সারা শহর জুড়ে আপনাদের ‘রামধনু’ ছবির হোর্ডিং। আর রচনা, আপনার সেখানে নতুন লুক। নতুন ইমেজ... কিন্তু নায়িকা নন। অফারটা নিলেন কেন?
রচনা: এখন আর নায়ক-নায়িকা কনসেপ্ট নেই। গল্প বা চিত্রনাট্যই নায়ক। ‘রামধনু’র চিত্রনাট্যে আমার সেই গুরুত্ব আছে।
গার্গী, আপনিই বা কেন গ্ল্যামারবিহীন মধ্যবিত্ত গৃহবধূর লুকে? সেটাও কামব্যাক ফিল্মে।
গার্গী: ‘রামধনু’র সাতটা রং সমান ভাবে আমার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোতে পারে, আমার সেই চেষ্টাই ছিল। এই ছবিতে আমার চরিত্র মিতালি যদি সেজেগুজে আইশ্যাডো লাগিয়ে আসত তা হলে কি চরিত্রটা বিশ্বাসযোগ্যতা পেত?
শিবপ্রসাদ: এই জায়গায় আমি গার্গীকে বাহবা দেব। নতুন করে দর্শক ওকে দেখবে বলে নিজেকে চরিত্রের মতো বাস্তব করে তোলার জন্য যথেষ্ট খেটেছে। এটা ওর দড়ির ওপর হাঁটা ছিল।
রচনা বিখ্যাত তারকা। গার্গীও টেলিভিশন, সিরিয়ালের বিখ্যাত শিল্পী। দুই মেরুর দুই অভিনেত্রীকে এক ছবিতে আনার কারণ কী?
শিবপ্রসাদ: আমাদের ছবিতে কাস্টিং-ই ইউ এস পি হয়ে যায়। ‘ইচ্ছে’য় সোহিনী সেনগুপ্ত, ‘মুক্তধারা’য় নাইজেলের কাস্টিং মনে করুন। মধ্যবিত্ত গৃহবধূর চরিত্রে এমন একজনকে দরকার ছিল, যাঁকে এই রূপে বাঙালি দেখেনি। আনপ্রেডিক্টেবল। পাশের বাড়ির মেয়ের মতো গার্র্গী। অথচ সুন্দরী। অন্য দিকে রচনা এসেছে ওর সেরা হাসির জন্য। একটা প্লেস্কুল, যেখানে বড় স্কুলে ভর্তির জন্য ছেলেমেয়েদের এবং মা-বাবাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, সেখানকার ম্যাডামের হাসিটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা ছাড়া রচনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ‘দিদি নম্বর ওয়ান’য়ের আগে থেকে। তিন বার তিনটে আলাদা কাজের জন্য এর আগেও গিয়েছি। হয়ে ওঠেনি। ফেসবুকে রচনার হাসিতে হাজার হাজার লাইক পড়ে।
এখন গার্গীও আগের চেয়ে স্লিম। টোনড বডি। এর রহস্য কী?
গার্গী: আমি যখন ছোট পর্দা ছাড়লাম শুধু সিনেমায় মন দেব বলে, তখন একটা আলাদা প্যাকেজিং দরকার মনে হল। কেননা আমাকে দেখতে তখন টিকিট কেটে পয়সা দিয়ে দর্শক আসছেন। বড় পর্দার জন্য একটা গ্রুমিং দরকার। নিয়মনিষ্ঠ ভাবে ব্যায়াম করি। মনের সুস্থতার জন্য নিজেকে নিজে সময় দিই। মন স্থিতধী রাখতে ঠিক করে নিই আগামী তিনদিন কী কী করব।
কিন্তু ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর করার কথা ছিল ম্যাডামের চরিত্র। অভিনয় করার আগে ঋতুপর্ণার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
রচনা: শিবু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) যখন এসে বলল যে ঋতুর রোলটা করার কথা ছিল কিন্তু করছে না, তখন একজন প্রফেশনাল হিসেবে মনে হয়েছিল চরিত্রটা আমার করা দরকার। যার করার কথা ছিল সে যখন না বলে দিয়েছে তা নিয়ে আমার ভাবার কোনও দরকার নেই।
শিবপ্রসাদ: ঋতুপর্ণা সব সময়ই আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। সে তিনি অভিনয় করুন বা না করুন। আশা করি তিনি আমাদের প্রিমিয়ারেও আসবেন।
আপনার তো সন্তান আছে। কী মনে হয় স্কুলে ভর্তির জন্য মা-বাবারও একটা গ্রুমিং স্কুল দরকার?
রচনা: খুব দামি গ্রুমিং স্কুল না হলেও চলবে, কিন্তু আজকের প্রতিযোগিতার জগতে বাচ্চাদের ভাল স্কুলে ভর্তির জন্য গ্রুমিং স্কুলে যেতেই হবে। সব বাবা-মায়েরই যে আজকাল ইচ্ছে, সন্তান ভাল স্কুলে যাক, এটা তো সত্যি। সেই স্বপ্নটা পূর্ণ করতে হলে যেতেই হবে। এই ধরনের স্বপ্ন থাকলে বাচ্চা বা বাবা-মা কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন, কী ভাবে সঠিক আচার ব্যবহার শিখে সেই বাধা দূর করা যায় সেগুলো জানতে হবে।
“রচনা মাটিতে পা-রাখা অভিনেত্রী। দেখেছি ওর অধ্যবসায়, ঘরোয়া মনোভাব, সারল্য”
গার্গী
“গার্গী কী ভাবে মায়ের চরিত্রটাকে আত্মস্থ করে কাজ করেছে সেটা দেখার”
রচনা
আপনি নিজের ছেলেকে খুব বড় স্কুলে ভর্তি করতে কখনও চেয়েছেন? তার জন্যে কি গ্রুমিং স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছেন?
রচনা: না করিনি। আমরা এমন স্কুলে ওকে পড়াব ঠিক করেছিলাম যেখানে ব্যাগ নিয়ে ঝুঁকে যেতে হবে না। চেয়েছিলাম বাচ্চা যেন একটা স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষা পায়। ভাগ্যে যেটা থাকবে সেটা হবে। বাদবাকিটা আমার আর আমার স্বামীর যতটুকু শিক্ষণীয় যোগ্যতা আছে তা দিয়ে আমরা শেখাব। চাইনি আমার ছেলের শৈশব, পড়া আর টিচারদের আসা যাওয়ার চাপে হারিয়ে যাক। নিজের সন্তানকে বড় করার অভিজ্ঞতা এই ছবিতে খুব কাজে লেগেছে।
শিবপ্রসাদ: সত্যি, রচনা ছবিতে যে রোলটায় অভিনয় করেছে এবং জীবনে যা, তার মধ্যেও একটা মিল আছে। তা ছাড়া ও এমন ভাবে অনামা অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে ওয়ার্কশপ করার সময় মিশে গিয়েছে যে মনেই হয়নি যে এত বড় স্টার।
গার্গী, আপনাকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘খাদ’ ছবিতে বিশিষ্ট অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। আর এখানে পুরোপুরি মা। এই বাচ্চাটার সঙ্গে সম্পর্ক কী ভাবে তৈরি করলেন?
গার্গী: আমি সব সময় বাইরের জগত্টা অবজার্ভ করি। বাইকে বসা অবস্থায় যখন দেখি, মায়েরা হাতটা বর আর বাচ্চা দু’জনকে জড়িয়ে থাকে। এই অভজারবেশনগুলো মায়ের চরিত্র করতে সাহায্য করেছে। ‘খাদ’য়ের ভিনটেজ লুক থেকে তাই মিতালির লুকে আসতে অসুবিধে হয়নি। কিছু দিন আগে একটা বিজ্ঞাপনের কাজ করলাম। সেখানেও বাচ্চার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে অসুবিধে হয়নি। আকাশনীলের সঙ্গেও এই ছবির আগে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। সেটাই ওয়ার্কশপ।
বহু দিন বাদে বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরলেন। বদলটা কী দেখলেন?
গার্গী: অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছি।
রচনা: তবে এত বেশি প্রফেশনাল হয়ে গিয়েছে পরিবেশটা। আগে আমরা পরিবারের মতো কাজ করেছি। এখন কিন্তু সেটা দেখি না।
গার্গী: কিন্তু আমি এই প্রফেশনালিজমকে বাহবা দেবই। এটা তো কাজের পক্ষে ভাল।
শিবপ্রসাদ: আমরা বছরে একটাই সিনেমা করি। সিনেমা বানানোর আগে একটা ক্যাম্প তৈরি করতে হয়। সংসার তৈরি করলে কাজটা করতে সুবিধে হয়।
গার্গী: একই সঙ্গে ঘরোয়া ভাব আর পেশাদারিত্ব দুটোই রয়েছে এখন। শিবপ্রসাদ-নন্দিতাদির সঙ্গে বারবার কাজ করার ইচ্ছে রাখি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, দেবাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি। সকলের কাজের ধরন আলাদা। কিন্তু প্রত্যেকেই সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রমী। এবং যাঁকে অভিনয়ে নিচ্ছেন তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা। প্রফেশনালিজম এটাই। যাঁরা নিউ এজ ফিল্ম করছেন তাঁরা শিক্ষিত বুদ্ধিমান এবং হোমওয়ার্ক করে আসা মানুষ।
রচনা: আমি তো এখনকার অন্য পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করিনি। কিন্তু দেখলাম শিবু আর নন্দিতাদি দারুণ ঠান্ডা মাথার মানুষ। সেটে ঢোকার আগে এক জন শিল্পীকে তাঁর চরিত্রের জায়গাটায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ওঁদের কোনও জুড়ি নেই।
আর নতুন ধরনের কোনও কাজ করছেন?
রচনা: জুলাই মাস থেকে রাজ মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে কাজ করব। নতুন পরিচালকদের সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখব। এবং চেষ্টা করব তাঁদের ছবির কাজ করার। ‘রামধনু’ মনে হয় নিউ এজ ফিল্মে আমার প্রথম স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।
গার্গী: আমিও চেষ্টা করছি পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। যোগাযোগ না রাখলে আমি যে অভিনয় করতে ইচ্ছুক সেটা বোঝাব কী করে?
রচনা: আসলে আজকাল এত শিল্পী এসে গিয়েছেন যে পরিচালককে বলাই যায় আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। আজ রচনা-গার্গীর মতো অনেকেই আছেন। আমরা ভাল কাজ করতে চাই যখন সেটা বলতে তো কোনও অসুবিধে নই।
রচনা বড় পর্দার তারকা অভিনেত্রী। গার্গী ছোট পর্দার পরিচিত মুখ, মঞ্চশিল্পী। আপনারা পরষ্পরের কাছে কী শিখলেন?
রচনা: গার্গী কী ভাবে চরিত্রটা কে আত্মস্থ করে কাজ করেছে সেটা দেখার।
গার্গী: রচনা খুব মাটিতে পা-রাখা অভিনেত্রী। ভাল লাগে ওর ঘরোয়াপনা। দেখেছি অধ্যবসায়। কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে প্রাণের সখা। রচনার সারল্য, হাসি, ট্যানট্রাম ফ্রি অ্যাটিটিউড সত্যিই শেখার।
শিবপ্রসাদ: আমারও দু’জনকে নিয়ে কাজ করতে সত্যিই কোনও অসুবিধে হয়নি। রচনাকে এর ফুল ক্রেডিট দেব। কারণ ওই সিনিয়ার।
যদি ঋতুপর্ণা থাকতেন রচনার জায়গায় তা হলেও একই রকম হত?
শিবপ্রসাদ: ঋতুপর্ণা থাকলে আমার ধারণা এই রকমই হত। কারণ ওঁরা দু’জনেই ডিরেক্টরস অ্যাক্টর। আনন্দ পাব যদি এমন ছবি করতে পারি যেখানে রচনা আর ঋতুপর্ণা দু’জনেই আছে। রচনার সঙ্গে কাজ করলাম বলে জানলাম শি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট হিউম্যান বিইংস। খুব ভাল মানুষ। আর গার্গী হল, ‘আমি যা আমি তাই। আমাকে পারলে গ্রহণ কোরো। না হলে কোরো না।’ এই দৃঢ়তাটা ওর মধ্যে আছে। এটাকে আমি সম্মান করি।
রচনা: আর শিবু ও আমাদের দু’জনের ইক্যুয়েশন যদি বলেন আমরা দু’জন মা আর ও আমাদের সন্তান। (হাসি)
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের যুগ্ম পরিচালনায় শিবপ্রসাদকে অনেক বেশি প্রচারের আলোয় দেখা যায় কেন?
শিবপ্রসাদ: কারণ আই অ্যাম দ্য ফেস অফ দ্য টিম। ইন্ডাস্ট্রিতে আমি অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছি তাই সামনে আসি। কিন্তু নন্দিতা রায় ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আর ‘রামধনু’তে তো বটেই।
ছোট পর্দায় ‘তুমি যে আমার’ আবারও প্রমাণ করল যে রচনা আর প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায় এখনও অন্যতম জুটি। আবার বড় পর্দায় কবে দু’জনকে দেখা যাবে?
রচনা: সেটা প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায় বলতে পারবে। আফটার অল বুম্বাদাই ইন্ডাস্ট্রি। ‘আই অ্যাম দ্য ইন্ডাস্ট্রি’ নিজেই বলেছে তো ‘অটোগ্রাফ’য়ে। অ্যান্ড হি ইজ দ্য ইন্ডাস্ট্রি। আসল কথা এখন তো নায়ক- নায়িকা ভিত্তিক ছবি হয় না...
‘লড়াই’ ছবিতে প্রসেনজিতের সঙ্গে কাজ করে কেমন লাগল?
গার্গী: বুম্বাদার সঙ্গে আগে আরও একটা ছবিতে কাজ করেছি। এখন উনি অনেক বেশি স্থিতধী হয়েছেন। হয়তো এটা আমার উপলব্ধিটা বেড়েছে বলে দেখলাম।
রচনা: আমি গত পঁয়ত্রিশটা ছবিতেও দেখেছি বুম্বাদাকে চরিত্রের মধ্যেই ডুবে থাকতে। এই প্রথম ‘তুমি যে আমার’য়ে একজন প্রসেনজিত্কে পেলাম যে হাসছে, মজা করছে, গল্প করছে...
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
লোকেশন সৌজন্য: হায়াথ রিজেন্সি।