ঋত্বিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ চিরঞ্জিৎ।
২০ বছর পরে তাঁর পুজো মুক্তি ‘ষড়রিপু ২’। গোয়েন্দা চন্দ্রকান্ত ‘মৃত্যুর রং ধূসর’ ছবিতে ভোল বদলে লালবাজারের দুঁদে পুলিশ অফিসার। তাঁর পরিচালনায় ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে ২’ কি পারবে বাংলা ছবির বাণিজ্যের হাল ফেরাতে? কী বলছেন চিরঞ্জিৎ? বিধায়ক দীপক চক্রবর্তীর চোখে ভবিষ্যতের রাজ্য রাজনীতির ছবিটাই বা ঠিক কেমন?
প্রশ্ন: পুজো-মুক্তি ‘ষড়রিপু ২’। হাতে বিক্রম আদিত্য অর্জুনের ‘মৃত্যুর রং ধূসর’। চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী ফিরছেন?
চিরঞ্জিৎ: একটি করে ছবি মুক্তি পায়। আমায় শুনতে হয়, এটা নাকি আমার দ্বিতীয় ইনিংস। কিংবা প্রত্যাবর্তন। কেন বলা হয়? জানি না। আমার পুজো-মুক্তি তো ভালই চলছে। তার পরেও এই প্রশ্ন!
প্রশ্ন: যেমন আশা করেছিলেন, সে রকম ভাল বাণিজ্য করছে ‘ষড়রিপু ২’?
চিরঞ্জিৎ: হ্যাঁ হ্যাঁ। যেমন আশা করেছিলাম, সে রকমই ফলাফল। ছবি ভালই চলছে।
প্রশ্ন: গোয়েন্দা চন্দ্রকান্তের পরেই লালবাজারের দুঁদে পুলিশ অফিসার?
চিরঞ্জিৎ: হ্যাঁ। পরিচালক বিক্রম আদিত্য অর্জুনের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এই প্রজন্মের ছ’জন ছেলে-মেয়ে আচমকাই খুন হয়ে যায়। আততায়ীকে ধরতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ। জট খুলতে ডাক পড়ে লালবাজারের বিশেষ দলের। তদন্তে ফাঁস হয় খুনি সাইকো কিলার। কিন্তু কীসের তাড়নায় এ ভাবে একের পর এক খুন? সেই নিয়েই এগোবে ছবির গল্প।
প্রশ্ন: গোয়েন্দা কিংবা পুলিশ অফিসারের মতো চরিত্রই ইদানীং টানছে?
চিরঞ্জিৎ: ভাল চিত্রনাট্য আমায় টানছে। যে চরিত্র অভিনয়ের সুযোগ করে দেবে, তাতেই অভিনয় করব।
প্রশ্ন: আপনি আগাগোড়া বাণিজ্যিক ছবির সমর্থক, এই ছবি তেমনই?
চিরঞ্জিৎ: চিত্রনাট্য বলছে, এই ছবিও বাণিজ্যিক ধারারই। টান টান রহস্য আছে। খুন আছে। সম্পর্কের নানা স্তর আছে। চিত্রনাট্যের জোরালো বাঁধন আছে। সব মিলিয়ে গল্পের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। যা দর্শকদের হতাশ করবে না।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় খবর ছিল আপনি পরিচালক হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরবেন, তার কী হল?
চিরঞ্জিৎ: ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে ২’-এর চিত্রনাট্য লেখার কাজ চলছে। কথা ছিল, ওই ছবির পরিচালনায় হাত রাখব। তার আগেই ভাল চরিত্রে অভিনয়ের ডাক পাওয়ায় রাজি হয়ে গিয়েছি। এখন তো আর আগের মতো ছবির কাজ করি না।
প্রশ্ন: সিক্যুয়েল তৈরি হলে নায়ক কে হবে? বিপরীতে ইন্দ্রাণী দত্তই নায়িকা থাকবেন?
চিরঞ্জিৎ: ১৯৯৫ সালের সুপারহিট ছবির নায়ক আমিই ছিলাম। সিক্যুয়েলেও আমিই থাকব। তবে নায়িকা কে, সে সব এখনও ঠিক হয়নি। একেবারেই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে পুরো বিষয়টা।
প্রশ্ন: ১৯৯৫-এর ওই ছবিটি আদ্যন্ত মশলা ছবি ছিল। এই প্রজন্ম সেই ঘরানার ছবি নেবে?
চিরঞ্জিৎ: আমি নিজে বুদ্ধিদীপ্ত বাংলা ছবি দেখতেই ভালবাসি। আমারই বাণিজ্যিক ছবি এখন হয়তো পুরোটা বসে দেখতে পারব না। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে দর্শক আনতে চাইলে বিনোদনমূলক ছবি ছাড়া গতি নেই। ওঁরা যে আঁতেল ছবি পছন্দ করেন না! এই ধরনের ছবি বাংলা ছবির মান হয়তো উন্নত করেছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিকে যে মেরে ফেলছে! প্রেক্ষাগৃহে দর্শক কই? সকলেই বাংলা ছবির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই বার বার সকলকে বাণিজ্যিক ছবি বানাতে বলি। নিজেও তেমনই ছবি বানাব।
প্রশ্ন: আপনার চোখে টলিউড যেমন বেহাল, রাজ্য রাজনীতিও কি তাইই? যে হারে নেতা, অভিনেতারা দলবদলে ব্যস্ত...
চিরঞ্জিৎ: দলবদল যাঁরা করছেন বা করলেন, সেটা তাঁদের ভাবনা। আমার নয়। আমি বরাবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আছি, থাকবও। বেশ কিছু অভিনেতা বাংলা ছবিতে কাজ পাচ্ছেন না। আশা করেছিলেন, বিজেপিকে সমর্থন জানালে হয়তো বলিউডে কাজ পাবেন। তাই এ রকম পদক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বিজেপি শেষ। তাঁরাও তাই ফিরছেন আবার।
প্রশ্ন: আপনি না ভাবলেও রাজনীতি, দলবদল টলিউডে প্রচ্ছন্ন ‘আমরা-ওরা’ বিভেদ তৈরি করেছে, ইন্ডাস্ট্রি যার জন্য ভুগছে...
চিরঞ্জিৎ: এখন আর সে সব কই? কিচ্ছু নেই। যত দিন বিজেপি ছিল, ‘আমরা-ওরা’ বিভেদ নীতিও ছিল। বিজেপির অস্তিত্ব নেই। সব দ্বন্দ্ব ধুয়েমুছে সাফ। সব আবার আগের মতোই চলছে। টালিগঞ্জে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। ভেদনীতিতে টলিউড নষ্ট হয়নি। ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে দর্শকের অভাবে, একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। আমার সময়ে ৭৫০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। এখন বাংলা ছবির প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা মাত্র ৪০! এত ভাল ভাল ছবি দিয়েছি আমরা যে, প্রেক্ষাগৃহই উঠে গিয়েছে! এ দিকে, অক্ষয়কুমারের ‘সূর্যবংশী’ পাঁচ দিনে ১০০ কোটি বাণিজ্য করছে। সেখানে টলিউডের একমাত্র পুজো-মুক্তি ‘গোলন্দাজ’ এক সপ্তাহে ২ কোটি! এই তো বাংলা ছবির হাল।
পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে অকপট চিরঞ্জিৎ।
প্রশ্ন: বুম্বাদার দুটো ছবি কিন্তু জাতীয় পুরস্কার এনে দিয়েছে— ‘গুমনামী’ আর ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র’
চিরঞ্জিৎ: তা হলে তো দারুণ ব্যাপার! কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ উপচে দর্শক দেখেছেন কি? টানা ‘হাউজ ফুল’ বোর্ড ঝুলেছে? দুটো ছবিই সুপারহিট? জাতীয় পুরস্কারে মন ভরে, পেট ভরে না। আবারও বলছি, বাণিজ্য না হলে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না। বহু বছর ধরে এটাই আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে ব্যর্থই হব। এই প্রজন্মের শুধু নিন্দে করে লাভ নেই। এখন যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা প্রত্যেকে তুখোড় অভিনেতা। কিন্তু কেউই তারকা নন! যাঁদের নামে ছবি চলবে। এখনকার ছবি তারকার জন্ম দেয় না। যাকে দেখতে লোক উপচে পড়বে। ব্যতিক্রম দেব। তারকা না থাকলে ছবি চলে? এখন তাই নায়ক-নায়িকা শব্দগুলোই মুছে গিয়েছে। সকলেই অভিনেতা-অভিনেত্রী। এটা কেউ বোঝে না, অভিনেতাদের মঞ্চে প্রয়োজন। ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে তারকা চাই। ঋত্বিক চক্রবর্তী দুর্দান্ত অভিনেতা। তাঁকে কেউ তারকা বানাল না! আফশোস, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ঋত্বিককে কেউ চিনতেই পারে না!
প্রশ্ন: ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন জিতে আপনি আবার বারাসতের বিধায়ক, অঞ্চলবাসীদের উন্নতির জন্য কী পরিকল্পনা?
চিরঞ্জিৎ: ঠিক করেছি অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এ বার রক্ষণাবেক্ষণের দিকে জোর দেব। আমাদের এই খাতে বরাদ্দ হয় কম। ফলে, এত রাস্তা বা সেতু ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। বারাতসতেই দেখেছি, পুকুর পরিষ্কারের ৩-৬ মাসের মধ্যে তার অবস্থা যে কে সেই। সেগুলো যাতে আর না হয়, সে দিকে বেশি জোর দেব।
প্রশ্ন: আপনি ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে নেই! প্রচার চান না?
চিরঞ্জিৎ: আমি সত্যিই প্রচার বিমুখ। এবং নীরবে দিনযাপন করতে ভালবাসি। সামাজিক মাধ্যম ঘেঁটে দেখেছি, যাঁদের হাতে প্রচুর সময় কিন্তু কাজ নেই, তাঁরাই এ সব করেন। আমার এত সময় নেই। ইচ্ছেও নেই। বড় জোর টুইটে আগ্রহী। ওই পর্যন্তই। সেটাও নিয়মিত করি না। আমার স্ত্রীর ফেসবুক আছে। কিছু দরকার পড়লে ওর পাতায় উঁকি দিই। তাতেই প্রয়োজন মিটে যায়।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ, বাংলা ছবির উন্নতির পাশাপাশি ভাল অভিনেতা-রাজনীতিবিদ হওয়া নিয়ে কী পরামর্শ দেবেন?
চিরঞ্জিৎ: অভিনয় আর রাজনীতি এক সঙ্গে সামলানো মুশকিল। পুরো দমে অভিনয়ে থাকলে রাজনীতি না আসারই পরামর্শ দেব। যে কোনও একটা পথ বেছে নেওয়া উচিত। তাকে আঁকড়ে ধরে এগোলে উন্নতি অবধারিত। কিন্তু দুটো সামলাতে গেলে অনেক সময়ে কোনওটাই ঠিক মতো হয় না। অভিনয়ে ব্যস্ততা কমলে রাজনীতিতে আসা যেতেই পারে। নইলে, অধিবেশন ডুব দিয়ে শ্যুটে যেতে হবে। যেমন, আমি। ‘রক্তের রং ধূসর’ ছবির জন্য অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকব।