সূর্যের সাতটা রঙের ঘোড়া ছুটছে

কিন্তু এ ছবি ডিজ়অর্ডার নিয়ে নয়। বরং ক্লিন্ন জীবনের উপর দিয়ে সাঁত করে উড়ে যাওয়া লেজ ছেঁড়া ঘুড়ির মতো রূপকথার ছবি।

Advertisement

সোমেশ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৮ ০০:৫০
Share:

উপরতলায় কংসমামা গন্ডারিয়া, নীচে গ্যাস-পোড়ানো রান্নাঘর। মধ্যে একটা সরু সিঁড়ি। আর আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজ।

Advertisement

বাড়ির সামনে একফালি রাস্তায় ইশকুলে পড়া ছেলেদের ক্রিকেট, মোড়ে চায়ের দোকান। আর বুলেটে সওয়ার কাবুলিওয়ালা।

মোড় ঘুরে রোজ চটি ফটফটিয়ে বাজার যাওয়া, ফেরা। রান্না করা। ফোড়নের মধ্যে ছেলেদের টিটকিরি আর মামার হাতে মারধর। এই হল বাপ-মা মরা ঘোঁতনের জগৎ।

Advertisement

ঘোঁতন ‘বিশেষ’। তার দেখা, শোনা, বোঝার রকমটা আর পাঁচ জনের মতো নয়। ডিজ়অর্ডার তাকে মূলস্রোত থেকে ছিটকে দিয়েছে। সাধারণের স্কুলে তার ঠাঁই হয়নি। আশপাশের লোকের কাছে ব্রাত্য।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার বা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে দুনিয়া জুড়ে কম ছবি হয়নি। কিন্তু তথ্যচিত্র বা ওয়েব সিরিজ়ের বাইরে মূলধারার ছবিতে বিশেষ চরিত্রে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতাকে ব্যবহারের নজির বেশি নেই। চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল সেই ঝুঁকিটা নিয়েছেন। এবং ষোলোর উপরে আঠারো আনা সফল।

ঘোঁতনের ভূমিকায় মহাব্রত বসু যা করেছে, বা বলা ভাল সৌকর্য তাকে দিয়ে যা করিয়ে নিয়েছেন, বিস্ময়কর বললে কম বলা হয়। ‘বিশেষ’ শিশু সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরাই বুঝবেন এমন কাউকে কেন্দ্রে রেখে দু’ঘণ্টার গল্প বলে চলা কত কঠিন!

কিন্তু এ ছবি ডিজ়অর্ডার নিয়ে নয়। বরং ক্লিন্ন জীবনের উপর দিয়ে সাঁত করে উড়ে যাওয়া লেজ ছেঁড়া ঘুড়ির মতো রূপকথার ছবি। শেষ শীতকে লহমায় ঘেমো গরমে পাল্টে দেওয়া এক রাতে পরিপিসি (শ্রীলেখা মিত্র) এসে যে ভেলকি দেখাতে শুরু করে ঘোঁতনকে। আর সৌকর্য বুনতে শুরু করেন রামধনুর সাত রঙের সঙ্গে সাত স্বাদ আর সাত অনুভূতির গল্প। বিশ্বাস না-ই করতে পারেন, কিন্তু অবাক হয়ে দেখতে হয়। তবে ‘ফুড ফ্যান্টাসি’ বলে এ ছবিকে দেগে দিলে আরও বড় কিছু বাদ পড়ে যায়।

রেনবো জেলি

পরিচালনা: সৌকর্য ঘোষাল

অভিনয়: মহাব্রত, শ্রীলেখা, কৌশিক, শান্তিলাল

৭.৫/১০

রূপকথায় মানানসই যে ঈষৎ উচ্চকিত অভিনয় শ্রীলেখা করেছেন, তার পাশেই হিলহিলে সাপের মতো পড়ে থাকে কৌশিক সেনের গন্ডারিয়া (চামড়া যার গন্ডারের মতো পুরু বলে ওই নাম দিয়েছে ঘোঁতন, ক্যাপ্টেন স্পার্কের গল্প সে পড়েনি)। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে সমানে পাল্লা দেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ও। পাশের বাড়ির বালিকা পপিন্সের ভূমিকায় অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারী মিষ্টি। বড় মায়া নিয়ে একের পর এক ক্লোজ শটে ঘোঁতনকে ধরে আলোক মাইতির ক্যামেরা। এ ছবির পরম ঐশ্বর্য হয়ে থাকে ওই মায়ামাখা মুখ। হু হু করে যখন আকাশে ওঠে গ্যাসবেলুন আর উঁচু থেকে ক্যামেরা স্থির চোখে এক বার দেখে নেয় পোড়া শহরটাকে, ছাদের কোণ ছেয়ে আঁকা ‘মা’ লেখা চক-ছবির উপরে যখন লুটিয়ে পড়ে থাকে দুমড়ে যাওয়া এক বালক, কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করে।

এক সময়ে পেশাদার ইলাস্ট্রেটর সৌকর্য চুটিয়ে ব্যবহার করেছেন তাঁর অ্যানিমেশন দক্ষতা। কিন্তু বাড়তি প্রাপ্তি তাঁর লেখা গানের লিরিক। তা যখন নবারুণ বসুর সুর পেয়ে সাহানা বাজপেয়ীর গলা ছোঁয় বা আর্ত গায়নের নখরে বিদ্ধ করেন মৌসুমী ভৌমিক, দম বন্ধ হয়ে আসে।

কোনও খটকা যে নেই, তা নয়। যেমন, বিশেষ মানুষেরা কি এত বানিয়ে কথা বলতে পারেন? নেপথ্যে যখন এক কৌঁসুলি রয়েইছেন, রোবট-রহস্যের কী প্রয়োজন ছিল? রহস্যঘন বাংলা বাজারে রহস্য করার ঝোঁক বুদ্ধিমান পরিচালকেরাও সামলাতে পারেন না বুঝি? সিঁড়ির ঝলক-দৃশ্য নিয়ে শৈল্পিক আপত্তির জায়গা নেই। কিন্তু বিশেষ বা অবিশেষ নির্বিশেষে সমস্ত খুদের চারপাশকে দেখার চোখ পাল্টে দিতে পারে যে ছবি, এটুকু চোনা কি এড়ানো যেত না?

তবে এক-একটা ছবি থাকে যার খুঁতগুলো দেখেও দেখতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ শিশুদের নিয়ে অযথা আহা-উহু না করে তাদের সাধ-ইচ্ছে, পারা-না পারা, আর ক্রমাগত হেয় হতে থাকার যন্ত্রণা যে ভানভনিতাহীন মমতায় বুনেছেন সৌকর্য, তা কুর্নিশ জানানোর মতো।

আর ঠিক এখানেই আর পাঁচটা ছবিকে ছাপিয়ে যায় ‘রেনবো জেলি’। দর্শকের চেনা ছকের বাইরে বয়ে চলা অপর এক জীবনের গল্প বলে। পথে পিছিয়ে পড়া এই ছেলেমেয়েগুলো কেউ অসাধারণ আঁকে, কেউ দুর্ধর্ষ বাজায়, কেউ বা অঙ্কে ধুরন্ধর। মহাব্রত আসলে দেখিয়ে দিল, সে একা নয়। মরমী হাতে ছুঁলে সত্যিই কতটা ‘বিশেষ’ তারা হয়ে উঠতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement