পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: নিরুপম দত্ত
প্র: আপনার প্রযোজনা সংস্থা শুরু করার নেপথ্যে নাকি ‘ট্যাংরা ব্লুজ়’-এর ভূমিকা রয়েছে?
উ: হ্যাঁ, এই প্রজেক্টটা কেন্দ্র করেই রোডশো ফিল্মস তৈরি হয়েছিল। তার পরে এত ছবি করেছি কিন্তু এই ছবিটা করা হয়নি। ‘বাবার নাম গান্ধীজি’ ছবিতে যে বাচ্চা ছেলেটি ছিল, ও সঞ্জয় মণ্ডলের গ্রুপে বাজাত। ওর সঙ্গে একদিন ট্যাংরায় গিয়েছিলাম। এত বাচ্চা সকলেই কিছু না কিছু বাজাচ্ছে, সব দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম! তখনই ছবির ভাবনা মাথায় ঘুরছিল। ওরাই জানাল, সুপ্রিয় সেন ওদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি করছেন। এ দিকে সুপ্রিয়দাকে আমি বাবা-মায়ের সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তখনই ঠিক হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে ফিচার ফিল্ম বানাব। এসভিএফ থেকে যখন একটা ফিচারের প্রস্তাব এল, তখন এই ছবিটার কথা তুলে ধরলাম। এটাই রোডশো-এসভিএফের প্রথম ছবি, যা সিনেমা হলে রিলিজ় করছে।
প্র: ছবিটা তো সঞ্জয় মণ্ডলের জীবনী নয়?
উ: না, আমার চরিত্রটা সঞ্জয়ের ছায়ায় তৈরি। কিছু ঘটনা বাস্তব থেকে নেওয়া, বাকিটা আমাদের বানানো।
প্র: সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে যা ঘটছে, তা কি ছবিকরিয়ে হিসেবে আপনাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে?
উ: শুধু সিনেমা কেন? নাটক, সার্কাস সব কিছুই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। আশপাশে যা চলছে, তাতে ভাবতে হবে, এর পর আমরা নতুন কী ড্রামা দেখাব!
প্র: রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আপনার কাছেও এসেছিল। গেলেন না কেন?
উ: প্রথমত, আমি এখন স্বাধীন। আর সেই স্বাধীনতা আমাকে অনেক কথা বলার জোর দেয়। কোনও দলে নাম লেখালে, অন্য সব দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আর নিজের দলের কোনও কিছুতে আপত্তি থাকলে, মুখ বুজে থাকতে হবে। অন্তত এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী। আর একটা জিনিসে আমি বিশ্বাস করি, দলীয় রং না লাগিয়ে কোনও মানুষ যখন কিছুর বিরোধিতা করে, জনসাধারণের কাছে তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। লোকে জানে, এর কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। নিজের এই স্বাধীনতার সঙ্গে এই মুহূর্তে অন্তত আপস করতে পারব না। দ্বিতীয় কারণ, ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি যে পরিমাণ ব্যস্ত, তাতে হাতে একদম সময় নেই।
প্র: ‘নিজেদের মতো নিজেদের গান’-এর জনপ্রিয়তা কি এই কারণেই যে, অংশগ্রহণকারী অধিকাংশের সঙ্গেই সরাসরি রাজনীতির যোগাযোগ নেই?
উ: অন্যান্য ভাষায় গানটা অনুবাদ করা হয়েছে। লোকের কোথাও মনে হয়েছে, এদের বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। এরা কোনও দলকেই সমালোচনা করতে ছাড়ে না। রাজনীতিটা আসলে বিশ্বাসের, যা মন থেকে আসে। তবে এই বিশ্বাসটাই আর কেউ রাখেনি এখন। আমরা একটু রাখার চেষ্টা করছি (হেসে)!
প্র: আপনার অনেক বন্ধুই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হয়?
উ: হ্যাঁ, কাঞ্চন (মল্লিক) আছে। রুদ্র (রুদ্রনীল ঘোষ) আছে। আলাদা করে কথা হয়নি। ‘অভিযান’-এর ট্রেলার রিলিজ়ের সময়ে রুদ্রকে বলেছিলাম। ছবিতে ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছে। আমরা এখনও বন্ধু, রাজনৈতিক দিক থেকে বিপরীত চিন্তাভাবনার হলেও।
প্র: বন্ধুত্ব আর রাজনীতি গুলিয়ে যাচ্ছে না?
উ: আমার কাছে ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট। আমাদের সকলেরই কর্মক্ষেত্র এক। রুদ্রর সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও, এমন নয় যে, রোজ কথা না বললে আমাদের ভাত হজম হত না। কাজের সময়ে গল্প-আড্ডা হত। সেই সৌজন্যবোধটা নিঃসন্দেহে থাকবে আগামী দিনেও। কিন্তু আমার কাছে বন্ধুত্বের একটা অন্য মানেও আছে। বন্ধুত্বের নানা স্তর হয়। একজন বন্ধুর সঙ্গে যে আত্মিক ঘনিষ্ঠতা থাকে, সেটা হয়তো আর থাকবে না। আমরা যে মতাদর্শ বা ভাবনায় বিশ্বাসী, তা বলে দেয় মানুষ হিসেবে আমরা কেমন। সেই জায়গা থেকে রুদ্রর সঙ্গে একটা তো বিরোধিতা রয়েছেই। তা ছাড়া কাজের জগতের প্রায় সব বন্ধুত্বই সৌজন্যের। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সকলেই সিনেমার জগতের বাইরের মানুষ।
প্র: অনেকের মতে, এখনকার পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য দলীয় পরিচিতি জরুরি। আপনার কাজের ক্ষেত্র ও উপার্জন শুধু টলিউডকেন্দ্রিক নয়। সেটাই কি মুখ খোলার সাহস জোগাচ্ছে?
উ: এই পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না। হাওয়া গরম করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে মেরুকরণ করছে। দেখবেন, ছ’মাসের মধ্যে এই হাওয়াটা কেটে যাবে। আমি যদি হিন্দিতে কাজ না-ও করতাম, তা হলেও এই কথাগুলোই বলতাম। এই গানটায় যাঁরা আমার পাশে ছিলেন, তাঁরা সকলে হিন্দিতে কাজ করেন না। তা-ও যদি তাঁরা নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে পারেন, আমিই বা পারব না কেন?
প্র: আপনার বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ— ‘পরমব্রত যখন চিটফান্ডের টাকায় সিনেমা করেছিল, তখন ওর নৈতিকতা কোথায় ছিল?’ কী বলবেন এটা নিয়ে?
উ: আমি তো কাউকে চিটফান্ড নিয়ে আক্রমণ করিনি। তা হলে সেই প্রসঙ্গ আসছে কেন? একটা সময়ে চিটফান্ডের টাকায় গোটা ইন্ডাস্ট্রি চলত। আমি চিটফান্ডের টাকা তোলার জন্য কাউকে সাহায্য করিনি। যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরাও চিটফান্ডের টাকায় শুধু অভিনয় কেন, আরও অনেক কিছুই করেছেন। সেগুলো এখন বেরিয়ে এলে হয়তো অনেকের প্রার্থী পদ বাতিলও হয়ে যেতে পারে। কিংবা হয়তো তাঁরা সেগুলো থেকে বাঁচতেই রাজনীতিতে ঢুকেছেন। তাই এই আলোচনায় ঢুকে লাভ নেই। তর্কটা রাজনৈতিক আঙিনাতেই রাখতে পারি আমরা। আমি তো ব্যক্তিগত আক্রমণে যাইনি। আমাকেও কেউ ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না। তা হলে আমাকেও সৌজন্য ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে হবে।