফলে তা হিট,’’ বললেন ‘পিকু’র পরিচালক সুজিত সরকার।

বলিউডের খবর, নায়িকারা স্টান্টগুলোও নিজেরাই করছেন। ‘এন এইচ টেন’ ছবিতে অনুষ্কা শর্মা স্টান্টগুলো নিজেই করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা নায়কদের থেকে যোগ্যতায় কোথাও পিছিয়ে নেই।

‘দম লাগাকে হাইসা’ ছবির চেনামুখ আয়ুষ্মান খুরানা। কিন্তু মানুষের মন ছুঁয়ে গিয়েছে নায়িকা ভূমিকা পেদনেকর। ফিরে তাকালে দেখা যাবে, বিষয়টা যে একেবারে নতুন তা নয়। গত বছর বলিউডে এক ডজনের মতো নারীকেন্দ্রিক হিন্দি ছবি হয়েছে যেখানে তারকাখচিত মশলা ছবিকে টেক্কা দিয়েছে কাহিনি নির্ভর বিষয়। তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায় সাধারণত সামাজিক বিষয় নিয়ে ছবি করতে ভালবাসেন। কোনও দিনই হিন্দি মশলাদার ছবির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেননি তিনি। সেই তন্নিষ্ঠাই এখন বলছেন, সম্প্রতি বলিউডি ছবিতে কিন্তু অনেক বদল ঘটে গিয়েছে। তাঁর মতে, ‘কহানি’ আর ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ মূলস্রোতের সেরা হিন্দি নারীকেন্দ্রিক ছবি।

বিদ্যা বালনের পোশাকআশাক নিয়ে একটা সময় প্রচুর হাসাহাসি হত। কিন্তু বিদ্যা যে জাত অভিনেত্রী, ‘পরিণীতা’ থেকে ‘কহানি’ একের পর এক নারীকেন্দ্রিক ছবিতে অভিনয় করার পরই সেটা প্রমাণ হল। ‘‘তবে সিনেমা শুধু নারীকেন্দ্রিক হলেই চলে না। চাই ভাল গল্প। কী ভাবে সেই গল্প বলা হচ্ছে ছবির পর্দায় সেটাই আসল। স্টোরি ইজ দ্য কিং,’’ বলছেন বিদ্যা।

এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে শাবানা আজমি এবং স্মিতা পাটিলের কথা। ওঁরা দু’জনেই নারীকেন্দ্রিক ছবিতে অভিনয়ে অনন্য। শাবানা যদিও ছবির সাফল্যকে নারী বা পুরুষকেন্দ্রিক হিসেবে দেখতে চান না। বলছেন, ‘‘এটা ভুল ধারণা যে শুধু পুরুষকেন্দ্রিক ছবি বক্স অফিসে সাফল্য আনে। দর্শক চান ভাল বিষয়। গল্পটা ভাল করে বলা হলে নারীকেন্দ্রিক না পুরুষকেন্দ্রিক সেটা বড় ব্যাপার হয় না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মীনাকুমারী আর নূতনের ছবিও সাফল্য পেয়েছে এক সময়।’’

‘কুইন’ ছবির পরিচালক বিকাশ বহেলের মতে চরিত্রকে নারী-পুরুষ এই বিভাজনের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি দেখা হয়, তা হলে নানা ধরনের গল্প নিয়ে ছবি হতে পারে। ‘‘ছবিতে শক্তিশালী চরিত্রদের নিয়ে গল্প বলতে ভালবাসি আমি। তবে নারীজীবন আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। যে ভাবে তারা বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করে সেটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং,’’ বলছেন বিকাশ। অন্য দিকে পরিচালক নাগেশ কুকনুর বলছেন, ‘‘পুরুষ চরিত্র নিয়ে অনেক ভাল ভাল ছবি হয়ে গিয়েছে। এখন ছবিতে মেয়েদের চরিত্রের নানা দিক আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন ধরনের গল্প বলার অবকাশও বেড়ে গিয়েছে।’’

দর্শকরুচির এই পরিবর্তন হয়তো আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখনকার ভারতীয় সমাজে মেয়েদের দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের ভূমিকায়। সিনেমাতে তাদের সেই সব ভূমিকার প্রতিফলন ঘটছে, মনে করেন প্রযোজক দিয়া মির্জা।

এত কিছুর পরেও নারীকেন্দ্রিক ছবির জন্য টাকা জোগাড় করা খুব সোজা নয়। পরিচালক গৌরী শিন্ডের প্রথম ছবি ছিল ‘ইংলিশ ভিংলিশ’। এই ছবিতে না ছিল অল্পবয়েসি নায়িকা, না ছিল কোনও আইটেম সং। তাই ছবির জন্য প্রযোজক জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল পরিচালককে। এই ধরনের ছবিতে বিষয়কে অধিকাংশ সময় গুরুত্ব দেওয়ার জন্য স্টার কাস্টিং করা যায় না। স্টার না থাকলে অনেক সময় প্রযোজকেরাও পিছিয়ে আসেন। তা সত্ত্বেও মূলস্রোতের পরিচালকেরা এখন শক্তিশালী নারী চরিত্র নিয়ে ছবি করছেন। পরিচালক প্রকাশ ঝা বলছেন, ‘‘আমাদের সমাজ এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দুটোই পুরুষশাসিত। তবে সময় পাল্টাচ্ছে। ছবি ভাল ভাবে প্রচার করা হলে স্টার আছে কি নেই তাতে কিছু এসে যায় না।’’

শুধু হিন্দিই নয়, বাংলা ছবিতেও মহিলাঘেঁষা ছবির রমরমা। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অনেক দিন থেকেই নারীভিত্তিক বিষয় নিয়ে ছবি করে আসছেন। ‘শূন্য এ বুকে’ থেকে ‘ওয়ারিশ’— সব ক্ষেত্রেই চেনা মহিলাদের কথাই বলে এসেছেন তিনি। কৌশিক বললেন, ‘‘বাংলা ছবির দর্শকের বড় অংশই মহিলা। সেই কারণে মহিলা ঘেঁষা ছবি হলে সেই ছবি হিট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমার তো মনে হয় নারীমনের আবেদনই এত কাল ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিকে বক্সঅফিস সাফল্য এনে দিয়েছে। আজও মহিলা দর্শক না থাকলে ছবি হিট হয় না।’’

শুধু মহিলা দর্শক থাকলে বা মহিলাদের নিয়ে গল্প বললেই কি ছবি চলে? সৃজিত মুখোপাধ্যায় যাচ্ছেন আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যায়। সম্প্রতি তিনি একটি নারীকেন্দ্রিক ছবিও করেছেন। তাঁর মতে এখন এই ধরনের ছবি বেশি হওয়ার কারণ পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। দর্শক মেয়েদের জীবন জানতে আগ্রহী হচ্ছে। ব্যবসায়িক দিক থেকেও নারীকেন্দ্রিক ছবিগুলো এগিয়ে থাকছে তার কারণ, এই সব ছবি কম বাজেটে তৈরি করা যায়। ‘মেলস্টার’কে দিয়ে প্রচুর পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয় করাতে হচ্ছে না। গল্প বলার ধরন সহজ সরল হওয়ায় বিদেশে শ্যুটিং বা স্পেশাল এফেক্টসের ঝকমারিও থাকছে না। তাই অল্প বাজেটে ছবি করলেও তা নজরকাড়া লাভের মুখ দেখছে।

মেয়েদের নিয়ে ছবি করলে তা যে ভাল চলছে তার কারণ, কোয়েল মল্লিকের মতে পাল্টে গিয়েছে চরিত্রচিত্রণের ধরন। তিনি বললেন, ‘‘ছবিতে মেয়েদের চরিত্রের অনেক ‘লেয়ার’ আর ‘শেড’ বেরিয়ে আসছে আজকাল। যেটা আগে হত না। ‘কহানি’ হোক কি ‘ডার্টি পিকচার’, ‘কুইন’ হোক কি ‘পিকু’—সব ছবিতেই মেয়েদের স্বভাবের নানা অজানা দিক দেখানো হয়েছে। দর্শককে এই দিকগুলো আকৃষ্ট করছে।’’

টলি থেকে বলি অভিনেত্রীরা এই নায়িকা ঘেঁষা ছবির সাফল্যে যারপরনাই খুশি। কিন্তু এই ধরনের নারীপ্রধান ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে নায়কেরা কী ভাবছেন? তাঁরা কি খুশি? ‘তনু ওয়েডস মনু’ সিরিজে অভিনয় করে কিন্তু খুশি আর মাধবন। তিনি জানিয়েছেন নারীকেন্দ্রিক ছবির দ্বিতীয় লিড চরিত্রে অভিনয় করতে তাঁর ভাল লেগেছে।

বলিউডের অনেক নামী দামি তারকাই মহিলাসম্পর্কিত সামাজিক বিষয় নিয়ে মুখর। সিনেমার ক্রেডিটলাইনে নিজের নামের আগে শাহরুখ খান বসান তাঁর নায়িকার নাম। কিন্তু এটুকুই কি মুশকিল আসান? কোনও দিনও কি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ দীপিকা পাড়ুকোনের ছবি হবে? বা ‘পিকে’ অনুষ্কা শর্মার? বা ‘কিক’-এর কথা বললেই জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ?

খানদান কি খানখান হবে? প্রশ্নটা থেকেই গেল...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement