রুদ্রনীল এই ফিল্মে একেবারেই অন্য রকম। —ফাইল চিত্র।
পরিচালক: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষ, সোহিনী সরকার, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋদ্ধি সেন, সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
উবারমেন্শ। শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন ফ্রিডরিখ নীৎশে (‘Thus Spake Zarathustra’)। তিনিই ঘোষণা করেছিলেন ঈশ্বরের মৃত্যু। উবারমেন্শ বা সুপারম্যান, সুপারহিউম্যান আসলে নিচুতলার মানুষেরাই। কিন্তু ওপরতলার কতিপয় ব্যক্তি বাস্তবত ‘সুপারম্যান’ হয়ে ওঠে। নাৎসিরাও শব্দটা ব্যবহার করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে। এ ভাবেই শব্দটির অপব্যবহার হতে থাকে। ‘ভিঞ্চিদা’-র আদি বোস ‘উবারমেন্শ’-এর প্রসঙ্গ আনে। সে-ও জানায়, ঈশ্বর মৃত। ঠুঁটো জগন্নাথ। তাই উবারমেন্শ-রাই শায়েস্তা করবে কতিপয় ক্ষমতাধরদের। এ ভাবেই আদি বোস ঘোষণা করে তার লক্ষ্য।
গল্পের কথক ভিঞ্চিদা নিখুঁত প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট হয়েও বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সুযোগ পায় না। বিতাড়িত হতে হতে হয়ে পড়ে কোণঠাসা। পাড়ার নাটকের দল আর বিয়ের কনের মেকআপ করে সন্তুষ্ট হতে হয় তাকে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতি জমা হয় ক্ষোভ। স্বপ্ন দেখে ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো সে-ও আঁকবে মোনালিসা। প্রেমিকা জয়া (সোহিনী) তার মোনালিসার মডেল। ঠিক এ রকম এক অবস্থায় আদি বোস খুঁজে বের করে ভিঞ্চিদাকে। প্রস্তাব দেয় ফিল্মের জন্য প্রস্থেটিক মেকআপ করার। ভিঞ্চিদা খুশিতে ডগমগ। রাজি হতে দেরি হয় না তার। কিন্তু একি! একটা ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে সে। একটার পর একটা ‘ক্রাইম’ সংঘটিত হতে থাকে। শুধু শিল্পী হয়ে বেঁচে থাকা আর সম্ভব নয়। ফেরার পথ নেই। চুরমার হয় তার সত্তা।
সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ তো কিছু হবেই। আদি বোস জানায় তাকে। ড্যামেজ হয় ভিঞ্চিদার। আদি বোসের শিকার হয় জয়া, তোতলা জয়া।
আরও পড়ুন: আগে করেননি, এ বার এই কাজটাই করবেন করিনা!
প্রথমেই দর্শককে বড়শি-বিদ্ধ করেন পরিচালক এক নিস্পৃহ খুনের দৃশ্য দিয়ে। প্রথম শটে দেখা যায় ছোট আদি বোস-এর (ঋদ্ধি) মুখ ঢাকা একটা বই। মগ্ন হয়ে পড়ছে সে ‘ল অব ক্রাইমস’। তার পিছনে সাঁটা ‘সেভেন’ ফিল্মের পোস্টার। সিরিয়াল কিলার যে ফিল্মের মুখ্য চরিত্র। ক্যামেরা এগিয়ে যায় তার মুখের দিকে। বাবার চ্যাঁচামেচির শব্দ আছড়ে পড়ছে তার কানে। বাবা মারছে মাকে। ক্যামেরা স্থির ধরে রাখে এই দৃশ্য। যত ক্ষণ না বাবাকে খুন করে আদি, নড়ে না ক্যামেরা।
রুদ্রনীল-সোহিনীর প্রেমের এক দৃশ্য। পোড়ো এক বাড়ির অন্দরে দু’জনে কথা বলে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করে, ক্যামেরা এগিয়ে যায় তাদের দিকে, আর এই দৃশ্যের শেষে তারা যখন ঘনিষ্ঠ ক্যামেরা পিছিয়ে আসে, দূরে চলে যেতে থেকে তারা— কী সুন্দর এক্সপ্রেশন সোহিনীর, লজ্জায়-বিভায় জ্বলজ্বল করে সে!
যখন প্রথম ভিঞ্চিদা জানতে পারে তার প্রস্থেটিক মেকআপ ব্যবহার করে আদি বোস কী কাণ্ড ঘটিয়েছে, দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। উপস্থিত হয় আদি বোস। বোঝানোর চেষ্টা করে তাকে। ভিঞ্চিদা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নেপথ্যে হেঁকে যায় পঁচিশ টাকায় জিনিসপত্র কেনার ফেরিওয়ালা, যেন ভিঞ্চিদাকেও কিনে নিয়েছে কেউ, অনেক অর্থের বিনিময়ে যার মূল্য ওই পঁচিশ টাকাই, হয়তো বা তারও কম।
অনির্বাণ, ঋত্বিক, ঋদ্ধি, সোহিনীর দক্ষতা অতুলনীয়।
অনির্বাণের পান চিবোতে চিবোতে অভিনয় না-করা অভিব্যক্তি মনে থাকবে। ঋত্বিকের মুখের পেশিগুলো নড়াচড়া করে শরীরী ভাষার যে বিভঙ্গ তৈরি করে তা ভুলে যাওয়ার নয়।
অনির্বাণ, ঋত্বিক, ঋদ্ধি, সোহিনীর দক্ষতা অতুলনীয়। কিন্তু রুদ্রনীল এই ফিল্মে একেবারেই অন্য রকম। অভিনয়, ডায়ালগ, ডেলিভারি ইত্যাদিতে অসাধারণ। রুদ্রনীলের চরিত্রটি শোনা যাচ্ছে এই ফিল্মের মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুর জীবনের ছায়ায় রচিত। এই ফিল্মের মেকআপ দেখে অনেক দিন তাঁকে মনে রাখবেন দর্শক।
একটা দৃশ্যে যখন শেষতম খুন করতে অস্বীকার করছে ভিঞ্চিদা আর আদি বোস বোঝানোর চেষ্টা করছে, সেখানে কী করে একই দিকে দু’জনের লুক হয়? পরস্পর মুখোমুখি। আদি বোস ফ্রেমের বাঁ দিকে তাকালে ভিঞ্চিদা লুক দেবে ডান দিকে। পরিচালকের সহকারী বা ডিওপি বা তাঁর সহকারীর চোখে পড়া উচিত ছিল।
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর আবহসঙ্গীত, অনুপম ও মইনুল আহসান নোবল-এর কণ্ঠ শুনতে বেশ। অনুপমের গান নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার আর দরকার পড়ে কি?
আরও পড়ুন: ছোট্ট একটা ভুল! তার জন্য ফের ভাইরাল প্রিয়া
যাই হোক, ইনস্পেক্টর পোদ্দার (অনির্বাণ) কি ধরতে পারেন আসল অপরাধীকে? আদি বোসের কী হয়? ভিঞ্চিদা কি পারে ফাঁদ কেটে বেরোতে? ভিঞ্চিদা ও জয়ার সম্পর্কের পরিণতিই বা কী দাঁড়ায়? একটা কথা বলতেই হবে, ‘বাইশে শ্রাবণ’ ও ‘চতুষ্কোণ’-এর পরে তাঁর এই তৃতীয় ক্রাইম থ্রিলারেও পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর নিজস্বতা বজায় রাখলেন।
ফাদার গাস্তঁ রোবেজ ‘নতুন সিনেমা’ খুঁজতে গিয়ে সিনেমায় ‘কালেক্টিভ ড্রিম’-এর কথা বলেছিলেন (Another Cinema for Another Society)। এ ফিল্মেও সাধারণ মানুষের যৌথ স্বপ্নের হদিশ পাবেন দর্শক।
(কোন সিনেমা বক্স অফিস মাত করল, কোন ছবি মুখ থুবড়ে পড়ল - বক্স অফিসের সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)