বলিউডের জনপ্রিয় গায়ক মিকা সিংহের প্রকৃত নাম অমৃক সিংহ। বাড়িতে সবার কাছে অমৃক ছিলেন আদরের মিকা। পরে নিজের ম্যানেজারের পরামর্শে ডাক নামটাই বেছে নেন তিনি।
মিকার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে। তারপর বাবা কর্মসূত্রে বিহারের পটনায় চলে যান। মা-ও পরে পরে পটনায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই বড় হয়েছেন মিকারা।
পড়াশোনাতে কোনও দিনই মনোযোগী ছিলেন না মিকা। বরং ছোট থেকে গান-বাজনার প্রতি কৌতূহল ছিল তাঁর।
বাবা আসলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত ছিলেন। বাবার রেওয়াজেই ঘুম ভাঙত তাঁর। নিজের অজান্তে খুব ছোট থেকে তাই তাঁরও সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
মা-বাবা কোনওক্রমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি তাঁকে পার করাতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণির পর আর স্কুলমুখো হননি মিকা।
তিনি তখন তবলাবাদক। বাবা বিহারের পটনা সাহিব গুরুদ্বারে কীর্তন করতেন। তবলা বাজিয়ে বাবার সঙ্গে সঙ্গত করতেন তিনি।
শুধু মিকাই নন, মিকার আরও পাঁচ ভাইও বাবার সঙ্গে কীর্তন করতেন। মিকা ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে।
সেই কীর্তনিয়া দলের দুই খুদে পরবর্তীকালে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হয়েছেন। একজন মিকা আর অন্যজন তাঁরই দাদা দালের মেহেন্দি।
প্রথম প্রথম কীর্তনে তবলা বাজিয়ে ১০০ টাকা করে উপার্জন করতেন মিকা। পরে যখন দাদা দালের জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন আর নিজের গানের ব্যান্ড গড়ে তুললেন। গিটার শিখে সেই দলেও যোগ দিলেন মিকা।
দাদার ব্যান্ডে গিটার বাজিয়ে ১০০০ টাকা করে উপার্জন করতে শুরু করলেন। মিকারও গাইয়ে হওয়ার ইচ্ছা জাগে। সে ইচ্ছার কথা দাদাকে জানিয়েওছিলেন।
দাদা দালের জানতেন মিকার কণ্ঠস্বর নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার আদর্শ নয়। তা সত্ত্বেও ভাইকে নিরাশ করেননি তিনি। বরং বলিউডের অনেক নামজাদা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন।
সকলেই মিকাকে অডিশনের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মিকার কণ্ঠস্বর কারও পছন্দ হয়নি। ভাঙা হৃদয়ে মিকা ফের দাদার দ্বারস্থ হলেন। এ বার দাদা দালের তাঁকে নিজের ব্যান্ডে গান বাঁধার পরামর্শ দিলেন।
পরে নিজের স্বতন্ত্র ব্যান্ড চালু করেছিলেন মিকা। নিজের লেখা গানে নিজের বাঁধা সুরেই বিপুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রথম গান ‘সাওয়ান ম্যায় লাগ গ্যায়ি আগ’ দারুণ পায়।
পরবর্তী সাফল্য আসে ২০০১ সালে অ্যালবাম ‘গাব্রু’-র হাত ধরে। এরপর ‘ও সনম জানেমন’, ‘সামথিং সামথিং’-এর মতো একের পর এক হিট অ্যালবাম বার করছিলেন তিনি। মিকার ছোঁয়া পেয়ে সব গানই সুপারহিট হতে শুরু করে।
মিকা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন। প্রচুর শো-এ ডাক পাচ্ছিলেন। উপার্জনও করছিলেন প্রচুর। কিন্তু বলিউডে গানের ইচ্ছা তখনও তাঁর মনে রয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার বলিউড তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাই দ্বিতীয় বার সেই জায়গাতেই কাজ চাইতে খানিক দ্বিখায় ছিলেন তিনি।
নিজের এবং দাদার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে সে বার কাজও জুটিয়ে ফেলেছিলেন নিজের। বলিউডে তাঁর অভিষেক হয় ২০০৬ সালের ছবি ‘আপনা সপনা মানি মানি’-র ‘দিল ম্যায় বাজি গিটার’ দিয়ে। প্রথম গানই সুপারহিট।
খুব দ্রুত মিকা বলিউডের জনপ্রিয় গায়ক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার পাশাপাশি একের পর এক বিতর্কের দাগও লাগতে শুরু করে তাঁর গায়ে।
মিকার জন্মদিন ১০ জুন। নিজের এক জন্মদিনে তিনি ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত বন্ধুকে পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেন। সেই পার্টিতে গিয়েছিলেন রাখি সবন্তও।
ওই দিনই রাখিকে জোর করে চুমু খেয়ে শিরোনামে উঠে এসেছিলেন মিকা। রাখি তাঁর নামে পুলিশে ডায়েরিও করেছিলেন। রাখিকে চুম্বনের কারণ জানাতে গিয়ে মিকা তখন জানিয়েছিলেন, রাখি তাঁর মুখে কেক মাখিয়ে দিয়েছিলেন। মিকার সেটা পছন্দ ছিল না।
এই ঘটনা মিকার কেরিয়ারে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর পর কিছু দিনের জন্য মিকা দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও একটার পর একটা হিট গান বলিউডকে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
২০১১-তে মিকার নামের সঙ্গে ফের আরও এক বিতর্ক জুড়ে যায়। একটি রিকশার সঙ্গে তাঁর গাড়ির ধাক্কা লাগে। রিকশাচালক এবং আরোহী প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁরা দু’জনেই মিকার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
মিকার জনপ্রিয়তায় কোনও ভাবেই প্রভাব ফেলতে পারছিল না বিতর্ক। বলিউডের পাশাপাশি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও একাধিক সফল গান গেয়েছেন তিনি।
‘পাগলু’ এবং ‘পাগলু ২’-এর টাইটেল ট্রাক, ‘খোকাবাবু’-র ‘প্যায়ার কা ঝটকা’, এ ছাড়া ‘রংবাজ’, ‘খোকা ৪২০’, ‘হিরোগিরি’ এবং ২০১৮-র ছবি ‘হইচই আনলিমিটেড’-এও গান গেয়েছেন। কন্নড়, তেলুগু, ঊর্দু-তেও গান গেয়েছেন।
২০১৫ সালে ফের বিতর্ক দানা বাঁধে তাঁকে ঘিরে। লাইভ অনুষ্ঠান করার সময় এক দর্শককে মঞ্চে ডেকে এনে চড় মেরেছিলেন তিনি। মিকার মতে, ওই দর্শক নাকি মহিলাদের উত্যক্ত করছিলেন।
২০১৬ সালে এক ফ্যাশন ডিজাইনারকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে মিকার বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালেও ধর্ষণে অভিযুক্ত রামরহিমকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি।
এর ২ বছর পর ফের আরও একবার শিরোনামে আসেন তিনি। ১৭ বছরের এক ব্রাজিলিয়ান মডেলকে উত্যক্ত করার অভিযোগে দুবাই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। ওই মডেল এবং মিকা দু’জনেই তখন দুবাইয়ে ছিলেন।
গানের সাফল্য আর বিতর্ক দু’টোই সমান্তরাল ভাবে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন মিকা। তবে ২০১৯-এ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। সে সময় ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছিল পুলওয়ামার হামলার কারণে।
ওই বছরই মিকা পাকিস্তানের পারভেজ মুশারফের এক আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরই দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
এর পরই অল ইন্ডিয়া সিনে ওয়ার্কারস অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নিষিদ্ধ করে দেয়। অবশ্য ২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দু’টি ছবিতে গান করেছিলেন তিনি। কিন্তু দু’টির কোনওটাই সেই সাফল্য পায়নি।