দশহরার দু’দিন পরে জন্ম। বলতেন তাঁর মা। নির্দিষ্ট দিন মনে রাখেননি পরিবারের কেউ। স্কুলে ভর্তি করানোর সময় কাকা খাতায় লিখলেন, ৯ মার্চ, ১৯৫০’। সেটাই রয়ে গেল। পরে তিনি নিজেই হিসেব করে স্থির করে নেন জন্মদিন, ১৮ অক্টোবর, ১৯৫০। এভাবেই নিজের শর্তে জীবনকে সাজিয়েছিলেন অভিনেতা ওম পুরী।
জন্ম পঞ্জাবের অম্বালায় এক নিম্নবিত্ত পরিবারে। বাবা রাজেশ পুরী ছিলেন রেলকর্মী। কিছুদিন কাজ করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও। শৈশবেই গৃহহীন হয়ে পড়ে পরিবার। কারণ সিমেন্ট চুরির দায়ে তাঁর বাবাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়।
দিশেহারা অনটনের সংসারের অন্নসংস্থানের জন্য বাধ্য হয়ে ওম পুরীর দাদা বেদপ্রকাশ পুরী মালবাহকের কাজ নেন। স্থানীয় চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটার কাজ নেন ওম পুরী নিজে।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন ওম পুরী। বাড়িতে অভিনয়ের ধারা না থাকলেও ওম পুরী এর প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। পড়াশোনার শেষে যোগ দেন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-য়।
সেখানে সহপাঠী নাসিরুদ্দিন শাহের কথায় ওম পুরীর পরবর্তী গন্তব্য ছিল পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। তবে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ওম পুরীর সব স্বপ্ন ধাক্কা খায়। তিনি হতাশ হয়েছিলেন এর শিক্ষণ পদ্ধতিতে। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন নিজের হতাশার কথা।
সেইসঙ্গে বলেছিলেন, তাঁর অভাবী সংসারে একটা ঠিকঠাক জামাও ছিল না ইনস্টিটিউটের ক্লাসে পরে যাওয়ার জন্য। জীবনযুদ্ধের এই ভয়াবহতার সাক্ষী তিনি ছিলেন দীর্ঘদিন।
ওম পুরীর প্রথম ছবি ছিল ‘চোর চোর চুপ যা’। ছোটদের জন্য তৈরি এই ছবিতে অভিনয় করেই অভিনেতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ।
মূলধারার ছবিতে তাঁকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৭৬ সালে, মরাঠি ছবি ‘ঘাসিরাম কোতয়াল’-এ। সমান্তরাল হিন্দি ছবির ঘরানা যে সব কারিগরের হাতে তৈরি হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ওম পুরী অন্যতম।
‘মির্চ মসালা’, ‘ধারাবী’, ‘অর্ধ সত্য’, ‘সদগতি’, ‘আক্রোশ’, ‘গাঁধী’, ‘দ্রোহকাল’, ‘হে রাম’ এবং টেলিছবি ‘তমস’-সহ অজস্র মণিমুক্তো দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকে।
বলিউডের বাণিজ্যিক ছবির ঘরানাতেও তাঁর দৃপ্ত উপস্থিতি। চরিত্রাভিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি তাঁর হাত ধরে ফিরেছে হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যে। চেনা ভাবমূর্তি ছেড়ে কৌতুকাভিনেতার ভূমিকাতেও তিনি প্রতিভার ছাপ রেখে গিয়েছেন।
‘জানে ভি দো ইয়ারো’, ‘চাচি ৪২০’, ‘হেরা ফেরি’, ‘চোর মচায়ে শোর’, ‘মালামাল উইকলি’-র মতো ছবিতে তাঁর অভিনয়ে হাস্যরসের সুনিপুণ প্রয়োগ।
আবার ‘রং দে বসন্তী’, ‘গদর’, ‘লক্ষ্য’, ‘সিং ইজ কিং’, ‘মেরে বাপ পহলে আপ’, ‘বজরঙ্গী ভাইজান’-এর মতো ছবিতে তিনি ধরা দেন সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে।
যে সব ভারতীয় অভিনেতা সমাদৃত হয়েছেন আন্তর্জাতিক বিনোদন মঞ্চে, ওম পুরী তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে। বলিউডের মতো ব্রিটিশ ছবি ‘মাই সন দ্য ফ্যানাটিক’, ‘ইস্ট ইজ ইস্ট’, ‘দ্য প্যারোল অফিসার’, হলিউডের ছবি ‘সিটি অব জয়’, ‘দ্য ঘোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস’, ‘চার্লি উইলসনস ওয়ার’-এও তাঁর অনায়াস ও দক্ষ গতি।
টেলিভিশনে কাজ করা নিয়েও তাঁর মধ্যে কোনও উন্নাসিকতা ছিল না। ‘ভারত এক খোঁজ’, ‘যাত্রা’, ‘অন্তরাল’-এর মতো শো-এর পাশাপাশি তাঁকে ‘আহট’, ‘সাবধান ইন্ডিয়া’-তেও।
১৯৯১ সালে ওম পুরী বিয়ে করেন পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার সীমা কপূরকে। কিন্তু মাত্র আট মাসের মধ্যে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সীমার অভিযোগ, সাংবাদিক নন্দিতা-ই তাঁদের বিচ্ছেদের কারণ। সীমার সঙ্গে বিবাহিত অবস্থাতেই নন্দিতার সঙ্গে নাকি লিভ ইন করতেন ওম পুরী। সব জানার পরেও প্রথমে তাঁদের দাম্পত্যকে সময় দিতে চেয়েছিলেন সীমা। কিন্তু শেষ অবধি তিনি সরে আসেন।
এই ঘটনার জেরে সীমার দাদা অভিনেতা অন্নু কপূর কোনওদিন ক্ষমা করতে পারেননি ওম পুরীকে। অন্নুর অভিযোগ ছিল, ওম পুরীর সঙ্গে সম্পর্কের এই টানাপড়েনেই নষ্ট হয়ে যায় তাঁর বোনের গর্ভস্থ সন্তান।
১৯৯৩ সালে ওম পুরী বিয়ে করেন সাংবাদিক নন্দিতাকে। তাঁদের একমাত্র সন্তানের নাম ঈশান।
২০০৯ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায় ওম পুরীর জীবনীকে কেন্দ্র করে। ‘আনলাইকলি হিরো: দ্য স্টোরি অব ওম পুরী’ নামে বইটি লিখেছিলেন নন্দিতা নিজেই। কিন্তু বইটি প্রকাশ হতেই চরমে ওঠে দাম্পত্য তরজা।
ওম পুরী অভিযোগ করেন, বই প্রকাশের আগে নন্দিতা তাঁকে পাণ্ডুলিপি দেখাননি। তাঁর সম্বন্ধে কুরুচিকর বিবরণ বইয়ে আছে বলে অভিযোগ করেন বর্ষীয়ান অভিনেতা।
একাধিক সম্পর্কে ওম পুরী লিপ্ত ছিলেন, জীবনীতে জানিয়েছেন নন্দিতা। যে পরিচারিকা তাকে বড় করেছিলেন, তার সঙ্গেও কৈশোরে ওম পুরীর সম্পর্ক ছিল বলে উল্লেখ করেন নন্দিতা। ক্রমশ বিবাদ গিয়ে পৌঁছয় প্রকাশ্য কাদা ছোড়াছুড়িতে।
এই বইকে কেন্দ্র করে ওম-নন্দিতার সম্পর্ক ভেঙে যায়। ছেলে ঈশানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান সাংবাদিক নন্দিতা। স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ আনেন। তবে আলাদা থাকলেও তাঁদের ডিভোর্স হয়নি।
২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ওম পুরীর মৃত্যু সংবাদ হতচকিত করে দেয় তাঁর অনুরাগীদের। মুম্বইয়ের অন্ধেরিতে নিজের বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ৬৬ বছর বয়সি এই বলিষ্ঠ অভিনেতা।
অভিনয়ের পাশাপাশি ভালবাসতেন রাঁধতে আর বাগান করতে। শখ ছিল চাষবাসেরও। একবার রাজ্যসভা টিভিকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন, একটি ধাবা শুরু করবেন। নাম দেবেন ‘ডাল রোটি’। সেই স্বপ্ন, সঙ্গে আরও অনেক প্রজন্মজয়ী ছবি উপহার দেওয়ার ইচ্ছেকে অধরা রেখেই ওম পুরী চলে গেলেন দিকশূন্যপুরে।