‘‘এ কূল আর ও কূল হারাইলে দুকূল/ কবে ফুটিবে মন তোর বিয়ার ফুল?/ আগে পুড়িবে মন্তর মাথার চুল/ শ্বশুরবাড়ি হবে রে তোর নদীর কূল’’
এটা একটা শব যাত্রার গান। কালিকাপ্রসাদ কম্পোজ করেছিলেন ‘বিসর্জন’ ছবির জন্য। নচিকেতা চক্রবর্তী তাঁর আবেগ আর অভি়জ্ঞতা দিয়ে সে গান রেকর্ড করেছিলেন। সম্ভবত এই গানই তাঁর প্রথম গাওয়া লোকগান। কিন্তু নচিকেতা, আপনি কি জানতেন আপনার এই ‘প্রথম’ কিছুতে কারও ‘শেষ’ হতে পারে?
শোকস্তব্ধ আর এক মানুষ। গানই তাঁর আত্মা। ‘বিসর্জন’এর পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ওই গান শোনার পর কালিকার চলে যাওয়া আর দেখতে পারেননি তিনি। আজও তাঁর ভিতরে তাড়া করছে ফুলে ঢাকা শব।
‘‘পলাশের আগুন নয়। লোকগানের লাইব্রেরিতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল কালিকা। যেন শোকের সমস্ত বন্দোবস্ত করে চলে গেল। আমাকে দিয়েও লিখিয়ে নিল ‘বিসর্জন’ ছবির শেষ গান,’’ বললেন কৌশিক।
‘‘যে যায় যায় রে ভাইস্যা ভাটির টানে,’’ এ গানই বলছে আমাকে যেতে দাও ভাটার টানে। আর পিছু ডেকো না।
ছবিকে ছাপিয়ে কালিকার চলে যাওয়া বেশি বড় হয়ে উঠেছে এখন। ‘বিসর্জন’ ছবির প্রযোজক সুপর্ণকান্তি করাতির কাছে কালিকাপ্রসাদের গান বিক্রির অফারও এসেছিল। তিনি যদিও তাঁর প্রিয় ‘কালিকাদার’ গান বিক্রি করতে চাননি। কালিকা বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রথম ছবি ‘বিসর্জন’ তাই পারিশ্রমিক নেব না, রিলিজের পর…’ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কালিকার হোয়াটস্অ্যাপ দেখছেন, আর বলে চলেছেন, ‘‘দেখুন ‘বিসর্জন’এর গান তৈরির সবকিছু এখানে লেখা, মাঝরাতে কালিকা লিখছে, ‘এখন কর্ড বাজাচ্ছি না। কৌশিকদা, টিউন বাড়ালাম,’ ’’ দ্বিধায় পড়েছেন কৌশিক। স্মরণসভায় আগামী বুধবার ‘বিসর্জন’ ছবির গান রিলিজ করবেন। নিজেকেই প্রশ্ন করছেন তিনি। ‘‘আসলে বাস্তবে কী? কালিকার ছবির সামনে নীরবতা পালন। দু’টো দুঃখের কথা। তার পরেই আমরা বলব সকলে ছবির গানগুলো শুনুন। আমাদের হিট বাড়ুক?’’
‘নাইন্টিন ফর্টি টু আ লভ স্টোরি’ ছবিতে তাঁর গান আর ডি বর্মন জীবদ্দশায় শুনে যেতে পারেননি। এখানেও কালিকা দেখতে পেলেন না তাঁর গান ছবির স্রোতে কেমন সুর ভাসাল?
‘‘আমরা সবসময় ভাবি সব রেডি করে মিউজিক ডিরেক্টরকে দেখাব। সব রেডি করতে গিয়ে শব রেডি হয়ে গেল’’-স্তব্ধ কৌশিক!
দীর্ঘদিন পর খাঁটি লোকগান বাংলা ছবির মধ্যে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে থাকবে। নববর্ষে মুক্তি পাচ্ছে ‘বিসর্জন’। পয়লা বৈশাখ এমনই একটা দিন বাঙালি যেদিন কলাপাতা খোঁজে, ধুতি-শাড়িতে নিজেকে জড়ায়। ‘বিসর্জন’ও সেই বাঙালিয়ানার গল্প বলবে। মানুষ এখানে কাঁটাতার দিয়ে জমি ভাগ করলেও আকাশে, নদীতে কাঁটাতার দিতে পারেনি। আটকাতে পারেনি চুম্বনও। সেদিন ইছামতীর বিসর্জনে কালিকার দোতারায় ‘‘নাও যায় রে’’ বেজে উঠবে ভাটিয়ালির বিচ্ছেদে। এমন মর্মান্তিক হতে পারে উদ্যাপনের গান!
মনে আসছে কৌশিকের। কালিকাকে দেখেছিলেন যাদবপুরের মাঠে। কালিকার হাত ধরে ‘দোহার’ এল। শুনেছিলেন কালিকা নাকি অনেক কিছু জানে। ‘‘আসতে-আসতে কালিকা একটা বইয়ের মতো, অভিধানের মতো হয়ে গেল,’’ বলে চলেছেন কৌশিক।
সব গুলিয়ে যাচ্ছে তাঁর! ‘বিসর্জন’ ছবিতে লেগে থাকল ক্ষতের দাগ। ছবির লোগোয় যেমন সিঁদুর মোছার দাগ !
হঠাৎ একদিন আগুনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কত লোকগান, অচেনা মানুষের গল্প, যন্ত্র সবই জ্বলে ছারখার।কিন্তু সংগীতের বোঝাপড়া আগুনে জ্বলতে পারে না। ‘‘কালিকা সুর, কথা, জীবন, মৃত্যু সব ‘বিসর্জন’এর উপর, আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল! আর পেরে উঠছি না।’’ অস্বস্তি কৌশিকের গলায়।
কালিকা, শুনছেন আপনি? আপনার বিসর্জনেই আগমন লিখছে ইতিহাস। যেন হারানো চৈত্রে শ্রাবণের বিসর্জন।
জলের ওপর পানি/
না পানির ওপর জল…