Sushant Singh Rajput

পোস্ট জুড়ে অবসাদের দাগ, কেউ বুঝতেই পারল না সুশান্তের মনের কথাটা!

অভিনেতার শেষ এক সপ্তাহের ইনস্টাগ্রাম যদি দেখা যায়, তবে এটা স্পষ্ট ভাবে উঠে আসবে, মনের দিক থেকে সত্যিই বোধহয় ফুরিয়ে যাচ্ছিলেন সুশান্ত।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২০ ২১:১৫
Share:

সুশান্তের এই অন্ধকারের পোস্টের গভীরতা তাঁর এক কোটি ভক্তের কেউ বুঝলেন না? ফাইল চিত্র।

২১ জানুয়ারি জন্মদিন ছিল তাঁর। ১৪ জুন আচমকা দাঁড়ি ৩৪ বছরের টগবগে জীবনে। বন্ধু, বলিউড, পড়শি ভেবেই উঠতে পারছেন না, সুশান্ত সিং রাজপুত ‘নেই’!

Advertisement

‘নেই’ কেন? সংবাদমাধ্যমের ক্ষীণ সূত্র, বেশ কিছুদিন ধরেই ‘এম এস ধোনি’ মনখারাপে ডুবে। এ মনখারাপ বিলাসিতার নয়। এ এক অসুখ। বিগত ছয় মাস ধরে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন চলছিল, তিন মাস গৃহবন্দি। বন্ধুদের সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। অর্থ, শিক্ষা সব ছিল তাঁর। নিয়মিত শরীরচর্চা, বন্ধু-আড্ডা, দিল্লির ইঞ্জিনিয়ার থেকে মুম্বইয়ের তারকা। লাখ লাখ মেয়ের হৃদয়ের রাজা। তাঁর এমন কেন হল? এর মধ্যেই গত সপ্তাহে তাঁর প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়ান আত্মহত্যা করেন। সে খবর নিজে জানিয়েছিলেন সুশান্ত।

আর তার পরেই তিনি...

Advertisement

এই হাসিখুশি ছেলেটার কোনও ডিপ্রেশন থাকতে পারে? হলে মুক্তি পাওয়া শেষ ছবি ব্লকব্লাস্টার ‘ছিছোড়ে’। ছবিতে তো আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সংলাপ বলেছেন! তবে? সেই তিনি আত্মহত্যা করে মারা যাবেন? দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা চলছে ম্যানেজারের আত্মহত্যা আর পরবর্তী কালে তাঁর মৃত্যু নিয়ে।

The Avatamsaka Sutra describes enlightenment as an awareness of the “interpenetration of space and time.” One can’t help but wonder if Einstein’s theory of relativity that unifies space and time was just a stroke of genius or also a glimpse of the divine. #spacetime 💭

A post shared by Sushant Singh Rajput (@sushantsinghrajput) on

এটা আপাতত তদন্ত বলবে। তবে অভিনেতার শেষ এক সপ্তাহের ইনস্টাগ্রাম যদি দেখা যায়, তবে এটা স্পষ্ট ভাবে উঠে আসবে, মনের দিক থেকে সত্যিই বোধহয় ফুরিয়ে যাচ্ছিলেন সুশান্ত। সেই অগোছালো ভাব ছায়া ফেলেছে সোশ্যালে।

সুশান্তের ইনস্টাগ্রামে চোখ রাখলে প্রথমেই দেখা যাবে ২ মে-র পোস্ট। একটি গাছ আর একটি মেয়ে ছবিতে। ক্যাপশন বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ, ‘আজ ঘুম ভেঙেই নিজেকে তোমার চোখ দিয়ে দেখেছি। তার পর আবার দেখলাম তোমায়। সঙ্গে সঙ্গে সব বুঝলাম....’

এই ‘তুমি’-টি কে?

৫ মে-র পোস্টে নিজেকে ভাল রাখার একটি লিস্ট বানিয়েছিলেন অভিনেতা। তাতে ছিল ৭ ঘণ্টার টানা ঘুম, ধ্যান, যোগ, ভাল কিছু লেখা, অনলাইনে ইতিবাচক লেখা পড়া আর হালকা উপোস। অর্থাৎ, ভাল থাকার ইচ্ছে পুরোদস্তুর ছিল মনে। কিন্তু সঙ্গের ছবিটি বলছে অন্য কথা। মুখ-চোখে বিষণ্ণতার গাঢ় ছাপ।

আরও পড়ুন: সুশান্ত সিংহ রাজপুতের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার, আত্মহত্যা বলে সন্দেহ

কীসের অবসাদ? সম্পর্ক? না কি কেরিয়ার? মৃত্যু রহস্যেই

মা...স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখের জলে: শেষ পোস্ট সুশান্তের

তারা দেখা ছিল নেশা, মেধাবী ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়েন অভিনয়ের টানে

বিষণ্ণতা? সুশান্তের? ১৯৮৬ সালের ২১শে জানুয়ারি বিহারের পটনায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সুশান্ত সিং রাজপুতের। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করলেও শুরু থেকে তার ঝোঁক ছিল অভিনয়ের প্রতি। সেই আগ্রহ থেকেই মিডিয়া জগতে তিনি পা রেখেছিলেন ব্যাকআপ নৃত্যশিল্পী হিসেবে। তার পর অভিষেক কপূরের ‘কাই পো ছে’ ছবির হাত ধরেই বলিউডে পদার্পণ। সেখান থেকে বলিউডের জনপ্রিয়তা তাঁকে হাতছানি দেয়। আসে সাফল্য।

এম এস ধোনি (দ্য আনটোল্ড স্টোরি), পিকে, কেদারনাথের মতো একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমায় তাঁর দাপুটে অভিনয় মন জয় করেছিল বিশ্বের। এই সুশান্তকে তবে ৩৪ বছরেই চলে যেতে হল কেন?
মেন্টাল অ্যাক্টিভিস্ট রত্নাবলী রায় বলছেন, “শুধু মানুষের সাফল্য, কেরিয়ার এই ক্ষেত্র ধরে তাঁর অবসাদের কারণ যাচাই করা যায় না। আমরা কি জানি ওঁর কোনও ধার ছিল কি না? ওঁর সম্পর্কের জায়গা কেমন ছিল? এগুলোও মানুষকে তাঁর নিজের জীবন নিয়ে নিতে বাধ্য করে। আর মনের অসুখ হওয়ার আগেও মনের অস্বস্তি হয়। এই ইনস্টাগ্রাম পোস্ট হয়ত সেই মানসিক কষ্টের ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
আর কী বলছে সুশান্তের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট?

I got up today and looked at myself through your eyes, and then looked back at you with everything I understood I was... #selfmusing

A post shared by Sushant Singh Rajput (@sushantsinghrajput) on

২৫ মে রীতি মেনে তিনি ইদ মুবারক জানিয়েছেন সবাইকে। অর্থাৎ, সংসার-জগৎ সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন তখনও হয়ে ওঠেননি।

২৬ মে সেই সুশান্তই আবার গভীর দার্শনিক। মহাকাশ, গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ, জ্যোতিষ্কলোক নিয়ে তাঁর অনন্ত জিজ্ঞাসা উঠে এসেছে পোস্টে। প্রিয় হচ্ছে অন্ধকার জগত। যা কিছু ‘আনরিয়েল’ তখন থেকেই কি বরাবরের মতো মহাকাশযাত্রী হওয়ার কথা ভাবছিলেন?

সুশান্তের এই অন্ধকারের পোস্টের গভীরতা তাঁর এক কোটি ভক্তের কেউ বুঝলেন না? এমন তো হতে পারে ওই পোস্টগুলো পড়ে ওঁর সঙ্গে কেউ আলোচনা করুক এটা উনি চেয়েছিলেন? “হতে পারে পোস্টগুলো ক্রাই ফর হেল্প! যেহেতু উনি শিল্পী, চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, সম্ভবত এই পোস্টগুলো তাঁর পারফরম্যান্স হিসেবে দেখা হয়েছে। যাঁরা পারফর্ম করেন, আর্টিস্ট, তাঁরা যে ডার্ক কথা বলবেন এটা স্টিরিওটাইপ। ফলত ওঁর সমস্যা ধরা পড়েনি”— যোগ করলেন রত্নাবলী।

ईद मुबारक ❤️❤️

A post shared by Sushant Singh Rajput (@sushantsinghrajput) on

আসলে অসুখ বলে দাগিয়ে দেওয়া কিছু যায় না। সবটা জৈবিক নয়। আর জৈবিক নয় বলে এই অসুখের অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রশ্ন তুলেছেন রত্নাবলী, “সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে মেন্টাল ইলনেস, আমাকে বল— এটা কী? কেউ অন্য কাউকে বলবে? আমার কষ্ট হচ্ছে আমি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছি! আমাদের যদি সেই রেসপন্ড করার ক্ষমতা থাকত, তা হলে সমাজটাই পাল্টে যেত। আমরা তো সুশান্তের ইনস্টাগ্রামের ইঙ্গিত পড়তে পারিনি।”

৩ জুন অভিনেতার শেষ পোস্ট। পোস্ট বলছে, মানসিক ভাবে একদম ভেঙে পড়লে সবাই যে ভাবে মায়ের কোল খোঁজে, সে ভাবেই তিনি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর মাকে। যে মা তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন, সেই মায়ের আবছা হয়ে আসা মুখ সে দিন তাঁর চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল।

রাজপুত-রা হারেন না। রাজপুত-রা মরেন না। বরং অসম্মানিত হওয়ার আগে তাঁরা নিজেরাই তাঁদের ‘বীরগতি’ করেন। সুশান্ত সিং রাজপুতের এমন কোন দুঃখ লুকোনো ছিল, কেউ জানে না। তাঁর প্রাক্তন অঙ্কিতা লোখান্ড, বর্তমান রিহা চক্রবর্তী, প্রযোজক, পরিচালক আর গোটা দেশ খুঁজছে, তাঁর না থাকার কারণ। ৩৪ বছরের যে প্রাণবন্ত পুরুষ প্রেমের ভাঙাগড়াতেও অবিচল থাকতেন, যিনি মঞ্চে উঠে পুরস্কারের পর পুরস্কার নিতে নিতে আত্মবিশ্বাসের হাসি ছড়িয়ে দিতেন দর্শকদের উদ্দেশে, কোন শোকে তিনি এ ভাবে হেরে গিয়ে মুখ লুকোলেন? কেউ জানে না! তবে ইন্ডাস্ট্রি বলছে, সময় বিশেষে পুরুষের চোখ উপচে জল ঝরা উচিত। সেই জল তাঁকে আরও উর্বর করে। দুর্বল করে না। আপশোস, সুশান্ত যদি সেটা বুঝতেন!

সুশান্তের টুইটারে হ্যান্ডেলে ভ্যান গঘের আঁকা ‘স্টারি নাইট’। তখন তিনি এক আশ্রয়কেন্দ্রে ডিপ্রেশনের সঙ্গে লড়াই করছেন। ছবি আঁকার বছর খানেকের মধ্যেই ভ্যান গঘের অস্বাভাবিক ম়ত্যু। সম্ভবত আত্মহত্যাই ছিল সেটা।

ইঙ্গিত ছড়িয়ে রেখেছিলেন সুশান্তও তাঁর জীবনে! মানুষ তাঁর নাগাল পায়নি। অন্ধকার পেরিয়ে আজ তিনি নিজেই ভ্যান গঘের হলুদ সূর্য আর নীল তারার দেশে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement