Rahul aronudoy banerjee

Pandemic: ঋদ্ধিমার মায়ের মৃত্যু প্রথম ধাক্কা দেয়, বুঝলাম আমাদের শ্বাস নেওয়ার পরিসর কমছে

‘‘করোনা হারবে। ফিরে যাওয়ার পথে নিয়ে যাবে হয়তো আরও কিছু প্রাণ। হয়তো আমারই।’’

Advertisement

রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২১ ১৩:০৪
Share:

রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়

‘করোনা’ শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচয় অতি শৈশবে। যে বার কলকাতা থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গেল, বিড়লা প্লানেটোরিয়াম থেকে বিক্রি হয়েছিল গ্রহণ দেখার চশমা। আমাদের মতো যারা ওই মহার্ঘ চশমা কিনতে পারেনি তাদের ভরসা এক্স-রে প্লেট। সেই সময় জেনেছিলাম সূর্যগ্রহণের একটা পর্যায় হল করোনা। যা প্রধানত পূর্ণগ্রাসের সময়ই প্রতীয়মান হয়। তখন কি আর জানতাম করোনার অন্য মানেও হয়! মহামারির গল্প মূলত গল্প-সাহিত্যে পড়া। সম্যক অভিজ্ঞতা হয়নি। ১৯৯০-এর মাঝামাঝি সুরতে (গুজরাত) প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল বটে, কিন্তু তাকে মহামারি বলে ডাকলে আমাকেও শাহরুখ খান বলে ডাকা যায়। মহামারির আকার ধারণ করার আগেই সেই প্লেগকে আয়ত্তে আনা গিয়েছিল। সত্যি বলছি এই অতিমারি শব্দটাই এর আগে জীবনে শুনিনি। মানবসভ্যতার জন্য যে এরকম বিপদ অপেক্ষা করে আছে, তাই বা কে ভেবেছিল?

Advertisement

প্রথম ঢেউয়েই আমরা যথেষ্ট নাকানিচোবানি খেয়েছি। শারীরিক ভাবে, মানসিক ভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে। যাদের হাতে স্মার্টফোন নেই, যাদের কাছে নেই আগামীকালের ভাতের প্রতিশ্রুতি, তাদের কী হয়েছিল মনে পড়ে? ট্রেনলাইনে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো মানুষের পাশে আস্ত কিছু রুটির ছবি জগৎসভায় আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছিল। কে বলেছে এই দেশে সবার সমান অধিকার? পথশ্রমে অর্ধমৃত মানুষগুলোকে উবু করে বসিয়ে পশুর মতো স্যানিটাইজ করার যে লজ্জা, কোনও গালভরা উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে তা ঢাকা সম্ভব নয়। বরং মানুষ হিসেবে, ভারতীয় হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা প্রকট হয়। আমাদের বিষণ্ণ করে।

পথশ্রমে অর্ধমৃত মানুষগুলোকে উবু করে বসিয়ে পশুর মতো স্যানিটাইজ করার যে লজ্জা, কোনও গালভরা উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে তা ঢাকা সম্ভব নয়।

আমার এক দাদু শেষ জীবনে শয্যাশায়ী ছিলেন। বিছানাতেই মলমূত্র ত্যাগ করতেন। ফলে ঘরে সব সময় একটা দমবন্ধ করা নোংরা গন্ধ থাকত। সেটা তাও সহনীয় ছিল। কিন্তু ওই ঘর যখন ফিনাইল দিয়ে মোছা হতো, তখন ফিনাইল আর মলমূত্রের মিশ্র গন্ধে বমি পেয়ে যেত। আজকাল মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা সবাই এখন আমার সেই দাদুর ঘরে বসে আছি। চারপাশের এই অসুস্থতা, অসহায়তার মধ্যে আমাদের ফেসবুকের হ্যাশট্যাগগুলো শুধুই সুগন্ধি ফিনাইলের ব্যর্থতা।

Advertisement

আমরা জাতি হিসেবে কতটা কাছাখোলা, তার প্রমাণ আমরা গত দুর্গা পুজোতে পেয়েছি। আমাদের হিড়িক দেখে ভাইরাস নিজেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল! তা সত্ত্বেও স্তিমিত করা গিয়েছিল প্রথম ঢেউকে, আর যেই না সংক্রমণের হার একটু নামল, আমরা হা-রে-রে-রে করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। ঈশ্বর যেন সকালে দাঁতন করতে বেরিয়ে আমাদের কানে কানে বলে গিয়েছেন, ‘‘চিন্তা নেই... তুমি অমর।’’ এমনকী এই দলে আমিও আছি। তার উপর দোসর হল নির্বাচন। কে কত বেশি ভিড় জমাতে পারে তার প্রতিযোগিতা। আমি নিজে সিপিএম-এর হয়ে প্রচার করেছি, একই দোষে দুষ্ট আমিও। কিন্তু বিশ্বাস করুন এর জন্য আমি কংগ্রেস, সিপিএম, টিএমসি, বিজেপি কার‌ও দোষ দেখি না। কেউ চায় না নির্বাচনে হারতে।

আমি নিজে সিপিএম-এর হয়ে প্রচার করেছি, একই দোষে দুষ্ট আমিও।

প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এত অদূরদর্শী হল কী করে? তারা কী করে দ্বিতীয় ঢেউয়ের হুঁশিয়ারি ভুলে গেল? এই নির্বাচন দু’মাস বা এক বছর পিছিয়ে দিলে কোন বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটত? এই সব তালেগোলে কখন যে দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল আমরা টের‌ও পেলাম না। শুধু টের পেলাম আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিসর ক্রমশ কমে আসছে।

ঋদ্ধিমার মায়ের মৃত্যু আমাকে প্রথম প্রত্যক্ষ ধাক্কা দেয়। ঋদ্ধিমা-গৌরবের বিয়ে ছিল আমাদের বন্ধুদের কাছে দশ দিনব্যাপী উৎসব। তা ছাড়াও ঋদ্ধিমার বাবা মোহরদার প্রশ্রয় আমরা কম পাইনি। কাজেই ঋদ্ধিমার মায়ের মৃত্যু আমাদের কাছে আত্মীয় বিয়োগের মতোই। এখন আমি এই লেখাটা যখন লিখছি আমার পিতৃসম ছোট মেসো ভেন্টিলেশনে। আমার ছোট মাসির ১০২ জ্বর। মেসো চিকিৎসক। রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়েই এই রোগ তাঁর শরীরে এসেছে। আমাদের বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রয়োজনে নিজের প্রাণের বিনিময়ে। অথচ আমাদের সে দিকে কোন‌ও হুঁশ নেই। আমরা যেন আত্মহত্যা করব ধরেই নিয়েছি।

ঋদ্ধিমার মায়ের মৃত্যু আমাকে প্রথম প্রত্যক্ষ ধাক্কা দেয়।

হুঁশ কার আছে? যখন মানুষ অক্সিজেনের জন্য, একটা শয্যার জন্য ভিখিরির মতো ঘুরছে, তখন তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদ সেন্ট্রাল ভিস্তা! রোম নগরী যখন পুড়ছে তখন নিরোর বেহালা বাজানোর সেই ঘটনাও যেন এর পাশে বালখিল্য লাগে। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের জন্য প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি’ করেছেন, আজ তাঁরা বেপাত্তা। এই বিপদের দিনে টুঁ শব্দটি শোনা যাচ্ছে না তাঁদের মুখে। ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার তাদের ভাগের মৃতদেহ ভাসিয়ে দিচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্যজনকভাবে এইসব চোখে পড়ছে না কঙ্গনা, অক্ষয় কুমারদের।

কিন্তু এত কিছুর পরও আমি জানি আমরা জিতব। করোনা হারবে। ফিরে যাওয়ার পথে নিয়ে যাবে হয়তো আরও কিছু প্রাণ। হয়তো আমারই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করোনাকে হারতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমি কি বিজ্ঞানী? কীসের ভিত্তিতে বলছি এ সব কথা? সোজা কথা, যাদের এত ক্ষণ গালিগালাজ করছিলাম তারাই হারাবে করোনাকে। হ্যাঁ, মানুষ হারাবে করোনাকে। আজ ঋতব্রত, ঋদ্ধি, পরম, সুরঙ্গনা, অনুপমরা রাস্তায় নেমে এসেছে। উদয়াস্ত খাটছে সৃজিত। আবির, অনির্বাণ, ঋত্বিক, জয়রাজ কেউ বসে নেই আর। আমরা করোনার চোখে চোখ রেখে লড়ব বলে রাস্তায় নেমেছি। শুধু নামকরা মানুষদের কথাই বা বলছি কেন, বেশিরভাগ মানুষ তাঁর সীমিত ক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সদ্য পিতৃহারা কন্যা নেটমাধ্যমে জানাচ্ছে তার কাছে কী কী ওষুধ আছে। নিয়ে যেতে বলছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে এক মা বলছেন, কোভিড পজিটিভ কোনও মা যদি সন্তানের কাছে যেতে না পারেন, তাঁর শিশুকে তিনিই দেবেন বুকের দুধ। এটাই আমরা। এটাই মানুষ। সংকটে আজ জেগে উঠেছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম মানবধর্ম।

বাংলা জুড়ে দৌড়ে চলেছে ৮০ হাজার রেড ভলেন্টিয়ার। যারা রেড নয়, তারাও কাঁধ মিলিয়েছে আজ। আমরা বুঝে গিয়েছি, আমাদের কাছে আমরা ছাড়া কেউ নেই। যে প্রতিবেশির সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে মনোমালিন্য, কথা বন্ধ, কোভিড শুনে তার বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে টিফিন ক্যারিয়ার। বিশ্বাস করুন, যে ক’টা উদাহরণ দিলাম, একটাও মনগড়া নয়। এই সব সত্যি রূপকথা সমানে ঘটে চলেছে আমাদের আশেপাশে। এই রূপকথায় পক্ষীরাজ নেই। ডালিমকুমার, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, রুপোর কাঠি মাথার কাছে নিয়ে শোওয়া রাজকন্যা, কেউ নেই। আছি আমি, আছেন আপনি, আছেন আমাদের মতো অজস্র মানুষ, যাঁরা আজও মনে করেন ভালবাসার চেয়ে বড় বিপ্লব কিছু হতে পারে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement