মাস কয়েক আগে অভিনেতা অভিষেক বসুর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ফের শিরোনামে এসেছেন ‘মিঠাই’-এর জনপ্রিয় ‘শ্রীতমা’।
ছ'বছর বয়স থেকে ধারাবাহিক এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু দিয়া মুখোপাধ্যায়ের। মাত্র ২২ বছর বয়সেই রুপোলি জগতের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে পরিচিত তিনি। মাস কয়েক আগে অভিনেতা অভিষেক বসুর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ফের শিরোনামে এসেছেন ‘মিঠাই’-এর জনপ্রিয় ‘শ্রীতমা’। পর্দায় নিজের চরিত্রগুলির থেকে কতটা আলাদা দিয়া? আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে নিজের জীবন এবং দর্শনের খুঁটিনাটি নিয়ে আড্ডা মারলেন তিনি।
প্রশ্ন: ‘মিঠাই’-এর নায়িকা সৌমিতৃষা কুন্ডু এবং নায়ক আদৃত রায়ের খুব বেশি ছবি দেখা যায় না। বরং আপনার আর আদৃতের ছবি অনেক বেশি দেখা যায়, কেমন সম্পর্ক নায়কের সঙ্গে?
দিয়া: দাদাভাই এবং আমার মধ্যে অনেক মিল...
প্রশ্ন: দাদাভাই’?
দিয়া: (হেসে) আদৃতকে আমি ‘দাদাভাই’ বলেই ডাকি। পর্দাতেও, বাস্তবেও। কারণ আমাদের সম্পর্কটা খানিক ও রকমই। শ্যুটে ফাঁক পেলে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা মারি। কখনও দাদাভাই গান করে, কখনও বা সিনেমা নিয়ে কথা বলি, কখনও বা এমনই আড্ডা দিই। ‘মিঠাই’-এর কয়েক জন আমরা বিশেষ বন্ধু। তারা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটাই। কয়েক দিন আগে কাজে বিরতি পেতেই দাদাভাই তার নতুন গাড়িতে করে আমাদের কয়েক জনকে ড্রাইভে নিয়ে গেল।
প্রশ্ন: আপনিও তো গাড়ি চালাতে পারেন। কবে শিখেছেন?
দিয়া: খুব বেশি দিন নয়। এক বছর হল। গত বছর লকডাউনের আগে শিখেছিলাম। কিন্তু তার পরে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাইসেন্স হাতে পাইনি। গত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে লাইসেন্স পেয়ে চালাতে শুরু করেছি। এখন নানা জায়গায় একা একাই চালিয়ে যাই। আমি খুবই সাবধানে চালাই, তাই বাবা-মাও চিন্তা করেন না।
প্রশ্ন: কখনও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন?
দিয়া: বড়সড় দুর্ঘটনার মুখে পড়িনি। তবে গাড়ি চালানো তো আসলে গোটাটাই রিফ্লেক্সের ব্যাপার, কখনও যে রিফ্লেক্স সরে যায়নি, তা নয়। কিন্তু আমি জোরে চালাই না বলেই বোধ হয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। তবে গাড়ি চালানোর সময়ে বিশেষ একটি জিনিসে আমার মাথা গরম হয়, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোলেই দেখেছি, মানুষের চোখে অবিশ্বাস! মেয়েদের গাড়ি চালাতে দেখে সবাই যেন অবাক হয়ে যায়। চোখ মুখ দেখে মনে হয়, তাঁরা ভাবছেন, ‘মেয়েরা আবার গাড়ি চালাতে পারে নাকি?’ এই মনোভাবকে ভুল প্রমাণ করার জন্যই আমার গাড়ি চালানো শেখা। গাড়ি চালানোর সময়ে আরও সাবধানী হয়ে আমি প্রমাণ করতে চাই যে, মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশি ভাল চালায়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ধৈর্য অনেক বেশি, যা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে খুব দরকার।
প্রশ্ন: প্রেম করাকালীন অভিষেক বসুর সঙ্গে কখনও লং ড্রাইভে গিয়েছেন?
দিয়া: হ্যাঁ দিঘা, মন্দারমণি গিয়েছি আমরা। তখনও আমি গাড়ি চালানো শিখিনি। ও-ই চালাত। যবে থেকে আমি শিখলাম, তার পর থেকে লকডাউন হয়ে গেল।
মহিলাদের গাড়ি চালানো নিয়ে মানুষের অবিশ্বাস দেখেই গাড়ি চালাতে শিখেছেন দিয়া।
প্রশ্ন: কত বছরের প্রেম ছিল অভিষেকের সঙ্গে? বিচ্ছেদের পর কী ভাবে নিজেকে সামলাচ্ছেন?
দিয়া: ‘সীমারেখা’-তে (২০১৭) অভিনয় করতাম আমরা। সেখান থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম, তার পর বিচ্ছেদ। আমার মনে হয়, সামলানোর কিছু নেই। যা হয় ভালর জন্যই হয়। কোথাও নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছিল বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি দু’জনে মিলে। তবে কয়েক মাস কেটে গিয়েছে এখন। অনেকটা সেরে উঠেছি। আমি আসলে খুবই আধ্যাত্মিক। যে কোনও ঘটনাকে মেনে নিতে পারি আমি। নিজেকে সে ভাবেই গড়ে তুলেছি।
প্রশ্ন: অভিষেকও তো আধ্যাত্মিক। দু’জনে দু’জনকে প্রভাবিত করেছেন, নাকি প্রেম করার আগেও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করতেন?
দিয়া: অভিষেক অনেক ছোট বয়স থেকেই খুব আধ্যাত্মিক। আমি অতটা না হলেও বাড়িতে সবসময়ে পুজো-আচ্চা দেখেছি। মনের মধ্যে উৎসাহ জন্মে গিয়েছিল। তার পরে অভিষেকের সঙ্গে প্রেম করার পর ওর কাছ থেকে জীবনদর্শন এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আরও অনেক কিছু জানতে পারলাম। বিচ্ছেদ থেকেও যেমন অনেক কিছু শিখেছি, প্রেম করেও অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
‘সীমারেখা’-তে (২০১৭) অভিনয় করতে গিয়ে আলাপ দিয়া-অভিষেকের
প্রশ্ন: উদয়প্রতাপ সিংহের (‘মিঠাই’ ধারাবাহিকে দিয়ার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেন) সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনা যায় টেলিপাড়ায়…
দিয়া: ‘তুমি এলে তাই’ ধারাবাহিকে কাজ করতাম আমি আর উদয়। সেই থেকে আমরা বন্ধু। উদয় খুব একটা ভাল বাংলা পড়তে পারত না। এখন অবশ্য পারে। কিন্তু বাংলা লেখা পড়তে গিয়ে এখনও হোঁচট খায়। সেই থেকে আমিই পড়ে পড়ে দিতাম। ও শুনে শুনে মুখস্ত করত। এখনও মাঝে মাঝে এটা হয়। একটা উদাহরণ দিই, ‘অভাব অনটন’ শব্দটাকে ও উচ্চারণ করত ‘অভাব টনাটন’ (বলেই হেসে উঠলেন দিয়া)। বাংলায় জন্মেছে, বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাংলা শেখেনি ছোটবেলায়। পোস্টার এবং হোর্ডিং পড়ে পড়ে এই ভাষা শিখেছে উদয়। তাই ওকে আর আমাকে নিয়ে এ সব গুজব শুনে মজাই লাগে। বহু দিন ধরেই শুনতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: তার মানে উদয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে আগেও গুজব রটেছে?
দিয়া: হ্যাঁ, মিঠাইয়ের শুরু থেকেই শুনছি। আমার সামনে এসে কেউ বলে না যদিও। এর-ওর মুখে শুনতে পাই। এক বার এমন কিছু শুনতে পেয়ে আমি সোজা ‘মিঠাই’-এর এগজিকিউটিভ প্রোডিউসারের কাছে চলে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘‘যিনি এই কথাটা বলেছেন, তাঁকে দয়া করে বলুন আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে উৎসাহ থাকলে যেন আমাকে এসে বলেন। এ ভাবে পিছনে বলে বেড়াতে নিষেধ করুন।’’ তার পর থেকে আর শুনিনি।
প্রশ্ন: অভিষেকের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কি আবার উদয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন রটানো হচ্ছে?
দিয়া: সেটা ঠিক জানি না। আমাদের বিচ্ছেদের আগেই আমি শুনেছিলাম। পরে অবশ্য কিছু শুনিনি। তবে এমনিতেই দেখেছি, কোনও দুটো মানুষের বিচ্ছেদের পর তৃতীয় ব্যক্তির নাম তুলে আনা হয়। মনে করা হয়, নিশ্চয়ই তৃতীয় কোনও ব্যক্তির কারণেই বিচ্ছেদ হয়েছে। এ সব বলে কী যে মজা পায়, জানি না। বিচ্ছেদের পরে কি কেউ সিঙ্গল থাকে না নাকি?
প্রশ্ন: ‘মিঠাই’ ধারাবাহিকে সব থেকে ভাল বন্ধু কে?
দিয়া: ঐন্দ্রিলা (শ্রীনিপার চরিত্রে অভিনয় করেন)। কেবল এই ধারাবাহিকে নয়, গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে এই মুহূর্তে ওর উপরেই সব থেকে বেশি ভরসা করি। আমার মন খারাপ থাকলে বা অস্থিরতা শুরু হলে ধ্যান করি। এ রকম বহু দিন হয়েছে, মেকআপ রুমে বসে ধ্যান করছি। আমি আর ঐন্দ্রিলা একটি ঘরে বসি। আমাকে ধ্যান করতে দেখলে এক ফোঁটা আওয়াজও করে না তখন ঐন্দ্রিলা। ফোন এলেও বাইরে গিয়ে কথা বলে।
দিয়া এবং অভিষেক, দু’জনেই খুব আধ্যাত্মিক।
প্রশ্ন: আপনি খুব বেশি রিল ভিডিয়ো বানান না, কেন?
দিয়া: ভাল লাগে না। সমাজের কাছে বোধ হয় সেটা দোষের। কিন্তু আমার সময় নষ্ট মনে হয়। সেটে আমরা যারা এ সব পছন্দ করি না, তারা গঠনমূলক আলোচনা করে সময় কাটাই। যা থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তবে হ্যাঁ, ছবি আমি পোস্ট করি, কিন্তু নেটমাধ্যম বস্তুটি আমার কাছে গৌণ। প্রয়োজনে দু’একটি ছবি পোস্ট করা, নিজের ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগে থাকা এবং খুব সুন্দর মুহূর্তের কথা জানানো— এ ছাড়া আমার আর কোনও কাজে লাগে না।
প্রশ্ন: শুনেছি, কাজের জায়গা থেকেই রিল ভিডিয়ো বানানোর কথা বলা হয়...
দিয়া: আমাকে বলেছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমি এ সব পারি না। তার পর ওঁরাই দু’টি ভিডিয়ো বানিয়ে দিয়েছিলেন। পোস্ট করেছিলাম। অনেকেই মনে করেন, ইনস্টাগ্রামে অনুগামী সংখ্যা বেশি হলে কাজ পাওয়া যায়। আমার সঙ্গে কখনও এমন হয়নি। মনে করি, অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য অভিনয়ের দিকে মন দিলেই কাজে দেবে বেশি।
প্রশ্ন: ছ’বছর বয়স থেকে অভিনয় করছেন, কী ভাবে বিনোদন জগতে আসা?
দিয়া: আমার মা নাটক করতেন। বাড়িতে নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে এলে সেটা খুলে বসে যেতাম। বাংলার পুরো বাক্য পড়তে পারতাম না তখন। বানান করে করে বলতাম। আমার উৎসাহ দেখে বাবা-মা ‘আকাশ বাংলা’-তে আমার একটি ছবি জমা দেন। কয়েক মাস বাদে সেখান থেকে ফোন আসে। ব্যস, সেই থেকে টেলিভিশনে যাত্রা শুরু।
উদয়ের সঙ্গে দিয়ার সম্পর্ক কেমন?
প্রশ্ন: তখনকার কোনও স্মৃতি?
দিয়া: বেশ কিছু সুন্দর দিনের কথা মনে আছে আমার। এক মাসের ছোট ছোট গল্প দেখানো হত তখন। একটি চিত্রনাট্যে আমার মায়ের চরিত্রের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমি তখন মৃত্যু কী, সেটা বুঝতে পারতাম না। কাকে বলে ‘চলে যাওয়া’... ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল আমার। সাজঘরে বসে মা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘ধরে নে আমাকে কুমিরে টেনে নিয়ে গেছে। আমি আর ফিরব না।’’ সেই কথাটা ভেবেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। সারা দিন ধরে আমাকে কাঁদিয়েছিল মা। তার পরে একটি শটেই সেই অভিনয়টা করি আমি। হাততালি পড়েছিল।
প্রশ্ন: কেবল ধারাবাহিক? নাকি কোনও ছবিতেও অভিনয় করেছেন?
দিয়া: ছোটবেলায় বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। রেমো ডি’সুজা পরিচালিত ‘লাল পাহাড়ির কথা’-তে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করেছিলাম। পুরুলিয়ায় যেতে হয়েছিল আমাকে। দিদার সঙ্গে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দিদা মা-বাবাকে বলেছিলেন, ‘‘মিঠুন চক্রবর্তীর মতো সুপারস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তোর মেয়ে, তার কোনও তাপ-উত্তাপই নেই!’’ (হেসে উঠলেন দিয়া) তখন সেটা বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়নি আমার। মনে হত, মিঠুন চক্রবর্তীও অভিনয় করেন, আমিও করি। মিঠুন জেঠুও খুব মিষ্টি ব্যবহার করতেন আমার সঙ্গে। খুব সহজে মিশতেন। মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতেন মিঠুন জেঠু। এখন মনে হয়, কাদের কাদের সঙ্গে তখন এই খেলাগুলো খেলতাম!
প্রশ্ন: ২২ বছর বয়সেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, ধারাবাহিকে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, কিন্তু এখন ‘মিঠাই’-তে নায়িকা না হতে পারায় আফসোস হয়?
দিয়া: ধারাবাহিকে বার বার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ঘোরে। গল্প যখন আমার আর উদয়প্রতাপের (সিংহ) দিকে, তখন আমরাই গুরুত্ব পাই। আলাদা করে নায়িকা না হলেও আমার কোনও অসুবিধা নেই।