Kalpana Barui

‘বরের থাপ্পড় খেতে খেতে এক দিন বিক্রি হয়ে যাচ্ছিলাম’

আমার বর মুখে থাপ্পড় মারত আর বলত, আমার সুন্দর মুখে যেন চিরকাল দাগ থেকে যায়। আমার পিরিয়ডের সময় জোর করে শারীরিক মিলন চাইত যাতে আমার কষ্ট হয়। আমার বাচ্চা এলে লাথি মেরে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আর আমার বাড়ির লোক বলত, মানিয়ে নে।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৩:১৮
Share:

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

জীবনের সত্য উদ্ঘাটন করলে কল্পনা বাড়ুই (নাম পরিবর্তিত)। তাপসী পান্নুর ছবি ‘থাপ্পড়’-এর ট্রেলার দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি তিনি। নিজের জ্বালা বেরিয়ে এসেছে তাঁর।

Advertisement

বাড়ুইপুরের মেয়ে কল্পনা। “আমরা চার বোন। বাবা মিস্ত্রির কাজ করতেন। একেবারে গ্রাম্য পরিবেশে মানুষ আমরা। মাধ্যমিক পাশ করতেই সম্বন্ধ চলে এল। ছেলে কিছু করত না। কিন্তু বাবা বলেছিল ভাল পরিবার, শ্বশুর ব্যাঙ্কে চাকরি করে। ব্যস! আমার বিয়ে হয়ে গেল” একটানা বললেন কল্পনা। যিনি এখন কলকাতার এক লেডিজ হস্টেলের বাসিন্দা। প্রাইভেটে এগারো ক্লাসের পরীক্ষা দিচ্ছেন আর পেট চালানোর জন্য কস্মেটিক গুডস, কাজল, লিপস্টিক বিক্রি করেন।

লিপস্টিক তো ছিল স্বপ্নে। ছিল বরের সঙ্গে লিপস্টিক মেখে সিনেমা যাওয়ার আবেগ। হল কই?

Advertisement

আবেগ রক্তে। আগুনে। কান্নায়।

“ভোর থেকে উঠে শ্বশুরবাড়িতে এগারো জনের রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা। তার পরেও স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। আর রাতে আমার ঘরেই সিনেমা হত। শাশুড়ি থাপ্পড় মারত বাবা কম টাকা দিয়েছে বলে, আর বর মারত নিজের কাজ না করার রাগকে আমার শরীরের উপর ঢেলে। বাড়ির সবাই, প্রতিবেশীরা মজা দেখত,” চোখ ভরে আসছিল কল্পনার।

কল্পনা জানেন, গ্রামবাংলা, শহরে কত মেয়ে আজও চুপ করে সব মেনে নিয়ে থাকে, কেউ বা হারিয়ে যায়।

“আমার বর মুখে থাপ্পড় মারত আর বলত, আমার সুন্দর মুখে যেন চিরকাল দাগ থেকে যায়।’’

বাবার বাড়িতে কোনও সাহায্য পাননি তিনি। ঘরে অবিবাহত বোন। “মা বলেছিল একটু মানিয়ে না প্রথম দিকে সবার হয় অমন” খানিক থামল কল্পনা। “জানেন মায়েদের এই বলাটা ঘরের পুজো করার মতো। রোজ কোনও না কোনও মেয়েকে মায়েরা বা জেঠিমারা এই চুপ করে মানিয়ে থাকার কথা আজও বলছে! আর আমরা, মেয়েরা সহ্য করতে করতে অপরাধ আর অপরাধীকে বাড়িয়ে তুলছি!’’ শান্ত অথচ তেজের গলায় বললেন কল্পনা।

আজ যেন সব বলতে তিনি প্রস্তুত।

“আমার বর মুখে থাপ্পড় মারত আর বলত, আমার সুন্দর মুখে যেন চিরকাল দাগ থেকে যায়। আমার পিরিয়ডের সময় জোর করে শারীরিক মিলন চাইত যাতে আমার কষ্ট হয়। আমার বাচ্চা এলে লাথি মেরে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আর আমার বাড়ির লোক বলত, মানিয়ে নে।’’

আপনি লিখুন বলে ঘুরে তাকায় কল্পনা। “এখন তো মেয়েদের লড়াই নিয়ে আধুনিক সমাজ অনেক বড় বড় কথা বলে। আইনে মেয়েদের নাকি অধিকার অনেক! কই? আমার স্বামী তো আজও জেলের বাইরে। আমার পরে আর একটা বিয়ে। সেই বউও তো আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে বলে শুনেছি। মামলা চলছে নাকি? মামলা না কি টাকার খেলা!” আগুন জ্বলতে থাকে কল্পনার মুখে।

সিনেমা দেখতে ভালবাসেন না কল্পনা। তবুও ‘থাপ্পড়’ ছবিটা তিনি একাই দেখবেন! একাই?

“আমার কেউ নেই। আমার বর এক প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছিলাম তো! নতুন বউ আনতে হবে তো! তাই পুরনো বউ বিক্রি করে টাকা।” হিসেব বুঝিয়ে দিলেন কল্পনা।

মাধ্যামিক পরীক্ষা অবধি দৌড় তাঁর। বাবা গরিব যাঁর, সে মেয়ে বরের থাপ্পড় আর পাশবিক অত্যাচার মেনে নেওয়া ছাড়া কী-ই বা করতে পারে?

কেউ কেউ পারে। যেমন পেরেছেন কল্পনা। পাচার হওয়ার রাতেই পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।

“পুলিশ আমার বড়লোক শ্বশুরের কাছে টাকা নিয়ে আমার কোনও বিচার করেনি।” কল্পনা তাই ছেলে মেয়ে সব ছেড়ে এক শাড়িতে হাজির হয় রাজ্য মহিলা কমিশনের কাছে। পাড়ার এক বান্ধবী জানিয়েছিল, ওখানে গেলে বিনা পয়সায় থাকার ব্যবস্থা হয়।

“ভেবেছিলাম গলায় দড়ি দেব। কিন্তু তার পরেই ভাবলাম, আমি মরলে ছেলে মেয়ে দুটো জানতেই পারবে না ওদের মা কেমন ছিল। বরং আমার স্বামী ওদের বলবে পরপুরুষের সঙ্গে ওর মা পালিয়েছে।”

বেঁচে রইলেন কল্পনা। এত কিছুর পরেও মুখ ফিরিয়ে নিল পরিবার। তারা তত দিনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকেই শুনেছে, তাদের মেয়ের চরিত্র খারাপ।

“কোথাও থাকার জায়গা নেই। টাকা নেই। পথে নেমেছি। ওই সময় কেবল মনে হত মায়ের কাছে ছুটে যাই। মায়ের নরম আঁচলে মুখ লুকোই বাজে পৃথিবী থেকে। যাইনি। আমি কাছে গেলে অন্য বোনদের বিয়ে হত না।” কমিশনের সহায়তায় কল্পনার ঠাঁই সরকারি হোমে। ‘‘রাজ্য মহিলা কমিশন জন্যই পায়ের তলার মাটি ফিরে পেলাম।’’ বলছেন কল্পনা। রাজ্য মহিলা কমিশনের অধ্যক্ষা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘ ইদানিং অনেক মেয়েরাই কমিশনে আসছে থাকার জায়গার আর্জি নিয়ে। আমরা সত্বর চেষ্টা করি তাঁকে সরকারি হোমে জায়গা করে দেওয়ার। কল্পনা শুধু জায়গাই নয় নিজের রোজগারের দিকে যে নজর দিয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, এটা দেখে আমি খুব খুশি।’

“প্রথম থাপ্পড়েই যদি বেরিয়ে আসতে পারতাম! আর একটু লেখাপড়া, রোজগার করে ছেলে মেয়েকে কাছে রাখতে পারতাম।” মুখে কাপড় আটকে কান্না চাপলেন কল্পনা।তাঁর শরীর ঘিরে হিংসার ক্ষত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement