ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
সোম-বুধ-শুক্র রাত দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা কলকাতার রাস্তা শুনশান। বাঙালির ডিনার টাইম বদলে দিয়েছে ‘সারেগামাপা’। ভেবেছিলেন এমন হবে?
রিয়েলিটি শো-তে আগেও লোকসঙ্গীত গাওয়া হয়েছে। প্রতিযোগীরা কিশোর-আশা-লতা গাইতে গাইতে ‘সাধের লাউ’ গেয়েছেন। কিন্তু জি-বাংলা যখন লোকসঙ্গীত নিয়ে একটা সেকশন করার কথা বলে, তখন পরিচালক অভিজিৎ সেন-কে বলেছিলাম লোকসঙ্গীত যদি করতেই হয়, তা হলে কেবল প্রতিযোগীদের দিয়ে লোকগান গাওয়ালেই চলবে না। লোকসঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের ‘সারেগামাপা’র মঞ্চে আনতে হবে। আমি কৃতজ্ঞ, ‘সারেগামাপা’র অভিজিৎ সেন এই সাহসটা দেখিয়েছেন। তবে ভেবেছিলাম খুব বেশি হলে হয়তো আমার মেয়াদ মাসখানেক। পাততাড়ি গুটিয়ে কেটে পড়তে হবে। টিআরপি পড়ে যাবে।
টিআরপি শুধু চড়চড়িয়ে উঠলই না, আজকের প্রজন্ম, যাঁরা এক সময় কীর্তন শুনলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন, তাঁরা শুনছেন কীর্তন, ঝুমুর, সারি...
জানেন, অদিতি মুন্সি যখন অডিশন দিতে এসেছিলেন, তখন কীর্তন ছাড়া সব গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সবশেষে উনি যখন কীর্তনের একটা ‘রেয়ার’ পদ গেয়ে শোনান, তখন ওঁকে আমরা বলি শুধু কীর্তনই গাইতে। প্রথম যেদিন কীর্তন গাওয়া হল, শান্তনুদা (মৈত্র), শুভাজি (মুদগল), উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। লোকগানে ঋষি, স্নিতা, সৌম্য সকলেই খুব ট্যালন্টেড।
কীর্তন নিয়ে তো আপনার ফেসবুকে নানা মন্তব্য ...
আমরা শুনেছি, বিশ্বাসও করেছি নতুন প্রজন্ম লোকগান নিয়ে অতটা আগ্রহী নন। এটা একদম ভুল। তীর্থকে দোতারা বাজিয়ে গান গাইতে দেখে আমার ফেসবুকে নয় নয় করে ৫০-টা মেসেজ— সবাই দোতারা শিখতে চান। সারিন্দা দেখে এতটাই উত্তেজিত আজকের প্রজন্ম যে ১০০-টা ফোন পেয়েছি, ‘দাদা, সারিন্দা শেখান’। এঁদের সকলেরই বয়স তিরিশের নীচে। কীর্তন আমাদের রক্তে। শুনে মানুষ রিঅ্যাক্ট করবেনই। এখন তো প্রায়ই চ্যানেলে ফোন আসে, কীর্তন গানের শিল্পী চাই। শুধু কীর্তনের অনুষ্ঠান হবে।
আচ্ছা এই যে মালদা, সিলেট, পুরুলিয়া, পুব বাংলা বা আরও নানা অঞ্চলের গান প্রতিযোগীরা গাইছেন, সেখানকার মানুষদের কোনও প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
আসলে ‘রুট মিউজিক’ মানুষের ভেতরে ধাক্কা দেয়। পুরুলিয়ার এক যুবক ফোন করে একদিন বললেন, ‘আপনি তো পুরুলিয়ার লোক নন। যে মেয়েটি ঝুমুর গাইছেন, তিনিও পুরুলিয়ার নন। অথচ তাঁর গান শুনে মনে হচ্ছে আমিই ওই মঞ্চে আছি।’’ তিনি এমন ভাবে বললেন, মনে হল প্রতিযোগী যেন ওই অঞ্চলেরই প্রতিনিধি।
কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় স্টেজ ডেকর থেকে পোশাক— লোকগানকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। জাঁকজমক না থাকলে কি এই গান এত জনপ্রিয় হত?
পারফর্ম্যান্স এখানে একটা বড় ব্যাপার। শান্তনুদা বলেছিলেন এটা আর রিয়েলিটি শো নেই, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে। যখন ‘সোহাগ চাঁদবদনি’ গাওয়ানো হচ্ছে, তার সঙ্গে পা ঘষে ঘষে ওই নাচ দেখে লোক মুগ্ধ! নাগাদের নাচ, বিহু বা রণ-পা নৃত্য গানগুলোকে আরও ভাইব্র্যান্ট করে তুলেছে। দেখুন মানুষ বোকা নন। তাঁরা নিশ্চয়ই চাইবেন না ‘সারেগামাপা’র প্রতিযোগীরা যখনই বাইরে বা মঞ্চে একক ভাবে গাইবেন, তখনও কুড়ি জন মিউজিশিয়ান, লাইট নিয়েই অনুষ্ঠান করবেন। তাই এটা ভাবার কারণ নেই যে তাঁরা এর পর আর অনুষ্ঠান পাবেন না।
তা হলে? তাঁরা যদি অ্যালবাম বের করেন, সেটাও লোকে নেবে বলছেন?
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি অ্যালবাম একেবারেই বিক্রি হয় না, এটা ঠিক নয়। তবে সংখ্যাটা আর আগের মতো নেই। একটা ব্যাপার পরিষ্কার বলি। ‘সারেগামাপা’, প্রতিযোগীদের গান শেখানো থেকে পারফর্ম্যান্স—পুরোটাই হাতে ধরে শিখিয়ে দিচ্ছে। ভাবুন তো কী সব দুর্দান্ত মিউজিশিয়ান সঙ্গত করছেন ওঁদের গানের সঙ্গে! রোশন আলি এসে সারেঙ্গি বাজিয়ে যাচ্ছেন। আলি আহমেদ আসছেন সানাই বাজাতে। কলকাতার প্রখ্যাত মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে ওঁরা রিহার্স করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটা কিন্তু আমরা কেউই পাইনি। এই বাজারে যখন সিডি কেউ শোনেন না, শুধু সিনেমার গান রেডিয়োয় বাজে, সেখানে এই প্রতিযোগীদের গান কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। একজন উঠতি শিল্পীর কাছে এটা কত বড় পাওয়া! কিন্তু আসল লড়াই শুরু ‘সারেগামাপা’র পর। তখন প্রতিযোগীদের ভাবতে হবে পারফর্ম্যান্সটা কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বা ধরে রাখবেন।
লোকসঙ্গীত তো আগেও রিয়েলিটি শো-তে গাওয়া হয়েছে। তার পর সেই শিল্পীরা হারিয়েও গিয়েছেন...
এবার বিষয়টা আলাদা। কোনও শিল্পীকে ছোট না করেই বলছি, সব ধরনের গান গেয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া শক্ত। তুলিকা-গঙ্গাধর কখনও সোনু নিগম বা শান-এর গান গাইবেন না। ওঁরা আগেও বাউল গাইতেন। এখনও তাই গাইবেন। মার্গসঙ্গীতের পিউ বা দীপন হঠাৎ করে নিজের এলাকা থেকে বেরিয়ে অন্য কোনও গান গাইবেন না। শুধুই তো লোকগান নয়, লোকশিল্পীদেরও প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে এই মঞ্চ। লোকশিল্প না বাঁচলে লোকশিল্পী বাঁচবে না। পার্বতী বাউল, মনসুর ফকিরদের মতো শিল্পী পারফর্ম করছেন এখানে। আমি তো চাই এ শহরে অন্যান্য নামী শিল্পীদের মতো মনসুর ফকিররাও লাখ টাকা নিয়ে অনুষ্ঠান করুন।
আর এই মঞ্চ থেকেই যদি ‘দোহার’য়ের মতো আরও একটা লোকগানের ব্যান্ড উঠে আসে?
আরে! আসুক না... বিশ্বাস করুন, আমি চাই এই মঞ্চ থেকেই ‘দোহার’য়ের মতো ব্যান্ড আসুক। আমি জানি তাতে হয়তো আমার কাজ কমবে। কিন্তু লোকগানের ক্ষেত্র তো বাড়বে! জানেন, আমি নাম করেই বলছি ইতিমধ্যেই শিকদারবাগান, দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটি থেকে মহিলা ঢাকিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রতিযোগীরাও ডাক পাচ্ছেন। তবে চ্যানেলের শর্ত অনুযায়ী শো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা বাইরে অনুষ্ঠান করতে পারবেন না।
বলা হচ্ছে এই রিয়েলিটি শোয়ের মধ্যে দিয়ে একদল গায়ক তৈরি হচ্ছেন যাঁরা পাবলিক শো-তে মানুষকে অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে হিন্দি-বাংলা-আধুনিক-লোকগান সব শুনিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর বাজার নষ্ট হচ্ছে...
এটা আমি মানি না। তা হলে রূপঙ্কর-রাঘব-মনোময়-শুভমিতা-লোপামুদ্রারা দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গান গাইতেন না। ‘দোহার’ তো দিব্যি টিকে আছে। এখনও বছরে একশোটা শো পাই আমরা।
লোকগান তো মাটি-মানুষ- ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকে। অনেকেই বলছেন খামখা আপনি লোকগানকে বাজারি করে তুলছেন। প্রচারের জন্য লাউড করছেন...
এটা আমিও শুনেছি। এখনকার দুনিয়ায় তো সবই বাজারি।
‘দোহার’-এর কালিকাপ্রসাদ এক সময় লোকগানে শুদ্ধতার ওপর জোর দিতেন। এখন লোকগানের সঙ্গে তো দিব্যি অন্য গান মিশিয়ে ফিউশনের রাস্তায় হাঁটছেন তিনি।
আজও শুদ্ধতার ওপর জোর দিই আমি। মানে লোকগানের সঙ্গে গিটার বাজুক, চাই না। আর এই মঞ্চে কোনও লোকগানের সঙ্গে অন্য গানের মিল পেলে বা লোকগানের আধারে অন্য গান তৈরি হলে, সেটা শোনানো হয়েছে। যেমন ‘দেখেছি রূপসাগরে’র সঙ্গে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ মেলানো হচ্ছে।
আচ্ছা বাংলাদেশে কোনও এক ছবির মিউজিক করছেন?
হ্যাঁ, ছবির নাম ‘ভুবন মাঝি’। নায়ক পরমব্রত। বাংলাদেশ সরকার প্রযোজনা করছে ছবিটা। কাজ বলতে এটাই।
১৫ অগস্ট ফেসবুকে লিখেছেন ভারতে আজও সব লোকের দু’বেলা অন্ন জোটে না। গান দিয়ে কি দারিদ্র, হিংসা সব কাটিয়ে ওঠা যায়? আপনার বিনয়টা একটু বেশি।
দেখুন, শিলচর থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ফিরে যাব। ফেরা হয়নি গানের টানেই। বিনয়ের কিছু নেই। গান দিয়ে অজস্র হানাহানি আগেও বন্ধ হয়েছে। আজও হবে।
‘সারেগামাপা’ শেষ হলে কী করবেন?
মনখারাপ হবে... ‘দোহার’ নিয়ে থাকব।
‘দোহার’য়ের কালিকাপ্রসাদ আর ‘সারেগামাপা’র কালিকাপ্রসাদ কি এক?
সঙ্গীত আয়োজক, শিক্ষকের এই ভূমিকায় গায়ক কালিকাপ্রসাদ কিন্তু চাপা পড়ে যায়নি। কোথাও গান সাজাচ্ছি, মাটির গন্ধ দিয়ে শিল্পীর কণ্ঠে তা অন্য চেহারা পাচ্ছে। নিজে যতই গাই, সৃষ্টি করার এমন অদ্ভুত আনন্দ আগে পাইনি।