সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটা মাধ্যম যেখানে আমরা নিজেদের পছন্দ, রুচি, মতামত দর্শাতে পারি। এমন একটা মাধ্যম, যা আমাদের পছন্দ, রুচি, মতামতে গভীর প্রভাব ফেলে। সেই প্রক্রিয়ায় নিজেদের অজান্তেই আমরা একটা চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ি। গত তিন-চার বছরে সোশ্যাল মিডিয়া সুনামির মতো আছড়ে পড়েছে মানুষের রোজকার জীবনে। স্পষ্ট করে বললে, গত ছ’মাসে। লকডাউন-আনলকের চক্রে ঘরবন্দি জীবনে সোশ্যাল মিডিয়া একমাত্র সহায়। আর সেই সহায় ক্রমশ আমাদের চেতনা-বুদ্ধিকে অসহায় করে দিচ্ছে। গোটা ঘটনার একটা পিঠ দেখে আমরা অন্য পিঠ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি। আলিয়া ভট্টকে নেপোটিজ়মের ফসল হিসেবে ট্রোল করতে গিয়ে যিশু সেনগুপ্তর মতো অভিনেতার কেরিয়ারকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ‘গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কার্গিল গার্ল’ ছবিতে জাহ্নবী কপূরের মতো স্টার কিডের পাশে যে লড়াই করে উঠে আসা পঙ্কজ ত্রিপাঠীও রয়েছেন, তা ভুলে যাচ্ছি।
সিনেমা না দেখেই কাউকে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? হ্যাশট্যাগ বয়কটের চাপে কোথাও কি ভুলে যাচ্ছি, ছবির মুখ কোনও তারকা-সন্তান হলেও, ছবিটিতে কয়েকশো মানুষের পরিশ্রম রয়েছে। অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত, ‘‘সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, কিছু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজেদের স্বার্থে চালনা করছে। নেপোটিজ়ম, ফেভারিটিজ়ম সব ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে। কাঠগড়ায় শুধু বিনোদন দুনিয়াই। যেহেতু এটা মতামত প্রকাশের সহজ রাস্তা, তাই সবটা তলিয়ে না দেখেই কারও ছবি বয়কট করে দেওয়া হচ্ছে। একটা কাজের পিছনে বহু লোকের অবদান থাকে, সেটা আমরা ভুলে যাচ্ছি। ক্রমাগত কুৎসা আমাদের রুচি, মানসিকতার ভারসাম্যটাকে চুরমার করে দিচ্ছে।’’
ভুলে গেলে চলবে না, আলিয়া ভট্ট, রণবীর কপূরদের কিন্তু সাধারণ মানুষই সুপারস্টার বানিয়েছেন। ‘‘নেপোটিজ়ম অবশ্যই খারাপ। কিন্তু কেউ যদি যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করেন, তা হলে কেন তাঁকে ট্রোল করা হবে?’’ প্রশ্ন অভিনেতার। ‘গুঞ্জন সাক্সেনা’ মুক্তির আগেই বয়কটের লেবেল লেগে গিয়েছিল। ‘সড়ক টু’-এর ট্রেলার ডিসলাইকের রেকর্ড গড়েছে, ট্রোলিংয়ের কারণে কর্ণ জোহরের আগামী চ্যাট শো বাতিল করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট চ্যানেল। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনা এগুলো। কারও প্রতি সুবিচার চাইতে গিয়ে অন্যদের প্রতি অবিচার হচ্ছে না তো? অভিনেতাদের ইনস্টাগ্রামে ফলো করা মানেই, তাঁদের সম্পর্কে যা খুশি বলার অধিকার জন্মায় না, বলছিলেন পরমব্রত। কর্ণ জোহর স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছাই জানান কিংবা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, টুইটারে তাঁর পোস্টের নীচে গালিবর্ষণই হচ্ছে। একই ঘটনা সোনম কপূর, করিনা কপূর খানদের ক্ষেত্রেও। যে কারণে ট্রোলিংয়ের বিষয়টি ভাবাচ্ছে টুইটার কর্তৃপক্ষকে। জনপ্রিয় গণমাধ্যম এখন হিংসা ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে, তাই প্রত্যেক দিন হাজার হাজার অ্যাকাউন্ট বাতিল করতে হচ্ছে টুইটারকে।
সুশান্তের মৃত্যুর জন্য সিবিআই তদন্তের দাবি তোলা জনতা, সেই তদন্তের ফল প্রকাশের আগেই দোষী সাব্যস্ত করে দিচ্ছেন রিয়া চক্রবর্তীকে। এটা কি বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা নয়? টলিউডের প্রযোজক এবং পেশায় আইনজীবী অতনু রায়চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে পর্যন্ত তাঁকে নির্দোষ ধরা হয়। সুশান্তের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত করছে, সেই তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কাউকে দোষী বলে দেওয়াটা অন্যায়। এতে যেমন তদন্তে প্রভাব পড়ে, তেমনই সিস্টেমের উপরে অনাস্থা প্রকাশ পায়।’’ মিডিয়া ট্রায়ালের নামে এই প্রহসন বন্ধের অপেক্ষায় পরিচালক অরিন্দম শীল। তাঁর মতে, ‘‘এই নেগেটিভিটি কোথাও গিয়ে সকলের ক্ষতি করছে।’’
প্রত্যেক দিন ট্রোলড হচ্ছেন রিয়া। ‘ডাইনি’, ‘কালাজাদু’র মতো শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে তাঁর উদ্দেশে। রিয়ার সমর্থনে কেউ এগিয়ে এলে তাঁকেও ট্রোল করা হচ্ছে। কিছু দিন আগে স্বরা ভাস্কর ও তাপসী পান্নু বলেছিলেন, রিয়াকে ট্রোল করাটা অন্যায়, কারণ এখনও সত্যি প্রকাশিত নয়। তাতে ট্রোলড হয়েছেন তাঁরা। সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল প্রসঙ্গে বিদ্যা বালন বলছেন, ‘‘বিচারব্যবস্থার উপরে সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। কিন্তু রিয়াকে এ ভাবে অপদস্থ করাটা অযৌক্তিক।’’
সোশ্যাল মিডিয়া ট্রোলিং অনেকের কাছে ‘বিপ্লব’-এর সমার্থক। যে ব্যক্তি কোনও সেলেব্রিটিকে ট্রোল করছে, সে-ই হয়তো তারকাদের ফ্যাশন, ফিটনেসের সাম্প্রতিক ট্রেন্ডও ফলো করে! আসলে মুদ্রার সব সময়েই দুটো পিঠ থাকে।