কলেজের করিডোরে গোলাপি শাড়িতে তরুণীকে দেখে বন্ধুদের বলেই ফেলেছিলেন, ওই তরুণীকে তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু তারপর বলা তো দূর অস্ত। তরুণীর কাছে যেতেই ভয় করত। তবু সেই তরুণীর সঙ্গেই দাম্পত্যের দীর্ঘ বসন্ত কাটিয়ে ফেললেন পরেশ রাওয়াল।
মুখচোরা পরেশকে প্রথমে পছন্দ ছিল না স্বরূপ সম্পতেরও। তিনিও বিশেষ গুরুত্ব দেননি সহপাঠীকে। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল ইন্টার কলেজিয়েট এক প্রতিযোগিতায়। সেখানে নাটকে অভিনয় করেছিলেন পরেশ।
চেনা সহপাঠীকে মঞ্চে দেখে স্বরূপ তো হতবাক। চেনা-ই যাচ্ছে না। কোথায় সেই মুখচোরা তরুণ! মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন স্বরূপ। নাটক শেষ হওয়ার পরে সাজঘরে অভিনন্দন জানাতে গেলেন। সেখানেই প্রথম আলাপের সূত্রপাত।
মুম্বইয়ের ভিলে পার্লের নরসি মোনজী কলেজ অব কমার্স অ্যান্ড ইকনমিক্সের পড়ুয়া ছিলেন পরেশ ও সম্পত। নাটক দেখতে ভালবাসতেন দু’জনে। এই ভাললাগা ছিল তাঁদের প্রেমের অনুঘটক।
সাতের দশকের শেষে তাঁদের আলাপ। কিন্তু বিয়ের আগে তাঁদের প্রেমপর্ব ছিল দীর্ঘ। কেরিয়ারকে সময় দিয়েছেন দু’জনেই।
ইংল্যান্ডের উরস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন স্বরূপ। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কীভাবে নাটককে বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের শিক্ষণের কাজে লাগানো যায়।
স্বরূপের বাবার ইচ্ছে ছিল, মেয়ে মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিক, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলেন না স্বরূপ নিজে। সে সময় তাঁর পাশে দাঁড়ান পরেশ। মূলত তাঁর উৎসাহেই ১৯৭৯ সালে মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন স্বরূপ এবং বিজয়িনী হন। সে বছর অস্ট্রেলিয়ার পারথে মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্বরূপ-ই।
তবে এরপপর কিছুটা সমস্যা দেখা দেয় তাঁর এবং পরেশের সম্পর্কে। স্বরূপকে নিয়ে কিছুটা সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন পরেশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের ছন্দে ফিরে আসে তাঁদের রসায়ন।
সত্তরের দশকে আলাপের পরে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে পরেশ-স্বরূপের প্রেমপর্ব। তবে তাঁদের সম্পর্কের কথা বাইরের লোক খুব বেশি জানতেন না।
ইন্ডাস্ট্রিতে ক্রমে নিজেদের জায়গা খুঁজে পান দু’জনে। এখন পরেশ রাওয়াল অনেক বেশি পরিচিত নাম হলেও তাঁর স্ত্রীও একসময় বেশ কিছু ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। স্বরূপকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘নরম গরম’-এ। অমল পালেকরের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন তিনি।
এরপর ‘নাখুদা’, ‘সওয়াল’, ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘লোরি’, ‘করিশ্মা’, ‘বহু কি আওয়াজ’ ছবিতে অভিনয় করেন স্বরূপ। ১৯৮৭ সালে তিনি বিয়ে করেন পরেশকে। এরপর হিন্দি সিনেমায় অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে কার্যত পাওয়া-ই যায়নি।
তাঁদের বিয়ের আসর ছিল বাহুল্যবর্জিত। পরে স্বরূপ এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল মুম্বইয়ের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। ন’জন পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয় বিয়ের আচার অনুষ্ঠান।
তাঁদের বিয়ের অসর ছিল মণ্ডপহীন। পরেশ-স্বরূপ নতুন জীবনে পা রাখার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন প্রাচীন একটি গাছের ছায়ায়। অন্য কনেদের মতো উপোস না করে থেকে স্বরূপ নিজের বিয়ের সব খাবারও খেয়েছিলেন। পরে মজা করে জানান তিনি নিজেই।
পরেশ-স্বরূপের দুই ছেলে অনিরুদ্ধ এবং আদিত্যও পা রেখেছেন বাবা-মায়ের দেখানো পথেই। ‘সুলতান’ ছবিতে সহকারী পরিচালকদের মধ্যে একজন ছিলেন অনিরুদ্ধ। থিয়েটারে নাসিরুদ্দিন শাহর সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ছোট ছেলে আদিত্য পড়াশোনা করছেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
মডেলিং-অভিনয় থেকে সরে গেলেও স্বরূপ কিন্তু বরাবর যুক্ত ছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ওয়ার্কশপ করেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন, কীভাবে নাটক বা অভিনয় করার গুণকে ছোটদের মানসিক বিকাশের কাজে লাগানো যায়।
দীর্ঘ বিরতির পরে অবশ্য স্বরূপ কয়েক বছর আগে ফিরেছেন হিন্দি সিনেমায়। ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাথিয়া’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। আবার প্রায় দেড় দশক পরে তিনি অভিনয় করেন বলিউডের হিন্দি ছবিতে।
২০১৬ সালে মুক্তি পায় স্বরূপ অভিনীত, আর বাল্কির ছবি ‘কি অ্যান্ড কা’। তিন বছর পরে ২০১৯-এ ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এও সুহাসিনী শেরগিলের ভূমিকায় নজর কাড়েন স্বরূপ। সিনেমার পাশাপাশি আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি কাজ করেছেন ছোট পর্দাতেও।
নাটকের সাজঘরে শুরু হয়েছিল পরেশ-স্বরূপের প্রেম। জীবনের মঞ্চের সাজঘরেও কয়েক বসন্ত পেরিয়ে তাঁদের বন্ধন আগের মতোই নিবিড়।