‘‘ভাল কাজের জন্য স্বীকৃতি পেলে ভাল লাগে,’’ ‘জুবিলি’র সাফল্যে আপ্লুত প্রোডাকশন ডিজ়াইনার অপর্ণা সুদ। ছবি: অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো
১৯৪৭-এর সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ। এক দিকে নতুন পরিচিতির হাত ধরে নতুন উদ্যমে মাথা তুলতে চাওয়ার স্বপ্ন। অন্য দিকে, দেশভাগের ক্ষত বুকে বয়ে শিকড়ের খোঁজে সত্তা প্রতিষ্ঠার তাগিদ। দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের সুতো বাঁধা শুধু একটি জায়গায়— সিনেমা। ইতিহাসের সঙ্গে নিজের সুঠাম কল্পনা মিশিয়ে ‘জুবিলি’-তে সিনেমার সেই মায়াবী জগতকে সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যিনি, তিনি অপর্ণা সুদ। বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের ‘জুবিলি’ সিরিজ়ের প্রোডাকশন ডিজ়াইনার। স্বাধীনতা উত্তর সময়ের মায়ানগরীকে ঢেলে সাজিয়েছেন যিনি। যাঁর শিল্পে ঋদ্ধ হয়েছে স্বপ্নপূরণের শহর বম্বে (এখন যা মুম্বই)। ঠিক কী ভাবে শুরু হয়েছিল সেই কাজ? এত গবেষণা, এত পরিশ্রমা করে সেই কাজ সম্পূর্ণ করতে কোন কোন বেড়া টপকাতে হয়েছিল অপর্ণাকে? আনন্দবাজার অনলাইনকে বিশদের জানালেন ‘জুবিলি’র প্রোডাকশন ডিজ়াইনার।
যে কোনও ধরনের ছবির কাজের ক্ষেত্রে গবেষণার কোনও বিকল্প নেই, মত অপর্ণার। ছবি: অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো
প্রশ্ন: ‘জুবিলি’র জন্য অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। আপনার কাজ এত প্রশংসিত হচ্ছে। এত দর্শককে নিজের কাজের মাধ্যমে মুগ্ধ করেছেন।
অপর্ণা: ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।
প্রশ্ন: একটা ছবি বা সিরিজ়ের সাফল্যে সাধারণত প্রচারের আলো থাকে অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজকের উপরে। সেই আলো প্রোডাকশন ডিজ়াইনার পর্যন্ত পৌঁছনোর ঘটনা এখনও বেশ বিরল। ‘জুবিলি’র সাফল্যের পরে আপনিই এখন চর্চায়। কেমন লাগছে?
অপর্ণা: আমি অবশ্যই ভীষণ খুশি। যদিও আমি সব সময়ই ক্যামেরার নেপথ্যেই কাজ করতে পছন্দ করি। ক্যামেরার সামনে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তেমন কাজই করতাম। তবে, আমি খুশি যে দর্শক আমার কাজের প্রশংসা করছেন। নিজের কাজের প্রতি ভালবাসা থেকে কাজ করি। প্রচার ও খ্যাতির জন্য নয়। শিল্পীরা স্বীকৃতি পাচ্ছেন, তাঁদের কাজ নিয়ে কথা হচ্ছে, এতে আমি অবশ্যই খুশি। তবে, সেটা যেন ভাল কাজের জন্য হয়। আর সেটা তখনই করা সম্ভব, যখন আমি একটা ভাল প্রজেক্টে কাজ করছি। আমি কৃতজ্ঞ যে, ‘জুবিলি’র মতো অনবদ্য একটা সিরিজ়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। কী জানি! পরের কাজের ক্ষেত্রেও এমনটাই হবে কি না!
চিরপরিচিত সেপিয়া টোন নয়, বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে ‘জুবিলি’র দুনিয়ায় রং ভরেছেন অপর্ণা। ছবি: অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো
প্রশ্ন: আপনি ‘নীরজা’, ‘আকিরা’, ‘এবিসিডি: এনিবডি ক্যান ডান্স’-এর মতো ছবিতেও কাজ করেছেন। সব ক’টাই একে অপরের থেকে আলাদা ঘরানার ছবি। সেখানে ‘জুবিলি’ আবার একেবারে উল্টো, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। এত রকমের সেট বানানোর কাজটা কতটা কঠিন?
অপর্ণা: একেবারেই কঠিন নয়! প্রোডাকশন ডিজ়াইনার হিসাবে আমাদের কাজটাই হল, চিত্রনাট্যের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের দুনিয়া তৈরি করা। গল্পের কথা মাথায় রেখে আমাদের সেট পরিকল্পনা করতে হয়। সেই কাজটা করতে পারার ক্ষমতা এক জন প্রোডাকশন ডিজ়াইনার হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। সেই দক্ষতার ভিত্তিতেই আমরা কাজের প্রস্তাব পাই। এক জন পেশাদারের কাছে সেটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। প্রজেক্টের স্বার্থে প্রয়োজন মতো গবেষণা করার দরকার আছে। কঠোর পরিশ্রমের তো কোনও বিকল্পই নেই।
প্রশ্ন: বেশির ভাগ পিরিয়ড ড্রামার ক্ষেত্রে পর্দায় একটা পুরনো দুনিয়ার সেপিয়া টোন লক্ষ করা যায়। ‘জুবিলি’ পঞ্চাশের দশকের গল্প বললেও পর্দায় কোথাও সেই ঘষামাজা প্রাচীনত্ব দেখতে পাওয়া যায়নি। বরং বেশ রঙচঙে দেখিয়েছে ওই সময়ের বম্বে। এটা কি একটা সতর্ক ভাবে করা হয়েছে?
অপর্ণা: হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা একেবারেই সতর্ক ভাবে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। বিক্রমের সঙ্গে এই কাজটা নিয়ে যখন প্রথম কথা হয়, তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, আমরা এমন কিছু বানাব না, যেটা পর্দায় দেখতে ভীষণ পুরনো-পুরনো লাগে। পর্দায় যেন ওই সেপিয়া টোনের বাদামি আভা না থাকে। পর্দায় আমরা রং আনতে চেয়েছিলাম। ১৯৫০-এর দিকটা কিন্তু আদপে ভীষণ রঙচঙে একটা সময়। আমরা সাধারণ ভাবে যে সেপিয়া রঙের ঘষামাজা ছবি দেখি, বা সাদা-কালো ছবি, তা কিন্তু নয়। বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখেই তাই আমরা রঙচঙে ভাব পর্দায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ছবিই শুধু নয়, ভাল একটা গল্প বলবে, এমন যে কোনও ছবিতে কাজ করতে চান অপর্ণা। ছবি: অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো
প্রশ্ন: আপনারা ‘লিবার্টি’, ‘অ্যালফ্রেড’, ‘মরাঠা মন্দির’, ‘বিশাল টকিজ়’-এর মতো রিয়্যাল লোকেশনে শুট করেছেন। অথচ সেটে ‘রয় টকিজ়’ বানিয়েছেন।
অপর্ণা: এটা একেবারেই আর্থিক দিক থেকে ভেবেচিন্তে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। তবে, সিরিজ়ের শিল্পভাবনার দিক থেকেও একেবারে খাপে খাপে বসে গিয়েছিল এই চারটে সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহ। এগুলো সব ক’টাই চল্লিশের দশকে বানানো থিয়েটার। তাতে আমাদের সুবিধাই হয়েছিল।
প্রশ্ন: ‘জুবিলি’র জন্য এত বড় মাপে ‘রয় টকিজ়’ তৈরি করেছেন....
অপর্ণা: গবেষণা, অনেক গবেষণা! তিরিশ আর চল্লিশের দশকের বম্বে, তখনকার বিনোদনের জগৎ নিয়ে আমরা অনেক পড়াশোনা করেছি। সেই সময়ের স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করেছি। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ‘রয় টকিজ়’ তৈরি করা হয়েছিল। তার পরে চিত্রনাট্য অনুযায়ী সেট পরিকল্পনা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন যেমন দরকার, তখন সে রকম ভাবে কিছু জুড়ে দেওয়া, বা কিছু সরিয়ে নেওয়া। এ ভাবেই পুরো কাজটা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: বলিউডে পিরিয়ড ড্রামা ঘরানার ছবি বললেই সঞ্জয় লীলা ভন্সালী, আশুতোষ গোয়ারিকরের মতো পরিচালকদের কথা মনে পড়ে। এই পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে?
অপর্ণা: হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে শুধু ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ ঘরানার ছবিতেই নয়, অন্য ধরনের ছবিতেও কাজ করতে চাই। আমি এমন যে কোনও ছবিতে কাজ করতে চাই, যার চিত্রনাট্যের বুনোট ভাল, যা একটা ভাল গল্প বলে। সেটা ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ যে হতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। গল্পটা ভাল হলেই হল। সৌভাগ্যবশত, বলিউডে আমি এখনও পর্যন্ত একাধিক নামী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। আমার কোনও অভিযোগ নেই!
প্রশ্ন: ‘জুবিলি’তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন টলিউড তারকা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
অপর্ণা: আসলে প্রোডাকশন ডিজ়াইনার হিসাবে আমার সব থেকে কম কথা হয় অভিনেতাদের সঙ্গে। আমার মনে হয় না, অভিনেতারা খেয়ালও করেন যে, কে প্রোডাকশন ডিজ়াইনার। তবে, অভিনেতা হিসাবে তিনি দারুণ। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরে পরিচয় হয়নি। মেকআপ শিল্পী, পোশাকশিল্পী, ক্যামেরাপার্সনের সঙ্গে অভিনেতাদের যতটা আদানপ্রদান হয়, প্রোডাকশন ডিজ়াইনারের সঙ্গে সেই আদানপ্রদানের ততটা জায়গা নেই। আমাকে তো সারা দিন সেটের মধ্যে ছোটাছুটি করে বেড়াতে হত!
প্রশ্ন: সিনেমার শহর বলে কলকাতার বেশ নামডাক আছে। আপনি নিজেও সত্যজিৎ রায়ের ছবি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন ‘জুবিলি’র জন্য। ভবিষ্যতে কলকাতায় শুট করার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা কিছু আছে?
অপর্ণা: সে রকম চিত্রনাট্যের উপরে কাজ করার সুযোগ পেলে তো অবশ্যই! মুম্বইয়ে কলকাতার আদলে সেট তৈরি করার থেকে কলকাতায় শুটিং করা অনেক বেশি ভাল। তার উপর এই শহরের পরিবেশ, স্থাপত্য, খাবারদাবার আমার খুব ভাল লাগে। সুযোগ পেলে আমি একদম রাজি!