‘কবীর’-এর একটি দৃশ্য। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।
‘কবীর’ ছবির পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়কে আমরা টেলিভিশন-শো তে দেখে থাকি। গুরুগম্ভীর বিষয়ের আলোচক অনিকেতের ছবির বিষয়েও যে সম-সময় উঠে আসবে, তা স্বাভাবিক। তাই আগের ‘বাই বাই ব্যাংকক’ গোত্রের ছবির থেকে ‘কবীর’ অনেকটাই আলাদা। আপাত ভাবে দেখলে, এ ছবি ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী ছবি বলেই মনে হতে পারে। তবে এ ছবির আদত বার্তা আরও গভীরে আবহমান, তা হল— সমস্ত ধর্মই আসলে শান্তি ও সহাবস্থান শেখায়।
এই সহাবস্থানের বার্তা সিনেমা ও সাহিত্যে নতুন নয়। তা হলে, এ ছবি কেন দেখবেন? উত্তর, না দেখলেও চলে। তবে যদি দেখতে যান, তা হলে সম-সময়ের ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির দাউদাউ মানচিত্র আড়ালে ভেসে উঠবেই। সেই সঙ্গে, না-বলা সত্ত্বেও ভেসে উঠবে নাজিব-আফরাজুল প্রমুখ ধর্মীয় হানাহানিতে মৃত নামগুলি।
এ ছবির গোটা ঘটনাই ঘটছে একটি ট্রেনের ভেতর। মুম্বই থেকে কলকাতার পথে আসা ওই ট্রেনে কবীর (দেব)-এর সঙ্গে দেখা হয় নায়িকা ইয়াসমিন খাতুন (রুক্মিণী মৈত্র)-এর। আদতে সন্ত্রাসবাদী ইয়াসমিন পরিচয় আত্মগোপন করে কবীরের কাছে। কবীরও প্রাথমিক ভাবে জানায় না, আদতে সে আইনরক্ষী। জানা যায়, সেও সন্ত্রাসবাদী। ঘটনার ঘনঘটা বাড়তে থাকে।
‘কবীর’-এর একটি দৃশ্যে দেব ও রুক্মিণী। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।
ক্রমশ প্রকাশ পায়, কলকাতায় আসন্ন সন্ত্রাস রুখতে গোটা ঘটনার ছক সাজিয়েছে কবীর। ইতিমধ্যে মুম্বইতে বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। তাই কবীর নিজেদের লোকদের দিয়ে ঘিরে ফেলছে ইয়াসমিনকে। এমনকী, তাঁর কলকাতার বাড়িতে ঘিরে রাখা হয়েছে প্রবীণ বাবাকেও। পাশাপাশি, লক্ষ্যে রাখা হয়েছে, দার্জিলিং-এর স্কুলে তাঁর সন্তান এবং বিদেশবাসী বরকে। এর পরের ছবিজোড়া টানাপড়েন ও ক্রমশ রহস্য উন্মোচনই এ ছবির বিষয়।
দেব আর রুক্মিণীর অভিনয় অসামান্য না হলেও মানানসই। স্ক্রিপ্টে বারবার রহস্য তৈরি এবং স্ক্রিনে বারবার ঝলসে ওঠা ক্যামেরা ও শব্দের ক্যারদানি বেশ ঝকঝকে করেছে ছবিকে। কিন্তু, সম্পাদনা ক্লিশে। এ ছবিতে বারবারই দেখা যায় বেশ কিছু তারকার মুখ। যথার্থ চরিত্রে তারকাদের নির্বাচন কবীরকে অন্যন্য করে। ছবির শুরুতে শুভাপ্রসন্ন, সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং স্বয়ং অনিকেত চট্টোপাধ্যায়য়ের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা নিঃসন্দেহে ছবিকে অন্য মেজাজে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে, বিশেষ চরিত্রে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে নির্বাচনও যথাযথ।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: জীবনের সব ভালবাসা নিংড়ে নিল অক্টোবরের ক্যানভাস
‘কবীর’ রিলিজের আগে থেকেই বড় বড় পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল শহর। তাতে সাদা-কালো মুখোশ পড়া কবীরের মুখ ঝলসে উঠছিল। আড়ালের অন্ধকার বলছিল, কালো সময়ের কিছু কথাই বলতে চান অনিকেত। বলতে চান, রাজনীতিকে না এড়িয়েই। তাঁর আগের ছবি ‘শঙ্কর মুদি’তেও সাধারণ মানুষের জীবনের কথাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। আজ যখন, বাঙালি ও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নানাবিধ রাজনীতি ও মৌলবাদের শিকার, যখন নিত্য মানুষ মারা যাচ্ছে ধর্মের নামে, চলছে লুঠতরাজ এমনকী শিশুহত্যা, এই মৃত্যু উপত্যকাকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি পরিচালক। বরং মুখোমুখি হয়েছেন সমস্যার। ট্রেনের দীর্ঘ আলাপচারিতায় দেব-রুক্মিণী আসলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের দুই আত্মা হয়ে ওঠেন তাই। বাংলা যে হানাহানিবিহীন উদারতার এলাকা, তা এ ছবি নানা ঘনঘটার মধ্যেও আর একবার মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, এ দেশ রবীন্দ্র-নজরুলের দেশ, লালন ও চৈতন্যের দেশ। এখানেই শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে এ ছবি। কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালকের।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: কনটেন্টের থেকেও ‘ব্ল্যাকমেল’-এর সম্পদ ক্রাফট
পরিশেষে বলব, আঙ্গিক বা আখ্যান সাধারণ হলেও, বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে এমন একটি বিষয় নিয়ে এগোনোর জন্য এ ছবি দেখা উচিত। কারণ, বিষয় আজ ফের ধর্ম। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, যে সম্পর্কের সম্মেলন চেয়েছিলেন কবীর।