ফেলুদাই আমাদের শার্লক হোমস, তিনিই আমাদের মার্লন ব্রান্ডো।
পুরনো সোনা যেমন চিরনতুন থাকে ফেলুদাও তেমন চিরতরুণ। তা’ তার বয়স পঞ্চাশ কিংবা একশো, যাই হোক না কেন। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র থেকে কনভেন্টের ছাত্রী, আলাদা আলাদা মহাবিশ্বকে ফেলুদা অনায়াস দক্ষতায় জুড়ে দিয়েছেন বার বার। তিনিই আমাদের শার্লক হোমস, তিনিই আমাদের মার্লন ব্রান্ডো। ১৯৬৫ থেকে শুরু হয়ে একের পর এক ফেলুদা কাহিনিতে বাঙালি যেন আবিষ্কার করেছে তার চিরন্তন বাঙালিয়ানার মধ্যে জেগে থাকা ব্রিটিশ শৃঙ্খলা এবং হিউমারকে। ফেলুদা তার চেহারায়, স্বভাবে বাঙালির অনেক ত্রুটি থেকে মুক্ত। সে শরীরচর্চা করে। সে অকারণ গসিপে জড়ায় না, সে লক্ষ্যে স্থির। আবার ফেলুদা একইসঙ্গে সেই পুরনো বাঙালিয়ানাকে ধরে রাখে যেখানে রিসার্চ শব্দটার মানে তিরিশ সেকেন্ডে জানা যায় না। তার জন্য সিধু জ্যাঠার মতো কাউকে প্রয়োজন।
ফেলুদার পাশাপাশি তোপসে এবং লালমোহনবাবুর উপস্থিতিতে সেই অকল্পনীয় ত্রিভূজ গড়ে ওঠে, যেখানে সব ক’টি বাহুই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একটি বাহু দু’টি বাহুর সমষ্টির থেকে বড়। জ্যামিতিতে যা হয় না, ফেলুদার কাহিনিতে তা-ই হয়। খুব আলতো ছোঁয়ায় একটা ঘরোয়া ম্যাজিকের মধ্যে দিয়ে সল্ভ হয়ে যায় রহস্যগুলো, যার পর আমরা বুঝতে পারি কাহিনিটা ঠিক এ ভাবে আর এ রকম করেই এগোতে পারত। ফেলুদা যেমন দু’মলাটের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে জনপ্রিয়, ফেলুদাকে নিয়ে তৈরি সিনেমাও তেমনই জনপ্রিয়। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ তো কাল্ট। সন্দীপ রায় যে সিনেমাগুলো করেছেন তার মধ্যেও অনেকগুলোই ভাল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
সৌমিত্র আর সব্যসাচীর মধ্যে তুলনা হয় না। যেমন তুলনা হয় না হিমালয় আর আল্পসের মধ্যে। সত্যজিৎ এবং সত্যজিৎকে নিয়ে নির্মিত ছবিরও কি তুলনা হয়? তবু যে প্রসঙ্গে এত কথার অবতারণা, সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়ের সেই এক ঘণ্টা বাহান্ন মিনিটের তথ্যচিত্র ‘ফেলুদা: ফিফটি ইয়ার্স অব রে’জ ডিটেকটিভ’ মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়, দেখতে দেখতে মুগ্ধ হতে হয়।
আরও পড়ুন: ভারতীয় দলের বিশ্বকাপ তারকা নাকি এই দক্ষিণী নায়িকার ‘ভাল বন্ধু’!
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে সব্যসাচী চক্রবর্তী কিংবা আবির, প্রথম তোপসে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে ‘মুকুল’-এর ভূমিকায় অভিনয় করেই চল্লিশ বছর ধরে খ্যাতির সিংহাসনে বসে থাকা কুশল চক্রবর্তীরাই নয়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী থেকে আশিস নন্দী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় থেকে হালফিলের স্মরণজিৎ চক্রবর্তীও ফেলুদাকে নিয়ে নিজেদের অনুভবের কথা জানিয়েছেন। ফেলুদার গল্পে আমরা যেমন বুঁদ হয়ে থাকতাম, ফেলুদার সিনেমাতে যেমন থেকেছি, সবটাই চমৎকার উঠে এসেছে এই তথ্যচিত্রে যা যে-কোনও সিনেমাকে কড়া টক্কর দিতে পারে। এই তথ্যচিত্র আসলে বাঙালির নস্টালজিয়া, সব অবক্ষয়ের মধ্যে ঋজুতাকে খোঁজার জার্নি।
ছবির পরিচালক সাগ্নিক তাঁর ইউনিটকে নিয়ে ভারতবর্ষ ও তার বাইরেও চষে বেরিয়েছেন। বারাণসী, জয়সলমির, কলকাতা, লন্ডন, এমনকি ফেলুদার মরাঠি এক ভক্তের সূত্রে মুম্বই বা পুণেও এসে গেছে এখানে। ফেলুদা কীসের দ্বারা অনুপ্রাণিত, আবার ফেলুদা কত জনকে অনুপ্রাণিত করেছে, সব গল্পই ধরা রয়েছে এই প্রায় দু’ঘণ্টার তথ্যচিত্রে।
কখনও কখনও মনে হতে পারে ছবিটা যেন খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করা। সেই খণ্ড খণ্ডকে একসূত্রে গেঁথেছে মীরের চমৎকার ধারাভাষ্য এবং অবশ্যই সত্যজিতের ছবির সহকারী রমেশ সেন যিনি বারাণসীর গলির পর গলিতে মগনলাল মেঘরাজের বাড়িটা খুঁজে ফেরেন। এই মগনলাল মেঘরাজ বনাম ফেলুদার মোড়কে, বাঙালিয়ানা বনাম অবাঙালিয়ানার তর্ক আজ যখন আরও ধারাল হয়ে উঠছে তখন কেমন যেন মনে হয়, দু’জন দাঁড়িয়ে থাকে দুই প্রান্তে যেখানে এক জন নম্র কিন্তু দৃঢ় ভাবে বলতে পারে, “আমি ঘুষ নিই না” আর এক জন পৃথিবীর সব কিছুকেই টাকার জোরে কিনে ফেলতে চায়। দুটো বিপরীত ভাবধারা যেন দু’জনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। হ্যাঁ, যে ফেলুদা ঘুষ নেয় না সে প্রয়োজনে ঘুষ দিয়ে থাকে, কিন্তু সেটা রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়োজনে। আর সেখানেই ফেলুদার নমনীয়তা।
আরও পড়ুন: বাঙালি পরিচালকের ছবিতে সুইম সুট বিতর্ক, আটের দশকের সুপারহিট বলি নায়িকা এখন কোথায়?
সিনেমার চিত্রনাট্য করার সময়, নিজের গল্পকেও একটু-আধটু পাল্টে নিতেন সত্যজিৎ। আমরাও সে রকম ফেলুদাকে আজকের প্রেক্ষিতে একটু পাল্টে নিয়ে দেখতে পারি। মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট ছাড়া জটিল সব রহস্য সমাধান করা লোকটা আজকের দিনে ‘মিসফিট’ না কি বাঙালির চিরকালীন ‘আইকন-তৃষ্ণা’-কে আজও সে তৃপ্ত করার ক্ষমতা রাখে? আর সেই ক্ষমতা থেকেই ফেলুদার গল্প কিংবা উপন্যাসে মেয়েদের উপস্থিতি না থাকলেও, ফেলুদার পাঠক হিসেবে কখনওই পিছিয়ে ছিল না মেয়েরা। এই ছবির ফেলুদা-ভক্ত মরাঠি মেয়েটিই তার মস্ত প্রমাণ। হয়তো সে-ও অনুভব করেছে যে গল্পে মেয়েদের না থাকাটা, মেয়েদের বাদ দেওয়ার জন্য নয়, আবেগের জটিলতা এড়ানোর জন্য।
ফেলুদার কোনও গল্পে কোনও বাড়তি শব্দ থাকে না। ঠিক সত্যজিতের সিনেমার মতো। এই ছবিটা দেখতে দেখতে কখনও কখনও মনে হয়, আর একটু সম্পাদনা হয়তো করা যেত। তাতে ছবির দৈর্ঘ্য একটু কম হয়ে, গতিটা আর একটু বাড়ত। কিন্তু তার পরই মনে হয়, ওই বাড়তি সংযোজনটুকু মহেন্দ্র সিংহ ধোনির লম্বা চুলের মতোই স্বাভাবিক। ‘ফেলুদা’র মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মানুসন্ধানের জার্নি একটু তো লম্বা হবেই।
সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায় তাঁর এই তথ্যচিত্রে শুধু ‘পঞ্চাশ বছর’-এর ফেলুদাকেই খুঁজে আনেননি, তিনি খুঁজে এনেছেন সেই বাঙালিয়ানা যা গরম ফুলকপির শিঙাড়া কিংবা নরমপাকের সন্দেশের মতোই ‘নিখাদ’ বাঙালি। ফেলুদা যেন একসঙ্গে এই দুটোই। তাঁর মেধা আর ক্ষিপ্রতার যুগলবন্দি আজ বড় দরকার বাঙালির। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যে লোকটা পাথুরে প্রমাণ খুঁজে ফিরত, মনে মনে বাঙালিরা যে আজও তাকেই খুঁজছে। সেই সমস্ত সন্ধানী সিনেমা হলে গিয়ে এই ছবিটা দেখে সদ্য হাফ-সেঞ্চুরি করা প্রদোষ মিত্রকে কুর্নিশ জানাবেন, আশা করব।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।