হেমন্তের সঙ্গে লতার সখ্য বরাবরই অটুট থেকেছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
তিনি নেই। তবু তাঁর গান কানে গেলেই বাঙলির মনে আজও অকাল বসন্ত। প্রয়াত কিংবদন্তি সুরকার-শিল্পী সলিল চৌধুরী যাঁর গলা শুনে বলেছিলেন, ঈশ্বর গান গাইলে বোধহয় এ রকমই হত তাঁর গলা! সেই তিনি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আজ ১০১তম জন্মদিন। বাংলা গানের সমস্ত আঙিনায় অনায়াস বিহারের পাশাপাশি মুম্বইও বশ মেনেছিল তাঁর সুরের জাদুতে। কেমন ছিল হেমন্তের তখনকার বম্বে সফর?
বাংলা গানের দুনিয়ায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন টাটকা বসন্ত। গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান শেখানোর পাশাপাশি গান গাইছেন, একটি-দু’টি করে বাংলা ছবিতেও সুর করার ডাক পাচ্ছেন। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা উৎসবে নানা জায়গায় তাঁর গান শোনা যাচ্ছে। সেই সময় রেডিওতে হেমন্তের গাওয়া ‘দেশ হামারা হিন্দুস্থান, সব সে সুন্দর হিন্দুস্থান’ প্রায় রোজই শোনা যেত। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে উঠে এসেছেন টালিগঞ্জের আজাদগড়ের বাগানওয়ালা নিজের এক তলা বাড়িতে। এই সময়েই তিনি ডাক পান বম্বে থেকে। ডেকে নেন পরিচালক হেমেন গুপ্ত। ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োয় ‘আনন্দমঠ’ ছবির পরিচালক তিনি। খুব ইচ্ছে, সেই ছবিতে হেমন্ত সুর দেন।
প্রস্তাব যে খুবই লোভনীয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা ছেড়ে যেতে একটুও মন চাইছিল না ধুতি-শার্টে চূড়ান্ত বাঙালি এই সুরকার-শিল্পীর। তার পর? জেনে নিন তাঁর জবানিতে:
‘‘হেমেনদাকে বললাম, যাব, তবে একটা ছবির কাজ যে কিছুটা বাকি রয়ে গেল। অজয় করের ‘জিঘাংসা’ ছবির মিউজিক দিচ্ছি। গানগুলো হয়ে গেছে। বাকি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। হেমেনদা বললেন, ছবি তো এখনও শেষ হয়নি। ছবি শেষ হোক, তখন এক ফাঁকে এসে ব্যাকগ্রাউন্ড করে দিয়ে যেও। এখন চল।
১৯৫১ সালের মার্চে চলে গেলাম বম্বে। তুলারাম জ্বালানের ফিল্মিস্থান দেখলাম। জালান নামেই মালিক। ফিল্মিস্থানের আসল জ্বালানি শশধর মুখোপাধ্যায়। তিনিই সর্বময় কর্তা। ভীষণ ব্যক্তিত্ব। ওঁকে দেখলে কুঁকড়ে যায় সবাই। সেখানেও ব্যতিক্রম আমি। ওঁরা কাজে ডেকেছেন। হলে হবে। না হলে ফিরে যাব। আর আমার তো তখন কলকাতার বাজার বেশ ভালোই।
আরও পড়ুন: স্বজনপোষণ, গুন্ডাগিরি বলিউডে জলভাত, ক’জন সুশান্তকে বাঁচাবেন? কোয়েনা
শশধর মুখোপাধ্যায় বললেন, তুমি তো ভাড়াখাটা মিউজিক ডিরেক্টর। ফুরনের কাজ করে এসেছ। ফিল্মিস্থানের নিয়ম কিন্তু একটু অন্যরকম। আমরা বাঁধা লোক রাখি। বাঁধা মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করবে। তার জন্য মাসে মাসে মাইনে পাবে। হাজিরাও দিতে হবে আপিসের মতো। এগারোটা থেকে পাঁচটা। তারপর ছুটি।
চাকরি তো এর আগে কখনও করিনি। তাই একটু নতুন নতুন ঠেকল। তবু ভাবলাম, হোক একটা নতুন অভিজ্ঞতা। দেখাই যাক না কেমন লাগে। অতএব রাজি হয়ে গেলাম শশধর মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে।
বম্বেতে কাজ শুরু করলাম। আপিসের মতো রোজই স্টুডিওতে যাই। বসে বসে গানের সুর করি। ছুটির পর একা একা ভালো লাগে না। কলকাতায় কত কাজ ছিল, আর এখানে শুধু ফিল্মিস্থানের চাকরি। এখানে বন্ধু বলতে তখন প্রদীপ বটব্যাল (প্রদীপ কুমার) আর মান্না লাডিয়া। এদের সঙ্গে বসে বসে আড্ডা দিই।
আরও পড়ুন: সুশান্তের আত্মহত্যার পিছনে পেশাগত রেষারেষি! তদন্ত হবে, জানালেন মন্ত্রী
যাই হোক, ‘আনন্দমঠ’ ছবির কাজ শুরু হল। ‘বন্দে মাতরম’ গানের সুর করতে হবে। গান কে গাইবে? লতাকে দিয়ে গাওয়াতে হবে। কথাটা বললাম শশধর মুখোপাধ্যায়কে। তিনি বললেন, লতা ফিল্মিস্থানে আসবে না। ও অনেক ব্যাপার। এদিকে সি রামচন্দ্রও ফিল্মিস্থান ছেড়ে দিয়েছেন। তুমি অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াও।
মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এ গান লতাকে দিয়ে না গাওয়াতে পারলে তো সব মাটি। একে আমি নতুন, তার ওপর লতা ছাড়া আর আর কাউকে দিয়ে গাওয়ালে কী দাঁড়াবে কে জানে! মনে মনে একটা প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম। প্ল্যান ঠিক করার পর আবার ধরলাম মি. মুখোপাধ্যায়কে। বললাম, আপনি বলছেন লতা আসবে না! কিন্তু আমি যদি ওকে আনতে পারি তাহলে আপনাদের কোনও আপত্তি আছে কি?
উনি শুনে বললেন, না, আমাদের তরফ থেকে কোনও আপত্তি নেই। বরং ও এলে ভালোই হয়। কিন্তু আমি তোমায় বলছি, ও আসবে না।
সব ব্যাপারেই আমি নিজে এগিয়ে গেছি। অতএব এ-ব্যাপারেও আমি কারোর সাহায্য ছাড়াই এগোলাম। একদিন গিয়ে দেখা করলাম লতার সঙ্গে।
তখন লতা ‘নানাচকে’ একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। সোজা চলে গেলাম লতার কাছে। খুব আদর-আপ্যায়ন করল। ছোট্ট এইটুকু একটা মেয়ে, কী অসাধারণ নাম করেছে! মুগ্ধ হলাম। আরও মুগ্ধ হলাম ওর ব্যবহারে। প্রথম আলাপেই খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম। তারপর আমার প্রস্তাব পেশ করলাম।
লতা শুনে বলল, যদিও ফিল্মিস্থানের সঙ্গে আমার ঝগড়া, আমি ওখানে গাইব না ঠিক করেছি, কিন্তু শুধু আপনার জন্যেই গাইব।
জিজ্ঞাসা করলাম কত টাকা বলব?
ও বলল, শুধু আপনার জন্যে গাইছি। পয়সার জন্যে নয়। সুতরাং ফিল্মিস্থানের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও কথা বলার দরকার নেই।
তারপর রিহার্সাল শুরু হল ‘বন্দে মাতরম’ গানের। লতা আমার বাড়িতে এসে রিহার্সাল দিল তিনদিন। যা ও সচরাচর করে না।
‘বন্দে মাতরম’ গানের যেদিন টেক সেদিন আবার আমার দুশ্চিন্তা শুরু হল। গান তো পছন্দ হয়েছে কিন্তু এবার মি. মুখোপাধ্যায়কে টেক পছন্দ করাতে পারলেই কাজ হাসিল।
এবার বাদ সাধলেন হেমেনদা। ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্ত। অতএব ওঁর মতামতই চূড়ান্ত। গান টেক হচ্ছে। খুব ভালো গাইছে লতা। খুব দরদ দিয়ে গাইছে। গেয়ে খুশিও হচ্ছে লতা। কিন্তু একটুও খুশি হচ্ছেন না হেমেনদা। প্রতিটি টেক হচ্ছে আর উনি বিরক্ত হয়ে বলছেন, প্রাণ পাচ্ছি না।
লতা নিজের গান নিজেই যাচাই করে ভালোমন্দ রায় দেয়। মিউজিক ডিরেক্টররা লতার গানের ব্যাপারে কোনও কথা বলেন না। ছবির পরিচালকরাও লতাকেই বিচারকের আসনে বসিয়ে ওর রায় শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকেন। আর সেই লতাকে কিনা নস্যাৎ করে দিচ্ছেন হেমেনদা! পর পর আটটা টেক হল, কিন্তু একটাও পছন্দ হল না পরিচালক হেমেন গুপ্তর।
আমি তো তখন অন্য আশঙ্কা করছি। এত সেধে লতাকে নিয়ে এলাম ফিল্মিস্থানে। হেমেনদার ব্যবহারে এখন যদি রেগেমেগে চলে যায়, তাহলে সব শ্রম পণ্ড।
লতা খুব বুদ্ধিমতী। আমার অবস্থাটা বুঝল। বলল, দাদা তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার গান টেক করে আমি যাব। যতক্ষণ না ওঁর পছন্দ হয় আমি গান করে যাব।
মনে আছে, সেদিন লতার গান পছন্দ করাতে কম করে কুড়ি, একুশটা টেক করতে হয়েছিল। আমার সুরে প্রথম রেকর্ড হল ফিল্মিস্থানে। আর লতার জীবনেও কুড়ি একুশটা টেক বোধহয় এই প্রথম!’’
ঋণ: আনন্দধারা (আত্মজীবনী)
লেখক: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: কে সি মজুমদার
নিউ বেঙ্গল প্রেস (প্রা) লিমিটেড