Jisshu Sengupta

সত্যি-মিথ্যের দোলাচলে কোনটা 'শিরোনাম'? প্রথম ছবিতেই নজর কাড়লেন পরিচালক

ছবিটি মিলানে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মমেকার অব ওয়ার্ল্ড সিনেমায় বেস্ট ফরেন ফিল্ম পুরস্কার সম্মানিত হয়েছে। লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল মোশন পিকচার্স অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছে।

Advertisement

অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৫৫
Share:

আনন্দীর ভূমিকায় স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়

কোন খবরটা সত্যি? যেটা দেখছি যেটা জানানো হচ্ছে সেটা, নাকি আসলে একদমই আলাদা কিছু যেটা ঘটেছে সেইটা? সবটাই তো আসলে কী ভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। ঠিক যেভাবে 'শিরোনাম' ছবিটির সব থেকে বড় দিক খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার বিষয়টি।

Advertisement

ছবিতে দুর্গম এলাকায় খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ফটো জার্নালিস্ট অভিন রায়ের (যিশু সেনগুপ্ত) নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিকে তারই নিউজ চ্যানেলের এগজিকিউটিভ এডিটর রজত (অঞ্জন দত্ত) যেভাবে অপহরণের মুখরোচক মোড়কে সাজিয়ে পরিবেশন করার নির্দেশ দেন এবং পাশাপাশি অন্যান্য নিউজ চ্যানেলগুলিও পাল্লা দিয়ে খবরটিকে আরও কাটাছেঁড়া করার লড়াইয়ে নেমে পড়ে, তাতে কিন্তু কোথাও মানবতাবোধ বা দায়িত্বশীলতার লেশমাত্র থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে মানুষের সেন্টিমেন্ট এবং সিমপ্যাথি আদায় করে ব্রেকিং নিউজের বাজারে নিজেদের দক্ষতা ও কার্যকরিতাকে লাইমলাইটে নিয়ে আসার নোংরা খেলা। যে প্রতিযোগিতার মাঝে চাপা পড়ে অভিনের স্ত্রী আনন্দীর (স্বস্তিকা মুখার্জী) আসল সত্যিটা জানতে চাওয়ার অধিকার। বিপর্যস্ত হয়ে যায় তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবন।

সংবাদমাধ্যমের দুটো কাজ। এক, খবর প্রকাশ করা আর দুই, খবর চেপে যাওয়া-- ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এগজিকিউটিভ এডিটর রজতের এই কথা দুটো শুধু যে সিনেমার গল্পকে চালিত করে তা নয়, কাকতালীয়ভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাকেও একটা নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

Advertisement

সাংবাদিকদের জীবনে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট এমনও হয় যেটা ঠিক যুদ্ধে যাওয়ার মতো না হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার মতো তো বটেই। ফোটো জার্নালিস্ট অভিন রায়কে তার সিনিয়র সহকর্মী সুজিত (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) চাপমুক্ত করতে গিয়ে এমনই কিছু কথা বলে। কারণ, সামান্য পরিমিতিবোধের অভাবে ঘটে যেতে পারে বড় কোনও অঘটন। তাই কথাগুলো হয়তো ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতি লাগাম দেওয়া, বুদ্ধি, সংযম, আবেগহীনভাবে পরিস্থিতি বিচার করার দিকেই নিশানা করে।

কিন্তু অভিনকে দেখে মনে হয়েছে সে একটু অন্য ধাতুতে গড়া। গল্পে এবং চিত্রনাট্যে সে বাকিদের থেকে একটু আলাদাই। সেটা বন্ধুমহল, হুল্লোড়, আড্ডা বা কর্মজীবন-- সবক্ষেত্রেই। তার কাব্যিক বোধ, শিল্পীমন, দুর্লভ ছবি তোলার প্যাশনই তাকে পৌঁছে দেয় বিপদের দোরগোড়ায়। ছবি ক্রমশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গল্প বলার মুন্সিয়ানায়। যার জন্য অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্প-নির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ পরিচালিত প্রথম ছবি 'শিরোনাম'-এর গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়ের।

ছবির শুরুতেই নিঝুম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিঁড়ে এগিয়ে আসা ট্রাকের আলো পুলিশি চেকিংয়ের মুখে থামার পর আসন্ন কোনও অপরাধ তথা নাটকীয়তার ইঙ্গিত দিয়েই গল্প অভিন এবং তার স্ত্রী আনন্দীকে ঘিরে এগতে থাকে। শুরু হয় প্রেক্ষাপট তৈরি, চরিত্র চিত্রণ, পারিপার্শ্বিকতা। গল্পে মূল ঘটনায় পৌঁছনোর মাইলস্টোন পেরতে পেরতে মুহূর্ত, মানু্‌ষ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে জীবনবোধের সংঘাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসে মানবিক বোধের সঙ্গে শিরোনাম হয়ে ওঠার অসঙ্গতি, স্ববিরোধ!

বিপর্যস্ত আনন্দীর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবন

একটি টিভি চ্যানেলে ক্যামেরাপার্সনের চাকরিতে সদ্য জয়েন করা অভিন তার পুরনো পরিচিত রজতদার শর্ত না মেনেই স্ত্রী আনন্দীকে জানিয়েছিল, তাকে যেতে হবে এক বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে। ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছে প্রত্যন্ত জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে থাকা ভয়ঙ্কর আতঙ্কবাদী রণছোড়জি। তিনি ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলতে চান। শুনে আতঙ্কিত আনন্দী বারণ করেছিল কাজটা করতে। কিন্তু অভিনের কাছে পিছিয়ে আসার আর কোনও পথ খোলা ছিল না। চ্যানেলের সিনিয়র জার্নালিস্ট সুজিতের সঙ্গে সেই মিলিটারি টহল দেওয়া আতঙ্কের গন্ধ ছড়ানো পরিবেশে পৌঁছে তারা আঁচ করতে পারে, সেখানে সাধারণ মানুষের জীবন কতটা বিপন্ন তা শহুরে মানুষের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। রণছোড়জির হয়ে কাজ করা একটি লোকের বাইকে চড়ে তারা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে জানতে পারে, ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে না। উনি মত বদলেছেন।

স্থানীয় হোটেলেই আবার ফিরে আসে সুজিত আর অভিন। একটা ক্ষীণ আশা। যদি হঠাৎ আবার রাজি হন। পরদিন ব্রেকফাস্টের পর অভিন অতি উৎসাহে একটা বহু পুরনো মন্দিরের খোঁজ পেয়ে ছবি তোলার নেশায় বেড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জায়গায় বাসে করে গিয়ে ভুল জায়গায় নেমে রাস্তা হারিয়ে ফেলে ও। নেটওয়ার্কের সমস্যায় যোগাযোগ করতে পারে না সুজিত। ক্রমশ দিনের আলো ফুরিয়ে রাত। আগাম বিপদের আশঙ্কায় বিধ্বস্ত সুজিত বুঝতে পারে, খুব বড় একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কিন্তু সে নিরুপায়!

চ্যানেলের সিনিয়র এডিটর রজত এই ঘটনাটাকেই অপহরণের রং দিয়ে খবর করে দেয়। সুজিতের যুক্তিসঙ্গত আপত্তি, আনন্দীর মানসিক অবস্থা কী হতে পারে ইত্যাদির থেকেও বেশি বড় হয়ে দাঁড়ায় খবরের শিরোনাম। পাবলিক সেন্টিমেন্ট, সিমপ্যাথি দিয়ে ব্রেকিং নিউজে টিআরপি-র বাজিমাত!

ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যান্য মিডিয়ার লোকজন। সক্রিয় হয়ে ওঠে তারাও আসল ঘটনা অনুসন্ধানের তাগিদে। শুরু হয় কাকপক্ষী জানারও আগে অপহরণের ভিতর অন্য কোনও খবরের উৎস খোঁজার কাজ। পরদিনই অন্য এক প্রতিদ্বন্দ্বী নিউজ চ্যানেল অভিনের নিখোঁজ হবার বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার করে। একটা সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিকে হাতিয়ার করে। উঠে আসে অভিনের এক যৌনপল্লীতে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু ঠিক কি ঘটেছিল?সত্যিটা কি? আদৌ কি অভিন এরকম কোথাও গিয়েছিল? তার নিখোঁজ হবার আড়ালে রহস্যটা নিয়ে কেউ আগ্রহী নয়। রাজি নয় আনন্দীর টালমাটাল মানসিক অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাতেও। একমাত্র সুজিত নিজের মনুষ্যত্ববোধকে অবহেলা করতে পারে না পেশাদার সাংবাদিকতার অজুহাতে। বিপর্যস্ত আনন্দীর জীবনের কঠিনতম সময়ে তার দৃঢ়তা প্রমাণ করে, সবাই নিজের মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে পারে না। একমাত্র সুজিত ছাড়া কেউ আনন্দীর স্বামীর মৃত্যুর হাহাকারে পাশে থাকে না। একমাত্র সুজিতেরই মন বলে অভিন যৌনপ্ললিতে রাত কাটানোর ছেলে নয়! অথচ পুলিশ অভিনের ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছে তাকে। সেখানে দেখা যায়, রেশমী (অঙ্কিতা চক্রবর্তী) নামের এক যৌনকর্মী রসেবশে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলছে।

সাংবাদিক অভিন রায়ের ভূমিকায় যিশু

এরকমই তো হয় বাস্তবে। টিভির দর্শক, সংবাদপত্রের পাঠক খবরের নাটকীয়তা আর নানা নতুন নতুন তথ্যে বিনোদন খুঁজে পায়। কিন্তু যাদের নিজের মানুষের বা কাছের মানুষের এরকম হয়, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইটা কত মর্মান্তিক হয়ে ওঠে আমরা কেউই ভেবে দেখার সময় পাই না!

কিন্তু এক্ষেত্রে দর্শক হিসেবে কোথাও একটা আনন্দী-অভিন-সুজিতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেই হয়। ওদের যেন নিজের মানুষই মনে হয়। ছবির সার্থকতা এখানেই। আনন্দীকে অনুভব করার জন্য, আমাদের মনের মধ্যেও যে কোথাও একটা অভিন বা সুজিত হয়ে ওঠার ইচ্ছে জাগে, সেটা বোঝার জন্য দেখতেই হবে 'শিরোনাম'।

কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, কেন এত প্রশ্ন, কেন একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কর্পোরেট ইগোর লড়াই! আনন্দীর দম আটকে আসা কান্নাটা যেন দলা পাকিয়ে থাকে গলার কাছে ছবির শেষ পর্ষন্ত। তার পরেই বিস্ফোরণ!

ছবিতে চমৎকার ভাবেই ফিরে ফিরে এসেছে রিয়্যাল টাইম এবং ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য। কাহিনির টানটান উত্তেজনার গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে মানবিক অনুভূতির নানা দিক– ভালোবাসা, স্বার্থপরতা, কাম, ক্রোধ, উদাসীনতা, অসহায়তা আর চিরকাল কিছু না পাওয়ার দাবীতে হিংস্র হয়ে ওঠা একশ্রেণিরর মানুষের কথা।

লকডাউনের বনবাসে মানুষের জীবনে একমাত্র শিরোনাম হয়ে উঠেছিল করোনা ভাইরাস! আনলক প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিতে সিনেমা হলগুলি আবার জেগে ওঠার খবরের মধ্যেই যে সব বাংলা ছবি রিলিজ হতে চলেছে, তার মধ্যে অন্যতম কৌস্তুভ রায় নিবেদিত আর পি টেকভিশন প্রাইভেট লিমিটেড প্রযোজিত এই ছবি এরই মধ্যে নিজের উৎকর্ষ প্রমাণ করেছে একঝাঁক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়ে।

আরও পড়ুন: বলি নায়িকার সঙ্গে প্রেম, অন্য নায়িকাকে বিয়ে, ‘ভীষ্ম’ হতে চাননি রাজপরিবারের সদস্য অভিনতা

ছবিটি মিলানে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মমেকার অব ওয়ার্ল্ড সিনেমায় বেস্ট ফরেন ফিল্ম পুরস্কার সম্মানিত হয়েছে। লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল মোশন পিকচার্স অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছে। হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছে। দশম দাদা সাহেব ফালকে-তে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডেও সম্মানিত হয়েছে। এবার আরও এক নতুন পালক। মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিদেশি ছবির বিভাগে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলেন অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতে নিঃসন্দেহে অভিনয় দক্ষতার নিখুঁত পরিমিতিবোধে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি।

এছাড়া যিশু সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, দু'জনের অভিনয়ই অনবদ্য। অসম্ভব বাস্তবসম্মত ও যথাযথ। সিউডো আর্বান দাম্ভিক মানুষের চরিত্রে যথারীতি প্রত্যাশা পূরণ করেছে অঞ্জন দত্তর অভিনয়ও। আলাদা করে চোখে পড়ে অঙ্কিতা চক্রবর্তী, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, সোমা চক্রবর্তীদের মেদহীন অভিনয়। ছোট পরিসরেও নিজেদের দারুণ ভাবে মেলে ধরেছেন সুজন মুখোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার, দেবরঞ্জন নাগ, কাঞ্চনা মৈত্র, কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি।

'শিরোনাম' ছবির সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায়। এডিটর সঞ্জীব দত্ত। সঙ্গীত রাজানারায়ণ দেবের।

আরও পড়ুন: ‘পুরো খবর না পড়ে মানুষ যা ইচ্ছে তাই লিখছেন’ নেটাগরিকদের পাল্টা আক্রমণে ক্ষোভ প্রকাশ অন্বেষার

প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের ভাই ইন্দ্রনীল ঘোষ এর আগে শিল্প নির্দেশক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন 'চোখের বালি' ও 'নৌকাডুবি'-র জন্য। তাঁর পরিচালক হিসেবে প্রবেশও বাংলা ছবির দর্শকের সামনে ভরসা রাখছে, এ কথা বলাই যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement