ছোটদের নাটকের পাঠ দিচ্ছেন দেবেশ
তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ। মঞ্চে ওরা ২২ জন। বয়স ১৩ থেকে ১৮-র মধ্যে। বেলা বারোটা থেকে রাত আটটা মঞ্চে বসেই থিয়েটারের পাঠ নিচ্ছে সেই কিশোর-কিশোরীরা। নাটক আসলে কী, ওদের শেখাচ্ছেন খ্যাতনামী নাট্যকাররা। শহরের বুকে সে এক বিরল দৃশ্য! অতিমারির বন্দিদশা কাটিয়েই কিশোর-কিশোরীরা প্রথম যে টানে ছুটে এসেছে, তা হল নাটক। উৎপল দত্তের নাটক।
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে উৎপল দত্তের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা লিটল থিয়েটার।’ ১৯৭১ সালে সেই নাট্যদলের রেজিস্ট্রেশন হয় ‘পিপলস্ লিটল থিয়েটার নামে।’ সেই হিসাবে ধরলে গত বছরই পঞ্চাশ পার করেছে নাট্যদলটি। কোভিডের কারণে উদ্যাপন হচ্ছে চলতি বছর। যার অঙ্গ হিসাবে পিপলস্ লিটল থিয়েটার (পিএলটি)-এর উদ্যোগে ৫ দিন ব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে এক দিন প্রশিক্ষক হয়ে এসেছিলেন ‘ব্যারিকেড’ পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। তা ছাড়াও প্রশিক্ষক হিসাবে ছিলেন অঞ্জন দেব, বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত, নীলাঞ্জনা বিশ্বাস এবং দিল্লির জননাট্য মঞ্চের সদস্য কমিতা ধান্দা। নাটকগুলির প্রশিক্ষণ হয়েছে নীলাঞ্জনা এবং কমিতার তত্ত্বাবধানে।
কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের উৎপল দত্তের নাটক কী ভাবে বর্তমানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? বুর্জোয়া সমাজের বুকে শ্রমজীবীদের চিরন্তন লড়াই কি চিনে নিতে পারবে এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা? আনন্দবাজার অনলাইন সে প্রশ্ন রেখেছিল প্রশিক্ষক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।
উত্তরে দেবেশ বললেন, ‘‘ওরা মেধাবী। ওরা সব বোঝে। রাজনীতি মানেই রাজনৈতিক দল নয়। থিয়েটার বৃহত্তম রাজনীতির কথা বলে। রাজনীতি আর জীবনবিচ্ছিন্ন নয়। জীবনযাপন করতে গেলে রাজনীতি তো বুঝতেই হবে। সেই পাঠই দিচ্ছিলাম ওদের। ওদের বুঝতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’’
‘ব্যারিকেড’ থেকে ‘ব্যারিকেড’
নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস, জীবন ও থিয়েটারকে এক সূত্রে বেঁধেছিলেন উৎপল দত্ত। দুর্ঘটনার কবলে পড়া কয়লাখনিতে ঢুকে শ্রমিকদের বয়ান শুনে ১৫ দিনে লিখে ফেলেছিলেন কালজয়ী নাটক ‘অঙ্গার’।
সে নাটকের উদাহরণ নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরি বলেই মনে করছেন পিএলটি গোষ্ঠী।
গণনাট্যের আদর্শ, বিপ্লব, হাতিয়ারের অনুষঙ্গ— সবই যৌবনে প্রবেশের আগে জানা থাক ওদের, এমনটাই চান কর্তৃপক্ষ। তাঁরা কর্মশালার আয়োজন করেছেন মূলত কিশোরদের জন্যই।
দেবেশ বললেন, ‘‘অভিভাবকদের সচেতনতাকেও কুর্নিশ করি, যাঁরা বাচ্চাদের এখানে নিয়ে এলেন। ২২ জনের থেকে ৫-৬ জনও যদি আগামী জীবনে নাটককে বেছে নেয়, তাতে নাটকেরই ভাল।’’
কিন্তু ছবি, ধারাবাহিকের যুগে নাটক ওদের কী দেবে? দেবেশের মতে, অনেক কিছু। তাঁর কথায়, ‘‘এখনকার যুগের একটা প্রবণতা হল দ্রুত বিখ্যাত হতে চাওয়া। বেশিরভাগ শিশুর মধ্যে সারা ক্ষণ একটা অস্থিরতা কাজ করে। উদ্বেগ, বিষাদ মনে ভিড় করে। সেগুলো মোকাবিলার উপায় নাটক।’’
পরিচালক জানান, ছোট থেকে থিয়েটারের অভ্যাস তৈরি হলে মানবিকতা বোধ গড়ে ওঠে। শিশু মনে সমাজ সচেতনতার উন্মেষ হয়। এক শিশু আর এক শিশুর অনুভূতি বুঝতে পারে। পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের বড় রাস্তা এই শিল্পমাধ্যম।
তা ছাড়া, নাটক সমন্বিত শিল্প। সব শিল্পের গুণ এতে রয়েছে। নাচ-গান-কথা বলার ক্ষমতা আত্মবিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক। আর আনন্দ? সে তো অফুরান।
৩ থেকে ৭ জুন, অর্থাৎ আজই শেষ দিন পিএলটির থিয়েটার কর্মশালার। ২২ জন কিশোর-কিশোরী এই ৫ দিনে দুটো নাটক তৈরি করে ফেলেছে। একটি পথনাটক আর একটি মঞ্চনাটক। উৎপল দত্তের স্প্যানিশ গল্পের অনুবাদ ‘অভিনেতার মুখ’ অবলম্বনে মঞ্চনাটকটি তৈরি করেছে ওরা। মঙ্গলবার সন্ধেয় শো। ওদের নিরন্তর চেষ্টা এবং নাটকের প্রতি আগ্রহ-ভালবাসা দেখে মুগ্ধ দেবেশও।
বললেন, ‘‘আমি এখনও শিখি, রোজ শিখছি। সে কথাই ওদের বললাম। যাতে বোঝা যায়, এটা একদিনের অনুষ্ঠান নয়। দীর্ঘ দিনের সাধনা।’’
কিচ্ছু বদলায়নি আসলে। পিএলটির সুবর্ণ জয়ন্তী এসে পড়লেও দূরদর্শিতার প্রমাণ দিচ্ছেন প্রয়াত নাট্যকার। দেবেশেরও উপলব্ধি, ‘‘সেই পঞ্চাশ বছর আগের ‘ব্যারিকেড’ এখনও যখন পরিচালনা করি, মানুষ সংযোগ স্থাপন করতে পারে।’’
উৎপল দত্ত সে যুগের অভিনেতা, লেখক, সর্বোপরি নাট্যকার। মতাদর্শে তিনি ছিলেন মার্কসবাদী। স্রেফ থিয়েটারের জন্য পুলিশি নির্যাতন থেকে কারাবাস। নিজেরই নাট্যদল থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন তিনি। জীবনভর চড়াই-উতরাই যাঁর জীবন, তিনিই এক দিন মিনার্ভা থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেছেন পিপলস্ লিটল থিয়েটার বা পিএলটি। যে নাট্যদলের বয়স ৫০ ছাড়াল। নাট্যকারের লেখা ‘ব্যারিকেড’-এর বয়সও ৫০। সেই ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বছরভর কর্মসূচি নিয়েছে পিএলটি। যার শুরুটা হয়েছে নাট্যকারের জন্মদিন, অর্থাৎ ২৯ মার্চে। চলবে ৩১ ডিসেম্বর অবধি।
বছরভর উৎপল দত্তের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা সভা, কর্মশালা, অনলাইন নাট্য উৎসব থেকে নাটক প্রতিযোগিতার মতো নানা কিছুর আয়োজন করেছে নাট্যকারের প্রাণের দল। যে পরিক্রমার নাম ‘ব্যারিকেড’ থেকে ‘ব্যারিকেড’।