গত বছর মার্চ মাসে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে জীবনের অন্যতম পরম সুহৃদ শ্রীমান আলু, যাকে বাজারে জ্যোতি-চন্দ্রমুখী এমন নানা নামে রোলকল করা হয়। হাজারবার নাম ডাকা সত্ত্বেও যে কিছুতেই আর আমার পাতে এসে ইয়েস স্যার বলে না! রক্তে চিনির দোষ থাকতে পারে, আলুর তাই প্রবেশ নিষেধ সেই মার্চ মাস থেকেই। আমার কাছে সে এক কালা দিন, শোক দিবসও বলতে পারেন!
বিরিয়ানির ডুমো ডুমো আলু। রোববার সকালবেলা লুচির সঙ্গে আলুভাজা কী আলুর দম, দুপুরের রেওয়াজি খাসির ঝোলে ধোঁয়া ওঠা নরম আলু...হায়, কোনওদিন কী আর দেখা পাব না তাদের? জানি, আলুর জন্য লেখা এই ফেয়ারওয়েল স্পিচ আমি একা লিখছি না। চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি, চোখে জল আর জিভে লোভ নিয়ে আরও অসংখ্য আলুথালু বাঙালি আমায় হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছেন!
বুকে হাত দিয়ে বলুন তো বর্ষার দুপুরে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা সাঁটাচ্ছেন অথচ খিচুড়িতে একটাও আলু নেই, কেমন লাগবে? অথবা সদ্য ফিরেছেন ট্যুর থেকে—পান্তা ভাত, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ সব মজুত আছে, শুধু আলু সেদ্ধটা হাওয়া! আমার তো কান্না পায়, যখন দেখি আমার জন্য কোনও স্প্যানিশ অমলেট তৈরি হয় আলুর প্রলেপ ছাড়়াই। কিংবা পরোটা পুর হিসেবে গুঁজে দেওয়া হয় নিরীহ পনির!
আলুহীন পৃথিবী তাই আমার কাছে আলোহীন বিয়েবাড়ি প্রায়। যে বিয়েতে বর আছে, কনে আছে, খাওয়া আছে, দাওয়া আছে— সানাইটাই নেই, নেই রোশনাইটাও। ‘‘আলু বিনা কেয়া জী না,’’ এরকমটাই বলেছিল আমাদের পা়ড়ার এক আলুকাবলি বিক্রেতা। আর এক অমর উক্তি করেছেন বিহারশ্রী লালুপ্রসাদ যাদব—যব তক সামোসামে রহেগা আলু, তব তক বিহার মে রহেগা লালু। আলুর সঙ্গে নিজের আয়ুকে জড়িয়ে নিতে এমন আর কজন পেরেছেন?
সবশেষে আবার বলি, আলুর গুণে আসক্ত এই অধম কিন্তু একা নয়। দুনিয়া জুড়ে আপামর আলু প্রেমিক এক হলে আজ একটাই স্লোগান তুলত:
আলুর দোষ নিপাত যাক!
আলুর সঙ্গে নিজের আয়ুকে জড়়িয়ে নিতে এমন আর কজন পেরেছেন…
আমার জীবনের পুরে আছে, জুড়ে আছে এই আলু। আলু ছাড়া এই উপমহাদেশের কোনও রেস্তোরাঁ চলবে না। এতটাই ইনডিসপেন্সেবল এই আনাজ। আর আলু দিয়ে রান্না, মেক –আপ করার চলও শেখার মতো। টানাটানির বাজারে পাতে মাংসের চেয়ে আলুর প্রেজেন্স স্বাভাবিকভাবেই বাজেট ঘাটতি মেটায় বাঙালির বাড়িতে। তা ছাড়া শুধু বাঙালিরাই বা কেন, মারাঠিদের পেটেন্ট মিল পাওভাজিকেও ভুললে চলবে না। দক্ষিণীদের মসলা দোসায় আলু নেই সেটা কি ভাবা যায়?
আলুকে অমর করে গেছেন, আরেক ভুবন বিখ্যাত আর্টিস্টও। ভদ্রলোকের নাম ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। তাঁর ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়লে জানা যাবে, সে কালের ফ্রান্সে আবসিনিয়েৎ মদের সঙ্গে আলুর যুগলবন্দি কীভাবে ভিনসেন্ট-এর জীবন সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। ভাই থিওকে লেখা চিঠিতে বারবার ফিরে এসেছে এই কম্বিনেশনের কথা।
মাটির তলায় জন্ম নিয়ে মাটির ওপরের জীবনকে এভাবে প্রভাবিত করা রীতিমতো আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটির সমান। আলুকে সে কারণে নিতান্ত ভেজিটেবল ভাবতে প্রবল আপত্তি আমার! ভেজ, নন-ভেজ ডায়েটে আলুর ভূমিকা আমার মতে অত্যন্ত বৈপ্লবিক!