তাঁর সেরা সময়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন রেখা। আধুনিক মানসিকতা, ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর স্মার্ট উপস্থিতি প্রায় সব পুরুষের মনেই ঝড় তুলত। অমিতাভ বচ্চন, জিতেন্দ্র, বিনোদ খন্না-র মতো সমসাময়িক নায়ক তো বটেই অক্ষয় কুমারের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এক সময় অনেক কথা শোনা গিয়েছিল।
তবে রেখার সঙ্গে যে পুরুষকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে তিনি অমিতাভ বচ্চন। বিধবা হওয়া সত্ত্বেও রেখা তাঁকে স্মরণ করেই সিঁদুর পরেন বলে কানাঘুঁষো ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু জানেন কি রেখার জীবনে এমন এক জন রয়েছেন যিনি অমিতাভের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ? জানেন কি অনেকে রেখার স্বামীর আত্মহত্যার পিছনে এঁকেই দায়ী করেন। এবং এই ‘অন্য কেউ’-ই হলেন একমাত্র মানুষ যাঁকে রেখা তাঁর শোওয়ার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেন!
তিনি ফরজানা নামেই ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত। ফরজানার সঙ্গে রেখার পরিচয় আটের দশকে। ১৯৮১ সালের ‘সিলসিলা’ ফিল্মে রেখার মেক আপ দলের সদস্য ছিলেন ফরজানা। তখন অবশ্য অমিতাভের সঙ্গে রেখার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। পরিচালক যশ চোপড়ার কথা রাখতেই অমিতাভের সঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন রেখা।
রেখার টানাপড়েনপূর্ণ জীবনে হিন্দি ছবির দৃশ্যের মতোই যেন ফরজানার প্রবেশ। ফরজানা ছিলেন রেখার কেশশিল্পী। ছবির বিভিন্ন দৃশ্যের জন্য রেখার চুল বেঁধে দিতেন বা চুল সাজিয়ে দিতেন তিনি। কিন্ত প্রথম দিন থেকেই রেখার ব্যক্তিগত জীবনে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করার খুঁটিটা পুঁতে ফেলেছিলেন ফরজানা।
কয়েক বছরের মধ্যে ফরজানার ব্যাপক পদোন্নতি হয়। রেখা তাঁকে নিজের কেশ শিল্পী থেকে সরাসরি ব্যক্তিগত সচিব করে দেন। তার পর সময় যত এগিয়েছে রেখার জীবনে ফরজানার উপস্থিতি তত গভীর হয়েছে।
ফরজানা এক জন মহিলা। কিন্তু তাঁর চালচলন, বেশভূষা সমস্ত কিছুই পুরুষদের মতো। এমনকি ছোট করে ছাঁটা চুলও ছিল ঠিক অমিতাভের হেয়ার স্টাইলের মতোই।
ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও ছবির প্রস্তাব হোক কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে রেখাকে নিমন্ত্রণ, সব কিছুর জন্য প্রথমে ফরজানার সবুজ সঙ্কেত পেতে হত সকলকে। ক্রমে ফরজানা রেখার ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন। রেখার পেশাগত হোক বা ব্যক্তিগত বিষয়— সবেতেই আধিপত্য শুরু হয় তাঁর।
১৯৯০ সালে ব্যবসায়ী মুকেশ আগরওয়ালের সঙ্গে বিয়ে হয় রেখার। মুকেশ দিল্লির ব্যবসায়ী ছিলেন। আর ছবির জন্য রেখা মুম্বইয়ে থাকতেন। ছবির শ্যুটিং শেষ করে রেখা অবশ্য দিল্লিতে স্বামীর কাছে চলে যেতেন প্রায়ই।
মুম্বইয়ের বাড়িতে রেখার সঙ্গেই থাকতেন ফরজানা। রেখার বাড়িতে ফরজানার মতো তাঁর আরও অনেক সহযোগী ছিলেন। কিন্তু ফরজানা তাঁর কাছে বিশেষ ছিল। শোনা যায় ফরজানার অনুমতি ছাড়া রেখা মুম্বইয়ের বাইরে পা পর্যন্ত রাখতেন না। এমনকি ঘনিষ্ঠ কেউ রেখার সঙ্গে ফোনে সরাসরি যোগাযোগও করতে পারতেন না।
পরিবারের লোকেদেরও আগে ফরজানার সঙ্গে কথা বলতে হত। তার পর তাঁরা রেখার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পেতেন। এই নিয়ম নাকি বজায় ছিল তাঁর স্বামী মুকেশের জন্যও। মুকেশ যা একেবারেই পছন্দ করতেন না।
ইন্ডাস্ট্রিতে গুঞ্জন, রেখা এবং মুকেশের মেলামেশার মধ্যে ক্রমে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান ফরজানা। বিয়ের মাস খানেক পর থেকেই দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। এর মধ্যে একটি ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য নিউ ইয়র্ক যান রেখা। তাঁর নিউ ইয়র্ক সফরের মধ্যেই বিয়ের মাত্র ৭ মাসের মধ্যে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন মুকেশ।
এই ঘটনা সারা ইন্ডাস্ট্রিকে হতভম্ব করে তুলেছিল। রেখা দেশে ফিরে স্বামীর শেষকৃত্যে অংশ নেন। মুকেশের পরিবারের সঙ্গেও দেখা করেন। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই ছিল। ব্যবসায় ক্ষতির জন্যই মুকেশ আত্মহত্যা করেছেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু তার পর ক্রমে রেখার দিকে আঙুল তুলতে শুরু করে মুকেশের পরিবার। সেই প্রথম ফরজানার নামও উঠতে শুরু করে। সেই প্রথম ফরজানার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক নিয়ে নানা কানাঘুঁষো কথা শোনা যেতে শুরু করে।
মুকেশের পরিবার দাবি করে, ফরজানার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিতে রেখার আচরণে আকাশ-পাতাল বদল দেখা যেত। ফরজানার সামনে রেখা বেশি কথা বলতেন না মুকেশের পরিবারের সঙ্গেও। আর ফরজানা না থাকলেই রেখা সকলের সঙ্গে অত্যন্ত মিলেমিশে চলতেন।
ইয়াসির উসমান নামে এক লেখক রেখার জীবনী নিয়ে বই লিখেছিলেন। তাঁর বইয়েও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে এই সম্পর্কের কথা। তাঁর কথায়, বাড়ির কোনও পরিচারকই রেখার শোওয়ার ঘরে ঢুকতে পারতেন না। একমাত্র ফরজানা ছাড়া। রেখার ব্যক্তিগত জীবনে যাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। রেখার পারিবারিক ছবিতেও তাঁকে দেখা যায়।
মোহনদ্বীপ নামে আর এক লেখক তাঁর বইয়ে ফরজানা এবং রেখার সম্পর্ক নিয়ে আরও খোলামেলা কলম ধরেন। তিনি স্পষ্ট লিখে দেন যে, তাঁদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও রয়েছে। যদিও এ সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন রেখা। ফরজানাকে তিনি নিজের বোনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তা বলে কি আর ইন্ডাস্ট্রির মুখ বন্ধ করা যায়!
ফরজানার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক নিয়ে নানা মহল থেকে নানা মত উঠে আসতে শুরু করে। বলিউডের এক সাংবাদিকের কথায় যেমন, রেখার জীবনে পুরুষের অভাব মেটান এই ফরজানাই। কারও মতে, রেখার প্রতিটি বিষয় যে ভাবে খেয়াল রাখেন ফরজানা তা দেখে বলাই যায় যে তাঁরা একে-অপরের জন্যই তৈরি।
এ সব গুঞ্জন নিয়ে কখনও ফরজানাকে সরব হতে দেখা যায়নি। বরং তিনি রেখার ভালমন্দ খেয়াল রাখতেই ব্যস্ত থাকেন সব সময়। ১৯৮১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একই ভাবে রেখার দেখভাল করে চলেছেন। আজও প্রতিটি অনুষ্ঠানে রেখার ঠিক পাশেই দেখা যায় ফারজানাকে। রেখাই নাকি তাঁর পাশের সিটটা আগে থেকেই ফরজানার জন্য ‘বুক’ করে রাখেন।
প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি রেখা। ফরজানাও সংসার পাতেননি।