সামসারা ছবিতে ঋত্বিক, রাহুল, ইন্দ্রজিৎ।
অভিজিৎ গুহ ও সুদেষ্ণা রায় পরিচালিত ‘সামসারা’, একটা বৃত্তাকার পথের গল্প বলে, যার কেন্দ্রবিন্দু একটি নয়, তিনটি। তিন বন্ধুর কাহিনি, যাদের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে আবর্তিত, অথচ গল্পের শেষে এই তিনটি কক্ষপথই মিশে যায় একটি অদ্ভুত ত্রিবেণী সঙ্গমে।
অতনু, বিক্রম আর চন্দন। মহেন্দ্র দত্ত ইনস্টিটিউশনের ’৯৫ ব্যাচের তিন বন্ধু। ছাত্রজীবনের পরে তিন জনেই কর্মসূত্রে ছিটকে যায় তিন দিকে। অতনু পেশা হিসাবে বেছে নেয় লেখালেখি, বিক্রম এখন ফর্মাল পোশাকে কাজ করে নিজের কনস্ট্রাকশনের ব্যবসার অফিসে আর চন্দন সামলায় সোনার গয়নার তিনটি শো-রুম। বহু বছর পর তিন বন্ধুর যোগাযোগ হয় অতনুর উদ্যোগে এবং দেখা হওয়ার পর সে জানায় তার আসল উদ্দেশ্য! এখান থেকে তিনটি সমান্তরাল গল্প ধীরে ধীরে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে একটি জায়গায়।
গল্প কিছু এগোলে, তিন বন্ধু এসে পড়ে এক জনবিচ্ছিন্ন স্থানে— ‘সামসারা’। সামসারা-য় একে একে তিন জনেই তাদের অতীতের বেশ কিছু চরিত্রের সম্মুখীন হয়, যে চরিত্রগুলো থেকে তারা পালাতে চেয়েছে আজীবন, কিন্তু কোনও এক অপরাধবোধ তাদের পালাতে দেয়নি কখনও। এই চরিত্রদের দেখতে অবিকল অতীতের মানুষগুলোর মতোই, তারা একই গল্প বলে, একই ব্যর্থতা তাদের কুড়ে কুড়ে খায়, অথচ নামগুলো শুধু পাল্টে পাল্টে যায়। অতনু, বিক্রম, চন্দন— প্রত্যেকেই সেই বিচ্ছিন্ন সুতো ধরে অনেক দূর আসে, কিন্তু তার পর আর তল পায় না, দিশেহারা হয়ে যায়, অনেক অঙ্ক কষেও হিসাব মেলাতে পারে না। রহস্য যত ঘনীভূত হয়, একে একে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসে, অনেক গরমিল একটা স্পষ্ট হিসাবের অপেক্ষায় জমতে থাকে। আর এই প্রশ্নগুলো এগিয়ে নিয়ে যায় তিনটি কক্ষপথকে, একটা সাধারণ কেন্দ্রবিন্দুর দিকে।
সিনেমার প্রথমার্ধ বেশ কিছু অংশে কিঞ্চিত শ্লথ। গল্পের গতি কখনও কখনও অপ্রয়োজনীয় ভাবে ধীর, যার ফলে মনে হয়েছে ছবির দৈর্ঘ্য বেশ খানিকটা কমতে পারত। তবে আবহসঙ্গীত পরতে পরতে উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ ধরে রাখতে পেরেছে। বিরতির পরে গল্পের গতি অনেকটা বাড়ে। প্রথমার্ধে মূলত চরিত্রগুলোর সঙ্গে দর্শক পরিচিত হয়, দ্বিতীয়ার্ধেই রহস্যের পারদ চড়ে এবং ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয়। সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও মেলে এক এক করে।
উপন্যাস শেষ করতে অক্ষম লেখকের ভূমিকায় ঋত্বিক অনবদ্য। ব্যর্থ কেরিয়ারের অবসাদে ডুবে যাওয়া অতনুর প্রতিটি অসহিষ্ণু দীর্ঘশ্বাস ও জীবনের প্রতি এক চরম ক্লান্তি, ঋত্বিক ধরেছেন অসামান্য ভাবে। মাদকাসক্ত সোনার ব্যবসায়ী চন্দনের ভূমিকায় রাহুলের অভিনয় মনে রাখার মতো। বিক্রমের ভূমিকায় ইন্দ্রজিৎ আর একটু সাবলীল হতে পারতেন। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে সুদীপ্তা, চন্দনের পিসতুতো দিদির ভূমিকায়, অত্যন্ত অল্প স্ক্রিন প্রেজেন্সের মধ্যেও ছাপ ফেলে গেছেন এবং বেশ কিছু দৃশ্যে কেবল তাঁর উপস্থিতি এক অনন্য রহস্যময়তা তৈরি করেছে। বাকি পার্শ্ব অভিনেতাদের মধ্যে সমদর্শীর অভিনয় উল্লেখ্য, দেবলীনা কুমারের অভিনয় যথাযথ এবং গোয়েন্দা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় অম্বরীশ বেশ ভাল।
সামসারা ছবির একটি দৃশ্যে ঋত্বিক চক্রবর্তী।
‘সামসারা’ একটি সাইকোলজিকাল থ্রিলার। রহস্যের জট ছাড়ানোর মধ্যে দিয়ে এই সিনেমায় তিন বন্ধুর চরিত্রেরও একটি একটি করে জট ছাড়ে। অভিজিৎ গুহ-সুদেষ্ণা রায় এই পরিচালক জুটি বরাবরই মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের নানা সমস্যা, ওঠা-নামা ও পথচলার গল্প পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন সফল ভাবে। এই সিনেমাও তার ব্যতিক্রম নয়। নাগরিক জীবনে ক্লান্ত আধুনিক মানুষ, এই সমাজের জাঁতাকলে পিষে এক অন্য মানুষে বদলে যায়। এই অপ্রিয় রূপান্তরের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন, আর সেই বোঝা কী ভাবে তার ঘাড়ে চেপে বসে, সেই মনস্তাত্ত্বিক দিক ফুটে উঠেছে খুব সাবলীল ভাবে। ভয় মানুষকে কতটা গিলে খেতে পারে এবং ধীরে ধীরে মানুষ কী ভাবে সেই ভয়ের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে, তা এই ছবির একটা বড় বিষয়।
ছবিটিতে সমস্ত উপাদান থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও জায়গায় বাঁধুনির সামান্য অভাব রয়ে গিয়েছে। কিছু দৃশ্য রহস্যময় করতে গিয়ে অতিনাটকীয় হয়ে গিয়েছে। তবে কিছু দৃশ্যের চরিত্রায়ন বেশ সুন্দর, লং শটে মেঘালয়ের প্রকৃতি অপূর্ব লেগেছে। তার সঙ্গে একটি গ্রাম্য বালকের বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে যাওয়ার দু’টি দৃশ্য যেমন শ্রুতিমধুর, তেমনই দীর্ঘ সাসপেন্সের একঘেয়েমি থেকেও মুক্তি দেয়। সিনেমার একদম শেষে রয়েছে একটি মোক্ষম মোচড়, যার ফলে অনেক রং আরও স্পষ্ট হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: সঞ্জয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনও সমস্যা নেই: ঋতুপর্ণা