Entertainment News

আমরা যে সময় বেড়ে উঠেছি, তখন প্রেমটা এতটা শরীরী ছিল না

এত পরিবর্তনের জোয়ারেও কিন্তু কলকাতা কলকাতাতেই আছে। আমরা বদলে গেছি। তবে না বদলালে তো সময়ের সঙ্গে এগোতে পারব না।

Advertisement

কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (অভিনেত্রী)

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৭ ১২:১৮
Share:

আমার জন্ম ভবানীপুরের চিত্তরঞ্জনে। পড়াশোনা বেলতলা গার্লস হাইস্কুলে। কলকাতাকে চেনা শুরু করেছি খুব ছোটবেলায়। আমি খুব সেরিব্রাল। লোকে শুনলে হাসবে হয়তো। আমি বরাবরই স্বপ্নের জগতে থাকতাম। ওটাই একমাত্র পালিয়ে যাওয়ার জায়গা আমার জীবনে।

Advertisement

আমার বেড়ে ওঠা ভবানীপুরে। এখানে পঞ্জাবি, সর্দাররা বেশি থাকতেন। আমার মনে পড়ে, সাদার্ন নার্সারিতে পড়তাম। গলি পেরিয়ে যেতে হত। আমার পায়ের কালো জুতোটা খুব চকচক করত। আর আমি মায়ের হাত ধরে গটগট করে স্কুলে যেতাম। এই চলার পথটা মনে আছে। যেতে যেতে মায়ের দিকে তাকাতাম। মা ছিল খুব ছিপছিপে ফরসা, আর লম্বা একটা বিনুনি ঝুলত। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

ভাগ্যবশত আমার বাবা-মা দু’জনেই খুব বেড়াতে ভালবাসেন। সে কারণেই অনেক জায়গায় আমার ঘুরতে যাওয়া হয়েছে। ডানকুনিতে একটা বাগান বাড়ি ছিল। আমাদের ছোটবেলায় তো এত মল ছিল না। তখন কলকাতায় বেড়াতে যাওয়া মানে ছিল গড়ের মাঠ, বাবুঘাট। বাবুঘাটে একটা সিংহমুখওয়ালা স্ট্যাচু ছিল। প্রত্যেক গরমে আমাকে ওখানে ন্যাড়া করতে নিয়ে যেত। জানি না, এতে চুল কত ভাল হয়! আমি ছোটবেলায় হাঁ করে হাওয়া খেতাম। বেশ মনে আছে। তখন আমার সাড়ে তিন বছর বয়স হবে। আমার বর তো মজা করে আমায় বলে, আমি জাতিস্মর। সেই হাওয়া খাওয়ার অনুভূতিটা আমার এখনও মনে আছে।

Advertisement

আরও পড়ুন, 'সম্পর্ক নিয়ে সত্যি কথা বলে লাভ নেই'

এ ছাড়া আমাদের পুরনো বাড়ির ছাদের আলাদা একটা মজা ছিল। এখনও যখন মন কেমন করে, ওই চেনা গন্ধটা আমি পাই। তখন মনে হত, কবে বড় হব। এখন ভাবি ওই ছোট্টবেলাটায় আবার যদি ফেরত যেতে পারি! ঘাসফুলের সঙ্গে খেলা করতাম। চারমুখো ঘাসফুল দিয়ে অনেক কিছু বানাতাম। কলকাতার মাটি দিয়ে আমার কলকাতাকে চেনা শুরু। আমার বাড়ির সামনে একটা গ্যারাজ ছিল। সেখানে অনেক নাট-বোল্ট পড়ে থাকত, সেগুলো আমি কুড়িয়ে নিয়ে জমাতাম। আর ট্যাক্সি ড্রাইভার মানেই আমার কাছে ছিল বড় দাড়িওয়ালা সর্দারজি। আমি খুব মিষ্টি ছিলাম তখন। সবাই আমাকে খুব আদর করত। তখন তো খুব ছোট ছিলাম। সব কিছুই আমার কাছে খুব বড় বড় লাগত। মা-বাবা এমনকী দেওয়ালগুলোও সাইজে বড় মনে হত। ভিক্টোরিয়াও সাইজে বড়!

বাবা সকালবেলায় ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে নানান সাজে আমার ছবি তুলতেন। তখন সিংহটাও তো আমার থেকে সাইজে বেশ বড় ছিল। ওই সিংহটাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। আমাদের সময় ভিক্টোরিয়ার পরিটা মনে হয় ঘুরত। পরিটার দিকেও বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম, পরিটা কি রাতে আকাশে ওড়ে! মনের মধ্যে এ সব নিয়ে নির্ভেজাল প্রশ্ন উঠত। যার মধ্যে কোনও জটিলতা ছিল না। এখনও যখন চলার পথে পরিটাকে দেখি, ছোটবেলায় ফেরত নিয়ে যায় আমায়।

ভিক্টোরিয়ার সামনের রাস্তায় আমার ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়িতে চড়া হয়নি। কারণ আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের। কিন্তু বাবা-কাকা-মা-বোন—সবাই মিলে বাদামের ঠোঙা কিনে একসঙ্গে বাদাম খাওয়া, সেটার যে আনন্দ ছিল, মুম্বইয়ের জুহুতে গিয়েও আমি তা খুঁজে পাইনি। আমি আমার প্রিয় সোয়েটারটা পরে আছি আর চারিদিকে চেনা গন্ধ। কোনও বাদাম হয়তো ছাড়াতে পারছি না, বাবা ভেঙে আমাকে হাতে দিচ্ছেন। কাকা হাসছে। এই দৃশ্যগুলোর কথা ভাবনায় এলে আমি খুব শান্তি পাই।

উত্তর কলকাতার অলি-গলির মধ্য দিয়ে নাটকের স্কুলে যেতাম। ওই বয়সে শৈলেন ঘোষের সব লেখা পড়ে ফেললাম। অরুণ-বরুণ-কিরণবালা। আমি আসলে স্বপ্নের জগতে বিচরণ করতাম। এই চরিত্রগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম। কলকাতাকে এ ভাবেই চেনা শুরু।

ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর দিনগুলো বেশ আনন্দে কাটত। ওই চার দিন পড়তে বসতে হত না। তখন তো এত থিমপুজোর চল ছিল না। সাবেকি পুজো, ঢাকের আওয়াজ। তখনকার পুজোর দিনের সঙ্গে এখনকার পুজোর অনেক তফাত চোখে পড়ে। সেই নির্ভেজাল কলকাতাকে আমি খুব মিস করি এখন।

বোনের সঙ্গে অভিনেত্রী।

এর পর যখন একটু বড় হলাম, থিয়েটার জীবন শুরু হল। বাসে করে থিয়েটার করতে যেতাম। আমার নাটকের স্কুল ছিল উত্তর কলকাতায়। এই সূত্রেই আমার উত্তর কলকাতাকে চেনা। ওইখানে গিয়ে একটা অন্য কলকাতাকে পেলাম। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা, বেলের মোরব্বা খাওয়া বা মিষ্টি চিনেবাদাম। তখন তো খুব সামান্য হাতখরচ পেতাম। পঞ্চাশ পয়সা হবে হয়তো। তাই দিয়ে এ সব কিনে খাওয়ার মধ্যে দারুণ একটা আনন্দ ছিল। এত সামান্য জিনিসেও যে খুশি হওয়া যায়, সেটা এই প্রজন্মে দাঁড়িয়ে আর মনে হয় না। পঞ্চাশ টাকার জিনিস দিলেও এখন কোনও বাচ্চার মুখে হাসি দেখতে পাওয়া যায় না!

আমার থিয়েটারের শুরু কিন্তু বেলতলা গার্লস দিয়ে। এ প্রসঙ্গে বলি, কলকাতায় কালচারাল রেভলিউশন এনেছিল কিন্তু জোছন দস্তিদারের সোনেক্স। এই সময়টায় আমার প্রচুর থিয়েটার দেখা হত। টিনের তলোয়ার দেখেছি আমি ওই বয়সে। এই জগতের প্রতি আমার আকর্ষণ কিন্তু তখন থেকেই ছিল। সেটা আমার বাবার জন্যই খানিকটা সম্ভব হয়েছে। কারণ বাবা থিয়েটার করতেন। মা-ও শিল্পী নন বললে ভুল হবে। মা খুব সুন্দর আলপনা দিতেন। কারণ হাউস-হোল্ডে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের নগণ্য বলে দেওয়াটা তো বৃথা। তারা এই জায়গায় নিপুণ বলেই সংসারগুলো টিকে থাকে।

ছোটবেলায় আমি নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখেছি। দূরদর্শনে সোনেক্সের কিছু প্রোডাকশন হত, সে সব দেখে। তখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। ফাইভ থেকে আমার ডিরেকশনে অনেক নাটক করিয়েছি, নাচও। এখন সে সব ভাবলে অবাক লাগে! নাটকে টিকিওয়ালা লোকের মাথায় যে গাঁদা ফুল থাকবে সেটাও আমি বাড়ি থেকে জোগাড় করে নিয়ে যেতাম। এই সময় শুধু গান গাইতাম। নাচ শেখা শুরু করিনি তখনও। নিজের মনেই নাচ করতাম।

ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি, নাটকের শো নিয়ে মুম্বই পাড়ি দিই। কলকাতায় আমার অভিনয় নিয়ে অনেকে লিখতেন, প্রশংসা করতেন। এর পর ঢুকে পড়লাম নাচে। বোন নাচ শিখতে যেত, আমি গলিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম।

আরও পড়ুন, রাজেশ খন্নার জন্যই কি ক্ষতি হয়েছিল?

গুরু গোপাল শ্রেষ্ঠার কাছে গান শিখতে যেতাম। সেটাও খুব মজার ছিল। তিনি নেপালের রাজদরবারে গান গাইতেন। তার পরে এখানে চলে আসেন। আমি ক্লাস ওয়ান থেকে গান শিখি। যখন ক্লাস থ্রি, থার্ড ইয়ার দিচ্ছি। তখন কলকাতার রাস্তা ধরে হাঁটলেই বিকেল হলে হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যেত। আমাদের বাড়িতেও তেমনটাই চলত। সকালবেলা বাবা বাজার যেতেন, হারমোনিয়ামটা বের করে দিয়ে। আমার রেওয়াজ শোনার জন্য পাড়াপ্রতিবেশী বসে থাকতেন। তাঁদের হয়তো খুব বিরক্তও করেছি। তবে অনেকেই বলতেন, আমি নাকি খুব ভাল গাই। রোজ সকালে উঠে রেওয়াজ করতাম। তার পর হোমওয়ার্ক করে স্কুলে যেতাম।

আমরা বাঙালিরা ভীষণ ভাবে শিল্প-সংস্কৃতি নির্ভর। এগুলো আমার মনটাকে তৈরি করেছে। যেটা আমি এখন বুঝি।

যখন ক্লাস এইটে পড়ি, কলকাতায় প্রথম শো করি অ্যাকাডেমিতে। তখন আমি অ্যাকাডেমিকে প্রথম জানলাম। এই ভাবে কলকাতার শিশিরমঞ্চ, রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসকে চিনেছি। এখন কিন্তু আমি সে ভাবে হেঁটে চলে বেড়াতে পারি না। কিন্তু এগুলো আমার খুব প্রিয় জায়গা। এখানে গেলে কলকাতার সঙ্গে সংস্কৃতির অদ্ভুত একটা মেলানো গন্ধ পাওয়া যায়। কলকাতার আলাদা একটা গন্ধ আছে। আমি সেই গন্ধটা পাই।

এবার বলি, কলকাতাকে কী ভাবে দেখা শুরু করলাম। একবার ক্লাস এইটে, স্কুল থেকে আমাদের এক্সকারশনে নিয়ে যাওয়া হল জব চার্নকের সমাধিতে। তখন খুব বোম ফাটছিল। বাবা-মা বলে দিয়েছিলেন কেউ কিচ্ছু দিলে নেবে না। আমি এই সমাধিক্ষেত্রে যাওয়া মাত্র অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। রাজভবনের সামনের সেন্ট জোনস গির্জাটা আমাকে পুরনো কলকাতাকে মনে করিয়ে দেয়। ওখানে গেলে মনে হয়, গির্জার দেওয়ালগুলো যেন কথা বলে। আমি ওখানে গেলেই সেই স্বাধীনতার আগের সময়ে চলে যাই। ওখানকার গাছপালার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। আমি খুব প্রকৃতিপ্রেমী। এ কারণেই কলকাতা আমার এত প্রিয়।

এ বার কলেজ জীবনের কলকাতার কথা বলি। সাউথ সিটি কলেজের মর্নিং-এ পড়তাম। কলেজ জীবনে প্রথম প্রিন্সেপঘাট যাই বন্ধুদের সঙ্গে। গঙ্গার ধারে বসে আইসক্রিম খাওয়া, নৌকায় চড়া—এ সবের মধ্যে আলাদা একটা মজা ছিল। এই সময়গুলোয় আমি মনে মনে ফিরে যাই মাঝে মধ্যে।

বা়ড়িতে বাবা বিকেলবেলা রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে আসতেন। সেই গন্ধটা গরমকালে বেরোত। এটা এখন আর পাই না! মা জুঁই ফুল মাথায় লাগাতেন, রান্না করতেন। মা যখন রাতে চুল আঁচড়াতেন দারুণ গন্ধ বেরোত। আরেকটা ব্যাপার খুব আনন্দ দিত আমাকে। মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয়ে যাওয়া। আর সন্ধেবেলা হলেই গানের আসর বসত, হ্যারিকেন জ্বলত। প়ড়া শেষ হলে বসার ঘরে সবাই মিলে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম, বোন যে কবিতাটা সদ্য শিখেছে, সেটাই আবৃত্তি করত। তেলেভাজা খাওয়া হত। আর মাঝরাতে লোডশেডিং হলে সবাই মাদুর হাতে ছাদে চলে যেতাম। এই দিনগুলো খুব কষ্টের ছিল, তবুও এই দিনগুলোকে আমি খুব মিস করি। এই দিনগুলো আর ফিরেও পাব না!

একটা সময় আমার যখন খুব রাগ হত কলেজ জীবনে, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতাম। তখন তো আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না, আমি হাঁটতে শুরু করতাম। রাসবিহারী হয়ে, হাজরার মোড় ধরে গড়িয়াহাট। সেখান থেকে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি। আবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে আসতাম।

কলেজ লাইফে লেককে চেনা। এখনকার মতো তখন লেকে মর্নিংওয়াকের চল ছিল না। তখন লোকে প্রেম করতে লেকে যেত। সবাই ‘খারাপ জায়গা’ বলে আলাদা করে লেককে সরিয়ে রাখত। কিন্তু আমরা দলবেঁধে বন্ধুরা মিলে যেতাম, প্রেম করা দেখতাম। তখন যদিও প্রেমটা এতটা শরীরী ছিল না। আমরা যে সময় বেড়ে উঠেছি, প্রেমের মানেটা বেশি প্লেটোনিক ছিল। যে কারণে সকালবেলার লেকের আকাশ, প্রচুর পাখি একটা অদ্ভুত রিল্যাক্সেশেসনের কাজ করত।

এত পরিবর্তনের জোয়ারেও কিন্তু কলকাতা কলকাতাতেই আছে। আমরা বদলে গেছি। তবে না বদলালে তো সময়ের সঙ্গে এগোতে পারব না।

তবে সেই যে একটা নিজস্বতা নিয়ে চলা বিনা-ফ্যাশনের কলকাতা এবং নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করা, সব মিলিয়ে আমরা আলাদা ছিলাম। আমাদের এখনকার মতো দৌড়টা ছিল না।

কলকাতায় মল গড়ে উঠেছে প্রচুর, মেয়েদের ফ্যাশন তুমুল বদলে গেছে। একটা সাধারণ মেয়ে যে ভাবে সাজে, আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না! এগুলো সবই বোধহয় নেট বা টিভির দৌলতে। এখন আসলে সব কিছুই মানুষের হাতের মুঠোয়। আমাদের সময়ে যেগুলো ভাবতেই পারতাম না। তবে আগের যে চার্মটা সেটা এখনও চাইলে মা-মাসিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। পুরনো গন্ধটা বদলায়নি।

তবে বদল নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই, কারণ আমিও প্রচুর বদলে গিয়েছি। আমি খুব সাদাসিধে ছিলাম। ভাগ্যিস বদলেছি। কিন্তু তাতেও কি খুব চালাক-চতুর হতে পেরেছি! আমি ওপরের মোড়কটা খানিকটা বদলেছি, ভেতরটা বদলাতে পারিনি। সেটা কেউই বদলাতে পারে না। ধাক্কা খেতে খেতে একটা অন্য বস্তুতে পরিণত হয় মাত্র, কিন্তু বদলে একটা অন্য ফরম্যাটে চলে যাবে সেটা হয় না। অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, প্রত্যাশা এগুলো কাউকে একটা অন্য মানুষে পরিণত করতে সাহায্য করে, কিন্তু ভিতরের মানুষটা ভিতরেই থেকে যায়। তার উপরে বিভিন্ন জামাকাপড়, রংচং মাখিয়ে অন্য ভাবে সাজানো হয়। যেমন ভাবে কলকাতা সাজছে। কলকাতার চরিত্রটা বদলায়নি।

যেমন উত্তর কলকাতার রিকশাওয়ালারা কিন্তু একই রয়ে গেছে। দুপুর বারোটা নাগাদ ছাতু মেখে খায়। ডালপুরিওয়ালারা মাথায় ডালপুরি নিয়ে যায়। এই সফিসটিকেটেড ভিড়ের মধ্যেও ফিরে তাকানোর চেষ্টা করলে আজও অনেক কিছুই চোখে পড়ে। ওই ভিড়ের মধ্যেই কিন্তু পুরনো কলকাতা আটকে আছে।

‘অন্দরমহল’-এর সেটে কনীনিকা।

উত্তর কলকাতার কোনও একটা দালানে দুপুরবেলা চুপ করে বসে থাকলে অনেক রকম আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। হয়তো দূরে কোথাও বাচ্চা কাঁদছে, কারও বাড়িতে টিভি চলছে, কোথাও গান বেজে উঠল। সেগুলো টেনে তোমায় পুরনো কলকাতায় নিয়ে যাবে। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো নিয়ে কেউ এ ভাবেই বেঁচে থাকতে পারে। তা ছাড়া পুরনো কোনও কিছুকে নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। আমি এখনও মাঝে মাঝে তেলেভাজা কিনে নিয়ে বাড়ি যাই। যাতে সবাই একসঙ্গে বসে খেতে পারি। এখন তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যখন ভবানীপুরে থাকতাম, মায়ের জন্য জুঁই ফুলের মালা কিনে নিয়ে যেতাম। যাতে মা লাগালে সেই চুলের গন্ধটা আমি পাই। আমার দিদিমা, বড়মাসি যে জরদা পান খেতেন, সেই পানের গন্ধটা তাঁদের কাছ থেকে আর পাই না বলে আমি নিজেই পান খেয়ে নিই। আমাকে এই ছোটবেলার দিনগুলো রিলিফ দেয়।

সেই ছোট্ট হাতগুলোর কথা মনে পড়ে, যে হাত দিয়ে আমি জানালা আঁকড়ে ধরতাম। বিশ্বকর্মা পুজোয় আকাশে প্রচুর ঘুড়ি উড়ত। আর ঘুড়ি কেটে পড়লে ভাবতাম, তার একটাও কেন আমার ছাদে এসে পড়ে না! হয়তো একটা ঘুড়ি পেলাম, সেটাই আমার কাছে স্বপ্ন। পুজোয় একটা গ্যাস বেলুন পাওয়া বিশাল ব্যাপার। কেউ হয়তো হেসে গাল টিপে দিল, যেন একটা বিশাল কিছু ঘটে গেল আমার জীবনে।

আমাদের ছোটবেলায় বলা হত একটা প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক পড়লে ভাল ইংরেজি বলা যায়। সেই পেপারটা জোরে জোরে পড়তাম, যাতে আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারি। এই স্তরহীন সচ্ছল একটা জীবন, যার মধ্যে প্রচুর অভাব আছে, না পাওয়ার বেদনা আছে, কিন্তু সেই ছোট ছোট পাওয়াগুলোর রেশিওটা এতটাই ভারী ছিল যে, না পাওয়াগুলো কোনও দিন গায়ে লাগেনি। একটা পুতুল কিনে দেওয়া মানে বিশাল ব্যাপার। কলকাতার মজাটা এটাই। যে সব মধ্যবিত্ত পরিবার কলকাতায় বেড়ে উঠেছে, তারা এই কলকাতাটা দেখেছে।

রোলের দোকান, বিকেল হলেই ফুচকাওয়ালা। মুম্বইতেও পানিপুরি আছে কিন্তু সেটা কলকাতার ফুচকার স্বাদের মতো নয়। বাঙালি এত খাদ্যরসিক।

রবিবার আমি যখন নাচের স্কুল (কলাক্ষেত্রম) থেকে বাড়ি ফিরতাম, মাংস রান্নার গন্ধ পেতাম। এই ছোটবেলাটা বোধ হয় এখন আর নেই। আমরা ছোটবেলায় খাবার টেবিল থাকলেও মাটিতে খেতে বসতাম। মা এক জায়গায় বসে পরিবেশন করতেন, আমরা গোল হয়ে বসে খেতাম। সেই খাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা।

এখন আমার দিনের বেশির ভাগটাই কেটে যায় গাড়িতে, যাতায়াতে। কারণ আমার শ্বশুরবাড়ি বাগুইআটিতে। তবে আমি একে পজিটিভলি দেখি। এই সময়টায় আমি স্বপ্ন দেখার সময় পাই। কলকাতাকে দেখার সময় পাই। বাকি সময়টায় শুটিং-এ বন্দি আমি। কখনও বেরোলো সন্ধেবেলার কলকাতা দেখি। আসার সময় সকালেও কলকাতা দেখতে দেখতে আসি। আমি এক্সট্রিম নর্থ থেকে এক্সট্রিম সাউথে ট্রাভেল করি রোজ। এই পুরো কলকাতায় একটা চক্কর লাগাই। এটা কিন্তু খুব মজার। কোন লোকটা কী ভাবে হেঁটে যাচ্ছে, কোথায় কে দাঁড়িয়ে চপ-মুড়ি খাচ্ছে, এই খাওয়ার মধ্যে তার কত আনন্দ, কে কোথায় দাঁড়িয়ে ফোনে কার সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছে, এ সব দেখতে দেখতে আসি। কোন ট্রাফিক পুলিশ রোজ কোথায় দাঁড়ায়, কী চশমা পরে, রোজ সেটাও আমি লক্ষ করি।

আবার আমার বাড়ি ফেরার জার্নিটা বড়বাজারের রাস্তা ধরে। আমি বাগুইআটি থেকে বেরিয়ে গৌরীবাড়ি লেন হয়ে বিডন স্ট্রিটের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ হয়ে লালবাজার কোর্ট ক্রস করে রেড রোড হয়ে ভবানীপুরে ঢুকি। খাবার কিনে সাউথ ক্যালকাটা ট্রাভেল করতে করতে শুটিং-এ আসি। পুরো কলকাতাকে আমি প্রদক্ষিণ করি। তাই আমি সারা কলকাতা দিয়ে হাঁটি। আমার কিন্তু এতে একদম বোরিং লাগে না। কারণ আমি সারাক্ষণ স্বপ্নের জগতে থাকি। গাড়িতে যেতে যেতে গান শুনি। আর তখনও আমি নস্টালজিয়াতে ভুগি।

আরও পড়ুন, ‘অভিনয় আমার জীবনের একটা অংশ মাত্র’

বড়বাজারের এক ঘড়ির দোকান থেকে বাবা আমাকে প্রথম ঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, আর মেট্রো সিনেমার সামনে এসে দাঁড়াতেন। মা আমাকে আর বোনকে মেট্রো করে নিয়ে গিয়ে ওই জায়গাটায় এসে দাঁড়াতেন। ধর্মতলায় ঘুড়ে, চাং-ওয়ায় চাউমিন খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। এগুলো জীবনের বড় পাওয়া। কারণ তখনকার দিনে মাসে একবার রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া মানেই ছিল বিশাল একটা অকেশন। তখন একটা ধোসার দাম ছিল আঠেরো টাকা, এখন তার পেছনে একটা শূন্য লেগে গেছে। এ ভাবেই জীবনের রেশিওটা বদলাচ্ছে।

আমার স্বপ্ন কিন্তু ভাল থাকা। এক সময় মুম্বই চলে গিয়েছিলাম, সেখানে কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। মুম্বইকে আমি ভালবাসি। কিন্তু ফিরে আসার পরে কলকাতাকে আবার ভালবেসে ফেলেছি। এবং কোথাও মনে হয়, এটা আমার শহর। এখানে আমি শান্তি পাই। যেমন ভাবে একা হয়ে গেলে মায়ের কোল খুঁজি আমরা, ঠিক একই ভাবে মনে হয় এটা আমার শহর। এটা আমার জায়গা। আমি এখানে খুব সিকিওরড ফিল করি। কলকাতার মধ্যে যে আত্মীয়তা আছে, ভালবাসা আছে, সেটা আর অন্য কোনও শহরে আমি পাইনি।

এই শহরটা নিজের লোক না হলেও কাউকে ভালবেসে ফেলবে। আমি জানি, খুব কম টাকাতেও এখানে ভাল থাকা যায়। এটা সারভাইভ করার মতো একটা জায়গা। যে শহর মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করে। এখানে চাহিদাগুলো এখনও আকাশছোঁয়া হয়ে যায়নি। এটা যদিও সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।

অনুলিখন: পিয়ালী দাস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement