পরিবারের কেউ ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। নামের পাশে নেই কেচ্ছার বহরও। বিশ্বাস করেন শুধু ভাল কাজে। তিনি মাধবন বালাজি রঙ্গনাথন, অনুরাগীদের কাছে সংক্ষেপে শুধুই মাধবন। বহু নামী সিনেমায় অভিনয় করেও যিনি আজ বলিউডের আন্ডারেটেড অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম।
মাধবনের জন্ম ১৯৭০ সালের ১ জুন, জামশেদপুর শহরে। এখন সেটা ঝাড়খণ্ডে পড়লেও তখন ছিল বিহারে। মাধবনের পরিবার আদতে তামিলনাড়ুনর। তাঁর বাবা ছিলেন টাটা স্টিলের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। মা ছিলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার।
মাধবন এবং তাঁর বোন দু’জনেই মেধাবী পড়ুয়া। তাঁর বোন পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অভিনেতা হয়ে গেলেও মাধবন কলেজের প্রথম সারির ছাত্রদের মধ্যে এক জন ছিলেন। তিনি ইলেট্রনিক্সে বিএসসি করেন। এনসিসি ক্যাডেট হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল।
তাঁর ইচ্ছে ছিল বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার। এনসিসি ক্যাডেট হিসেবে ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রশিক্ষণও নেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী, রয়্যাল নেভি এবং রয়্যাল এয়ারফোর্সে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ভেবেছিলেন, তিনি এয়ারফোর্সের পাইলট হবেন। কিন্তু তখন তাঁর বয়স ছিল যোগ্যতার তুলনায় ছ’মাস বেশি। ফলে মাধবনের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
তিনি ফিরে আসেন পড়াশোনার মূলস্রোতে। মুম্বইয়ের কিষিণচাঁদ কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেন পাবলিক স্পিকিংয়ে। এই সময়েই ঝোঁক হয় মডেলিং-এর দিকে। তিনি পোর্টফোলিয়ো তৈরি করান।
তাঁর প্রথম কাজ ট্যালকমের বিজ্ঞাপনে। সন্তোষ শিবনের পরিচালনায় একটি বিজ্ঞাপনে তাঁকে প্রথম দেখা গিয়েছিল। সন্তোষের কথায় তিনি মণিরত্নমের কাছে যান। তখন ‘ইরুভার’-এর কাস্টিং চলছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েন মাধবন। এই ছবিতেই ঐশ্বর্যা রাই আত্মপ্রকাশ করেন।
তার পরে মাধবন কাজ শুরু করেন টেলিভিশনে। ‘বনেগি আপনি বাত’, ‘ঘরজামাই’, ‘সায়া’-র মতো ধারাবাহিকে তাঁর কাজ নজর কাড়ে দর্শকদের। সুযোগ আসে ছবিতে অভিনয়ের। ১৯৯৬ সালে সুধীর মিশ্রের ছবি ‘ইস রাত কি সুবহ নহি’-তে ছোট্ট ভূমিকায় প্রথম অভিনয়।
২০০০ সালে আবার ডাক আসে মণিরত্নমের কাছ থেকে। এ বার ‘আলায়পায়েথু’ ছবিতে মাধবনের অভিনয় মন জয় করে নেয় সমালোচকদেরও। সুপারহিট এই ছবি মাধবনকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয়। প্রথম বার মাধবনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সে কথা মনে রেখেছিলেন মণিরত্নম। তিনি এই ছবিতে মাধবনকে লঞ্চ করেন। ছবিতে মাধবনের অভিনয় পুরস্কৃত হয়।
ক্রমে তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে তারকা হয়ে ওঠেন মাধবন। এই পরিচিতির পরে তিনি ডাক পান বলিউড থেকে। প্রথম হিন্দি ছবি ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ বক্স অফিসে সফল হয়নি। কিন্তু মাধবন জনপ্রিয়তা পান।
তবে বলিউডে একক অভিনয়ের সুযোগ বেশি পাচ্ছিলেন না। ফলে মাধবন তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ বেশি করেন। তবে বলিউডে ২০০৬ সালে মাল্টি হিরো মুভি ‘রং দে বসন্তী’-তে ফের প্রশংসিত হয় মাধবনের কাজ।
বেশির ভাগ হিন্দি ছবিতেই মাধবনের ভূমিকা ছোট। কিন্তু গভীরতা বা প্রভাব অনেক বেশি। মাধবন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি শুধু অর্থ বা খ্যাতির জন্য অভিনয় করেন না। তাঁর কাছে চরিত্রের গভীরতাও গুরুত্বপূর্ণ।
সে রকমই রোলে তিনি অভিনয় করেন ‘গুরু’ এবং ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে। রাজকুমার হিরানির ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’-এ মাধবন অভিনীত ‘ফারহান কুরেশি’ চরিত্রটি চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয় দর্শকমনে।
এই সময় কেরিয়ারের শীর্ষে ছিলেন মাধবন। ‘তনু ওয়েডস মনু’ ছবি ছিল নায়িকাকেন্দ্রিক। কিন্তু কঙ্গনার পাশাপাশি মনুর চরিত্রে মাধবনও জায়গা করে নেন দর্শকদের মনে।
বলিউডে মাঝে অ্যাকশন মুভি-র জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। প্রথম সারির নায়করা সবাই সিক্স প্যাক তৈরিতে মন দেন। কিন্তু মাধবন ওই স্রোতে গা ভাসাতে নারাজ ছিলেন। তিনি বরাবরই রোমান্টিক নায়কের ঘরানা নিয়ে থাকতে চেয়েছেন। তাই থেকেছেন।
ফলে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মনের মতো চিত্রনাট্য না পেলে অভিনয় করেননি। মাঝে তিনি তিন বছরের ব্রেক নেন। লন্ডনে গিয়ে অভিনয় থেকে দূরে থাকেন। ফিরে এসে চমকে দেন ইন্ডাস্ট্রিকে।
মাধবন তখন নিজেকে তৈরি করেছেন অ্যাকশন হিরোর মতো। চেহারায় বডি বিল্ডিংয়ের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর পুরনো রোমান্টিক ইমেজ ভেঙেচুরে একাকার। এ বার তিনি ছবি প্রযোজনা করলেন।
তখন বায়োপিকের যুগ। বক্সারের জীবন নিয়ে মাধবন তৈরি করলেন ‘সালা খারুস’। মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বাস্তব জীবনের একজন মুষ্টিযোদ্ধা, রীতিকা। কিন্তু এই ছবি সফল হয়নি। তবে তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে সফল কামব্যাক করেন মাধবন।
এখন ওয়েবসিরিজে কাজের পাশাপাশি বায়োপিক তৈরি করছেন মাধবন। তাংর ছবির বিষয় বিজ্ঞানী এবং এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার নাম্বিনারায়ণন। যিনি গুপ্তচরবৃত্তিতে অভিযুক্ত হন।
বিতর্ক থেকে দূরে শুধু অভিনয় নিয়ে এ ভাবেই থাকতে ভালবাসেন মাধবন। বলিউডের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছেন ঠিকই। রোমান্টিক ছবিও যখন অ্যাকশননির্ভর হয়ে পড়ে, মাধবন পাল্লা দিতে পারেননি বাকিদের সঙ্গে। কিন্তু বাছাই করা ছবিতে অভিনয় করেও নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেছেন তিনি।
জীবনের এই ওঠাপড়ায় যিনি মাধবনের পাশে ছিলেন, তিনি তাঁর স্ত্রী সরিতা। অভিনয়জীবনের আসার আগে মাধবন কিছু দিন মুম্বইয়ে পাবলিক স্পিকিংয়ের প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর ছাত্রী ছিলেন সরিতা।
সরিতা পরে বিমানসেবিকার কাজে সুযোগ পান। তিনি মনে করেন, তাঁর গ্রুমিংয়ের পিছনে প্রশিক্ষক মাধবনের ভূমিকা প্রধান ছিল। তিনি কৃতজ্ঞতা জানাতে মাধবনকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেখান থেকেই শুরু আলাপ। তার পর প্রেম ও পরিণয়। আট বছর প্রেমপর্বের পরে ১৯৯৯ সালে বলিউডে কেরিয়ার শুরুর আগে বিয়ে করেন মাধবন ও সরিতা।
২০০৫ সালে জন্ম নেয় তাঁদের একমাত্র ছেলে বেদান্তের। প্রথমে মাধবন তাঁর স্ত্রী, ছেলে, বাবা, মা এবং শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়ে চেন্নাইয়ে থাকতেন। পরে তিনি স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে মুম্বইয়ে চলে আসেন।
তিন বছর বিরতি অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে মাধবনকে। তত দিনে বলিউডের রাজপাট চলে গিয়েছে অন্যদের হাতে। কিন্তু রাজপাট হারিয়েও মাধবন নিজের আলাদা জায়গা ধরে রেখেছেন। তিনি বেশি চুজি, নাকি বলিউড তাঁকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি, সেই বিতর্ক ঢুকতে পারেনি তাঁর নিজস্ব জগতে।